নোয়াখালীর সুবর্ণচর ঘুরে এসে: অনেক কষ্ট-শ্রম-অর্থ ব্যয়, সার-বীজের জন্য দৌড়ঝাঁপ, ধারদেনা করে দিনের পর দিন নতুন ফসলের অপেক্ষা, অবশেষে রোগবালাইয়ে সেই ফসল বিপর্যয়ের মুখে। সব ফসলের জন্য উর্বর এলাকা হিসেবে পরিচিত নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চাষিদের অবস্থা এমনটাই।
সরেজমিন ঘুরে চাষিদের কাছে জানা গেল, প্রধান ফসল আমন ধান ছাড়াও প্রায় সব ফসলেই বিভিন্ন মৌসুমে লাগছে রোগবালাই। এ কথা স্বীকার করে স্থানীয় কৃষি দপ্তর বলছে, এ এলাকায় ধান ছাড়াও অন্যান্য রবি ফসলের আবাদ এলাকা আগের চেয়ে বেড়েছে। সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নতুন নতুন রোগবালাইও দেখা দিচ্ছে।
সুবর্ণচরের চর আমানুল্লা গ্রামের চাষি মো. হোসেন। নিজের আবাদ করা ধান ক্ষেতের ভেতরে দিয়ে দেখাচ্ছিলেন পাকা ধানের রোগ। গোছাভর্তি পাকা ধানের গায়ে ফুলের মতো কালচে গোটা। ধান পাকার শুরুতেই এ রোগ দেখা দেয়। আশাপাশের অনেক ক্ষেতেই এ ধরনের সমস্যা দেখা যায়। চাষিরা এটাকে স্থানীয় ভাষায় ‘ধান ফুটে যাওয়া’ রোগ বলে চেনে। ফলে ধানের উৎপাদন কমে যায়। ফলনও কমে আসে।
চর আমানুল্লা, চর ক্লার্ক, মোহাম্মদপুরের গ্রামে গ্রামে পাকা ফসলি মাঠে দূর থেকেই ধানের গোছায় চোখে পড়ে এ কালো আবরণগুলো। চাষিরা জানালেন, ২ থেকে ৩ বছর ধরে এ রোগ বেশি মাত্রায় লাগছে। অনেক কষ্ট অর্থ আর শ্রম ব্যয়ে আবাদ করে তাদের ঘরে ওঠে না ফসল। ফলে কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না চাষিরা।
সামনে পেয়ে চাষি নাছিরুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ধান পাকার পর ফুটে যাওয়া বড় সমস্যা। এ ছাড়াও ধানে মাজরা ও শীষকাটা দুই ধরনের পোকা লাগছে। ক্ষেতের ধানের শীষ ও পাতা লালচে হয়ে যায়। শীষকাটা পোকা লাগলে ধান চিটা হয়ে যায়।
চাষিদের অভিযোগ, এসব রোগবালাইয়ের প্রতিকারে তারা কৃষি বিভাগ থেকে কোনো পরামর্শ পাননি। নিরুপায় হয়ে স্থানীয় ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ এনে ক্ষেতে ছিটান। এতে কখনো ভালো ফল পাওয়া যায়। আবার কখনো ভুল ওষুধে ক্ষেতের সব ফসলই নষ্ট হয়ে যায়।
চাষিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ধানের পর এ এলাকায় সর্বোচ্চ আবাদি ফসল সয়াবিন, ঢেড়স, তরমুজ, শশা, ক্ষিরা ক্ষেতেও রোগবালাই লাগছে। সয়াবিনে বিছা পোকা, ঢেড়সে জাত পোকা, তরমুজে ছত্রাকের আক্রমন আর শশা-ক্ষিরায় সেচ ও লবণাক্ততাজনিত সমস্যা দেখা দেয়। ফলে চাষিরা সমস্যায় পড়ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি চাষিরা না বুঝলেও ক্ষেতের ফসলের বৈচিত্র্য সম্পর্কে ধারণা আছে। তারা বলেন, চাষাবাদ কিংবা ফলন ঘরে তুলতে গিয়ে প্রতি বছর নতুন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। হয়তো ফসল আবাদের কিছুদিন পরেই রোগবালাইয়ের আক্রমণ দেখা দেয়। না হলে ফসল তোলার আগে পাকা ফসলে রোগবালাই হয়।
প্রাকৃতিক সমস্যা সম্পর্কে একমত প্রকাশ করে সুবর্ণচর কৃষি বিভাগ বলছে, এ এলাকার কৃষি জমিতে মাঝারি মাত্রায় লবণাক্ততা আছে। মার্চ-এপ্রিলের দিকে লবণাক্ততা কিছুটা বেড়ে যায়। ফলে রবি ফসল করতে সমস্যা দেখা দেয়।
এইসমস্যা নতুন চরে বেশি। পুরাতন চরে তুলনামূলক সমস্যা কিছুটা কম। উপকূলবর্তী এলাকায় নিম্নচাপের ফলে ফসলের অনেক ক্ষতি হয়। কখনো পুরো এলাকা লোনা পানিতে ভেসে যায়। তখন মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যায়। আবার অতিরিক্ত খরা হলেও মাটি লবণাক্ত হয়।
কৃষি বিভাগ বলছে, চাষিদের পরামর্শ দিতে মাঠ পর্যায়ে কৃষি বিভাগের লোক আছে। তবে এলাকার পরিধি অনুযায়ী লোকের সংখ্যা কম। মাঠে কর্মরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মাত্র ১২ জন। নিবিড় তদারকির জন্য আরও লোক প্রয়োজন। তবে লোক সংকট থাকলেও চাষিদের সমস্যা হলে কৃষি বিভাগ থেকে যথাযথ পরামর্শ দেওয়া হয়।
ফসলের রোগবালাই নিয়ে বাংলানিউজ সরাসরি কথা বলেছে সুবর্ণচর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আমিরুল ইসলামের সঙ্গে। পাকা ধানে চাষিদের ভাষায় ‘ফুটে যাওয়া’ রোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটাকে ইংরেজিতে ‘ফলস স্মার্ট অব রাইচ’, বাংলায় ‘লক্ষী-গু’ আর চাষিরা একে বলে ‘খৈ ফোটা রোগ’। এটা বীজবাহিত রোগ। বীজের সমস্যার কারণে এ রোগ হয়ে থাকে।
এ রোগের প্রতিকারে চাষিদের জন্য কৃষি বিভাগের পরামর্শ হচ্ছে, বীজ শোধন করে রোপণ করতে হবে। তাহলে বীজের জীবাণু মারা যাবে। ‘ভিটাবেক্স’ বা ‘নোইন’ দিয়ে বীজ শোধন করলে এটা আর হবে না। ধান ভিজানোর সময় প্রতি এক মণ বীজের জন্য দশ গ্রাম যেকোনো একটি ওষুধ দিলে সমস্যা আর থাকবে না।
ধানের ব্লাস্ট রোগ প্রসঙ্গে কৃষি বিভাগ পরামর্শ দিচ্ছে, ইউরিয়া সার বেশি দিলে ধানের পাতায় চোখের মতো কালো দাগ পড়ে। এটাই ব্লাস্ট রোগ। ইউরিয়া ছিটানো বন্ধ করে কিছু ছত্রাক নাশক দিলে এ সমস্যা কেটে যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ০০৩২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৪