ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

বাড়ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা ও মরুকরণ

ড. ফোরকান আলী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৪
বাড়ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা ও মরুকরণ

প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে পৃথিবীর। এই পরিবর্তনের ধারায় কখনো সিডর, কখনো সুনামি, আইলা, কখনো ভূমিকম্প, কখনো অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা।

এতে মারা যাচ্ছে মানুষ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাঠের পর মাঠ ফসল। বাড়ছে খাদ্য সংকট। ঘরবাড়ি মিশে যাচ্ছে মাটিতে। ফলে মানুষ হারাচ্ছে তার মাথা গোঁজার ঠাঁই।

নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে জলবায়ুর কুপ্রভাবে বিশ্বের মরুকরণ একটি অন্যতম সমস্যা। বিশ্বের শুষ্ক ভূমির ৭০ শতাংশ ইতোমধ্যেই হয়ে পড়েছে মরুকবলিত। এর পরিমাণ পৃথিবীর মোট ভূমির চার ভাগের এক ভাগ। নিষ্কাশনে অব্যবস্থাপনা, লবণাক্ততার ফলে সেচের আওতাধীন আবাদি জমির বিশাল অংশ আজ অবক্ষয়ের সম্মুখীন। সুতরাং, মরুকরণ ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য এক বিশাল হুমকি। এজন্য প্রয়োজন মরুকরণ বিস্তার রোধ।

জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে অবক্ষয় প্রক্রিয়াই হচ্ছে মরুকরণ। শুষ্কভূমি পরিবেশগত দিক থেকে খুবই নাজুক। এমন ভূমিই মরুকরণের শিকার হয়। মরুকরণের ফলে ভূমি হারিয়ে ফেলে উৎপাদন ক্ষমতা। হয়ে যায় অনুর্বর। যার ফলে সৃষ্টি হয় খাদ্য সংকট, বাড়ে গরিবের সংখ্যা। তাই খরা, মরুকরণ বিস্তার রোধে প্রয়োজন পরিবেশ সম্মতভাবে, সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ন্যায়ানুগ ও অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় পদ্ধতিতে ভূমির ব্যবহার।

মরুকরণের বিরূপ প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতি উপলব্ধি করে ১৯৯২ সালে রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্মেলনের পরপরই মরুকরণ সংক্রান্ত আর্ন্তজাতিক কনভেনশন গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। রিও সম্মেলনের এজেন্ডা-২১ এর প্রস্তাবটি ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের ৪৭তম অধিবেশনে গৃহীত হয় এবং ইন্টারগভর্নমেন্টাল নেগোশিয়েটিং কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি মরুকরণ সংক্রান্ত খসড়া কনভেনশন চূড়ান্ত করে। ১৯৯৪ সালের জুনে কনভেনশনের দলিল চূড়ান্ত হয়। এই কনভেনশন ৫০টি দেশে অনুমোদিত হওয়ার পর ২৬ ডিসেম্বর ১৯৯৬ সাল থেকে কার্যকর হয়।

জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির সহায়তায় পরিচালিত এক জরিপ মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার আকাশে তিন কিলোমিটার পুরু ধোঁয়াশার মেঘ জমেছে। এ মেঘ থেকে ঝরতে পারে অ্যাসিড বৃষ্টি। যা বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটাতে পারে। ছাই, অ্যাসিড, দাবানল, অ্যারোসল অনিয়ন্ত্রিত জ্বালানির ব্যবহার, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও কল-কারখানার বিষাক্ত গ্যাস মিলে বাদামি মেঘের আস্তরণ তৈরি হয়। এ বাদামি মেঘের জন্যই এ এলাকাতে বৃষ্টিপাত দীর্ঘস্থায়ী ও অনিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

১৯৮০ সালের মাঝামাঝি উপ-সাহারীয় আফ্রিকায় খরার কারণে ত্রিশ লাখ লোকের মৃত্যু হয়। এছাড়া বিশ্বের নানা দেশে জলবায়ুর কুপ্রভাবের ফলে শুরু হয়েছে মরুকরণ। ১৭৫০ সাল থেকে জীবাশ্ম জ্বালানির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার, কৃষিতে ফলন বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার পৃথিবীর পরিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

গত একশ বছরের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা ০.৭৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা এভাবে বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা ০.৫০ থেকে ১.৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা যদি এভাবে বেড়ে যায়, তাহলে নানা সমস্যার সন্মুখীন হতে হবে আমাদের। এতে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, সুপেয় পানি ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি তাদের অধিকার, গৃহায়ণ ও অন্যান্য অবকাঠামোগত সুবিধা হুমকির মুখে পড়বে।

ভৌগোলিক অবস্থান ও বর্তমানে অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের অসহায় শিকারে পরিণত। এছাড়া পানি নিয়ে ভারতের বিমাতাসুলভ আচরণ আমাদের দেশে মরুকরণকে ত্বরান্বিত করছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল শুষ্কভূমিতে পরিণত হচ্ছে। ক্রমান্বয় এই শুষ্কভূমি পরিণত হবে মরুভূমিতে। এতে আমাদের দেশের উত্তর পূর্বাংশের বিস্তির্ণ অঞ্চল মরুকরণের শিকার হবে। কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি পানিশূন্য হয়ে পড়বে দেশ। তৈরি হবে নানা ধরনের বিপর্যয়।

ভারতের সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবই বাংলাদেশের মরুকরণ সংকট সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, আগামী ৫০ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অনেকটা অংশ সমুদ্রগর্ভে বিলিন হয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, জীব-বৈচিত্র্য, স্বাস্থ্য, সুপেয় পানি ও উপকূলবর্তী এলাকার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত বেড়ে গিয়ে বন্যা হবে, খাদ্য উৎপাদন শতকরা ৩০ ভাগ কমে গিয়ে ক্ষুধা ও গরিবের সংখ্যা বাড়িয়ে দেবে। তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে হিমালয়ের হিমবাহগুলো গলে বিপর্যয়ের মুখোমুখি করবে আমাদের। আগামী প্রজন্মের স্বার্থে ধরিত্রিকে বদলের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।

লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ

পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য পাতায় লেখা পাঠান এই মেইলে: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৪
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।