ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

প্রকৃতিতে সভ্যতার প্রভাব পড়বেই

মীম নোশিন নাওয়াল খান, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৪
প্রকৃতিতে সভ্যতার প্রভাব পড়বেই

প্রকৃতি সংরক্ষণের দায়িত্ব সবার। কারণ আমরা বেঁচে আছি প্রকৃতির উপর নির্ভর করে।

প্রতিদিন পরিবর্তন হচ্ছে সভ্যতা, পরিবর্তিত হচ্ছে বৈশ্বিক জলবায়ু। সভ্যতা এগোনোর পাশাপাশি না চাইতেও প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে আমাদের প্রকৃতি। বিশ্বের অনেক দেশের মতো হুমকির ‍মুখে বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ। দেশে প্রকৃতি নিয়ে কাজ করার লোকও অনেক কম। সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার বলি হয়েছে অসংখ্য সবুজ গাছ। এসব বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম প্রকৃতিবিদ, জীববিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান-লেখক দ্বিজেন শর্মার সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের।

বাংলানিউজ: প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার বা প্রকৃতি নিয়ে কাজ করার অনুপ্রেরণা কী? এক্ষেত্রে কী ছোটবেলায় আপনার পাহাড়ি শৈশবের ভূমিকা আছে?

দ্বিজেন শর্মা: অনেকেই এমনটা মনে করেন। কিন্তু আমি বলব এটা ভুল। প্রকৃতির কাছে থাকলেই তুমি প্রকৃতিপ্রেমী হবে এমন কোনো কথা নেই। যদি তাই হতো, তাহলে কী এস্কিমোরা বা মরুভূমির মানুষরা গাছপালা-ফুল-পাখি ভালোবাসত?

এই বিষয়টা আসলে ভেতর থেকে আসে। সবার সবকিছু ভালো লাগে না। তাই সবাই প্রকৃতিপ্রেমী হয় না। তবে হ্যাঁ, যে যেই পরিবেশে বড় হয়, সেই জায়গা, সেখানকার পরিবেশ-প্রকৃতির প্রতি তার একটা আলাদা টান থাকে।

বাংলানিউজ: গাছপালা-ফুল নিয়ে অনেক দিন লিখছেন। বর্তমানে প্রকৃতি নিয়ে বাংলাদেশে যারা কাজ করছেন এবং যে কাজগুলো হচ্ছে সে বিষয়ে আপনার মতামত কী?

দ্বিজেন শর্মা: আগেই বলেছি, সবাই প্রকৃতিপ্রেমী হয় না। শুধু বাংলাদেশ নয়, দুই বাংলা মিলিয়ে হিসেব করে দেখো, প্রকৃতি নিয়ে ক’জন লিখছেন? হাতে গুণে বলে দেওয়া যাবে- এত কমসংখ্যক মানুষ প্রকৃতি নিয়ে কাজ করছেন। সেজন্য স্বাভাবিকভাবেই এ বিষয়ে কাজ হচ্ছেও খুব কম।

বাংলানিউজ: জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে যাওয়াও এর অন্যতম কারণ। আবার জলবায়ু পরিবর্তনেও প্রকৃতির উপরে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সবকিছু মিলেই বর্তমান প্রেক্ষাপটে গাছপালা-বন-বনানী ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রকৃতি সংরক্ষণে আমাদের কী করা উচিত বলে মনে করেন?

দ্বিজেন শর্মা: এ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। শুধু আমি কেন, পুরো বিশ্বের কেউ এ প্রশ্নের উত্তর জানেন না। যদি আমি বলি যে আমরা গাছ লাগালে, বন রক্ষা করলেই সমাধান হয়ে যাবে, তার মানে আমি ভুল বলছি। কারণ পুরো বাংলাদেশটাও যদি তুমি বন বানিয়ে ফেলো, কী হবে? মানুষ খেতে পাবে না, চাকরি থাকবে না, জীবন চলবে না। জীবন চলতে হলে কলকারখানা দরকার, আর সেগুলো থাকলে প্রকৃতি ধ্বংস হবেই।

বাংলানিউজ: তাহলে আমরা কী করতে পারি?

দ্বিজেন শর্মা: সত্যি বলতে আমরা কিছুই করতে পারি না। কেউ যদি সত্যিই প্রকৃতিকে ভালোবাসে, প্রকৃতি সংরক্ষণ করতে চায়, তাকে খুব সাধারণ জীবনযাপন করতে হবে। কারণ আমাদের আধুনিক জীবন বা নগর জীবনের প্রায় সবকিছুই প্রকৃতির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

সবসময় মানুষকে প্রকৃতি ধ্বংসের জন্য দায়ী করা হলেও ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। পুরো বিষয়টার জন্য মানুষ দায়ী নয়, নিজেদের প্রয়োজনেই তাদের জীবনের উন্নতি করতে হয়েছে, সভ্যতার অগ্রগতি হয়েছে। সভ্যতা আর প্রকৃতি সাংঘর্ষিক অবস্থানে। সভ্যতার যতই উন্নতি হবে, প্রকৃতির উপর ততই বিরূপ প্রভাব পড়বে। এটাই সত্য, এর কোনো বিকল্প নেই। আবার প্রকৃতি ছাড়া আমরাও বাঁচতে পারব না। আমরা তো সবকিছু জেনেশুনেই নিজেদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছি।

বাংলানিউজ: তরুণ প্রজন্মকে প্রকৃতিপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে কী করা উচিত বলে মনে করেন? এ বিষয়ে আপনারা কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন কী?

দ্বিজেন শর্মা: এখনকার ছেলেমেয়েরা বই পড়ে না, খেলাধুলা করে না, প্রকৃতির দিকে তাকানোরও সময় নেই তাদের। সত্যি বলতে জীবনটাই তো এমন হয়ে গেছে। তারা এখন হয় টিভি দেখে, নয় ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকে। পড়াশোনার চাপও বেড়েছে, সাথে জীবনযাপন পরিবর্তন হয়েছে- সব মিলে এই প্রজন্মের মধ্যে আর প্রকৃতির জন্য ভালোবাসা তেমন দেখা যায় না। তবে এখন দেখছি অনেকেই প্রকৃতি সংরক্ষণে সোচ্চার হচ্ছেন, সেটা আশা জাগানোর মতো বিষয়।

আমরা ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন রকম গাছপালার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আয়োজন করি মাঝে-মধ্যে। রমনা পার্ক বা অন্য কোথাও নিয়ে গাছপালা চেনানো হয়, বিভিন্ন গাছের উপকারিতা সহ বিভিন্ন দিক জানানো হয়।

বাংলানিউজ:
বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রকৃতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিদিন অনেক গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। এ ব্যাপারে কী বলবেন?

দ্বিজেন শর্মা: এখন যেটা হচ্ছে সেটা একটা যুদ্ধের মতো। যুদ্ধের সময় মানুষ মানুষকেই মেরে ফেলে, এখনো ফেলছে। প্রকৃতির কথা ভাববার সময় কোথায়?

বাংলানিউজ: কিন্তু প্রকৃতি তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় আমাদের করণীয় কী?

দ্বিজেন শর্মা: করণীয় কিছুই নেই। গাছগুলো তো কেটে রাস্তা আটকানো হচ্ছে, তাই না? রাস্তার পাশের গাছটা কেটে ফেললেই রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়া রাস্তা আটকানোর সহজ ও ভালো উপায় কী হতে পারে? সুতরাং, এই অস্থিরতা চলতে থাকলে প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। তাই প্রকৃতি বাঁচাতে হলে সংঘাত বন্ধ করতে হবে, এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।    

একনজরে দ্বিজেন শর্মা
দ্বিজেন শর্মার জন্ম ২৯ মে, ১৯২৯। স্নাতকোত্তর পাঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৫৮)। শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন
শুরু: বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ (১৯৫৮-৬২), ঢাকার নটেরডেম কলেজ (১৯৬২-৭৪)। অতঃপর মস্কোর প্রগতি প্রকাশনে অনুবাদক (১৯৭৪-১৯৯১)। শিক্ষক, লেখক, অনুবাদক-সর্বত্রই স্বনামখ্যাত। বহুমুখি কৌতূহল, প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি, পরিবেশ সুরক্ষা ও সৌন্দর্যায়নের নিরলস কর্মী দ্বিজেন শর্মা আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের একজন বর্ণাঢ্য মানুষ। এ যাবত তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সতেরটির বেশি। কাজের অবদান স্বরূপ পেয়েছেন বহু পুরস্কার। তার প্রাপ্ত পুরস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ড. কুদরত-এ খুদা স্বর্ণপদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। ২০০১ সালে পান চ্যানেল আই প্রবর্তিত প্রকৃতি সংরক্ষণ পদক।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৪
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।