ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

নির্বাচন নেই, অধিকারও নেই

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৪
নির্বাচন নেই, অধিকারও নেই ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

হরণী, হাতিয়া, নোয়াখালী ঘুরে এসে: নির্বাচনহীন দুই ইউনিয়ন হাতিয়ার হরণী আর চানন্দী। এখানকার মানুষ বরাবরই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেয়।

কিন্তু ইউনিয়নের পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার নির্বাচিত করার সুযোগ নেই তাদের। দুই ইউনিয়নের দেড় লক্ষাধিক মানুষ বছরের পর বছর থাকছেন ‘অভিভাবকহীন’। সালিশ বিচারসহ স্থানীয় সমস্যা সমাধানে বাসিন্দাদের অন্তহীন দুর্ভোগ। স্থানীয় সরকারের সহায়তা পায় ছিটেফোঁটা।

সরেজমিন ঘুরে বাংলানিউজের চোখে পড়ে, এ এলাকায় নদী ভাঙে। ভূখন্ড বদলায়। জনপদ স্থানান্তরিত হয়। মানুষ ছুটে এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে। এভাবেই হরণী ও চানন্দী ইউনিয়ন উপকূল জেলা নোয়াখালীর হাতিয়ার মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে এসে একই জেলার সুবর্ণচর উপজেলার ভূখন্ডে মিলিত হয়েছে। যুগে যুগে এখানে গড়ে উঠেছে জনবসতি।

স্থানীয় সূত্রমতে, বয়ারচর, নলের চর, কোরিং চর ছাড়াও নতুন জেগে ওঠা বেশ কয়েকটি চর নিয়ে হাতিয়ার হরণী ও চানন্দী ইউনিয়ন। নোয়াখালীর সুবর্ণচর ও লক্ষীপুরের রামগতির সঙ্গে সীমানা বিরোধের কারণে এ ইউনিয়ন দুটিতে নির্বাচন হচ্ছে না।

এ কারণে তিনটি পৃথক প্রশাসনিক কমিটি দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে এ দুটি ইউনিয়ন। এগুলো হচ্ছে বয়ারচর, নলের চর ও কেয়ারিং চর প্রশাসনিক কমিটি। সরকার মনোনিত এ কমিটিতে প্রশাসকের অধীনে একজন সচিব ও পাঁচজন সদস্য আছেন।

বয়ারচর প্রশাসনিক কমিটির সচিব এনায়েত হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, নির্বাচিত পরিষদ না থাকায় এলাকার উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনায় নানামুখী সমস্যা হচ্ছে। নিতান্তই প্রয়োজনীয় কাজগুলো আমরা চালিয়ে নিচ্ছি। এলাকা অনেক অনুন্নত, এলাকার বাসিন্দাদের বেশির ভাগ হতদরিদ্র। সে তুলনায় বরাদ্দ আসে যৎসামান্য। সরকারি অনেক সেবা থেকে এখানকার সাধারণ মানুষেরা বঞ্চিত।

বয়ারচরের হাতিয়া বাজারের বাসিন্দা এরশাদ আলী বাংলানিউজকে বলেন, নির্বাচিত চেয়ারম্যান-মেম্বার না থাকায় আমরা অনেক সমস্যায় পড়ছি। বিচার-সালিসের জন্য কারও কাছে যেতে পারি না। আমরা কেমন আছি, সে খবরও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নেওয়ার কেউ নেই। নির্বাচিত চেয়ারম্যান-মেম্বার থাকলে তারা এলাকার জন্য অনেক কাজ করতে পারেন। এরশাদ আলীর মত আরও অনেকে ইউনিয়নে নির্বাচনের দাবি জানান।

কেয়ারিং চরের মফিজ উদ্দিন বলেন, এ এলাকার মানুষ অনেক কষ্টে আছে। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হয় না, এতে আমরা নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। আমরা যেমন ভোট দিতে পারি না, তেমনি ইউনিয়ন থেকে কোনো সহযোগিতাও পাই না।    

প্রশাসনিক কমিটির সূত্রমতে, পূর্ণাঙ্গ ইউনিয়ন পরিষদ না থাকায় এখানে সরকারি বরাদ্দ আসে নামমাত্র। তিন কমিটির অধীনে প্রায় ৯৮ শতাংশ হতদরিদ্র। অথচ যে বরাদ্দ আসে তাতে ১০ শতাংশ মানুষকে দেওয়া সম্ভব হয় না। পার্শ্ববর্তী অন্যান্য ইউনিয়নের তুলনায় এখানে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি, টেস্ট রিলিফ, ভিজিডি, ভিজিএফ সব ক্ষেত্রেই বরাদ্দ অনেক কমে এসেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি সব ক্ষেত্রেই সমস্যা বিদ্যমান।

কেয়ারিং চর প্রশাসনিক কমিটির প্রশাসক ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা মো. ফয়েজ আহম্মদ বাংলানিউজকে বলেন, একদিকে আমরা অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছি। অন্যদিকে এখানে কাজের কোনো পরিবেশ নেই। কমিটি থাকলেও নেই ইউনিয়ন পরিষদের কোনো স্থায়ী ভবন।

ইউনিয়নের প্রবীণ ব্যক্তিরা জানালেন, এক সময় এ ইউনিয়ন দুটি হাতিয়ার মূল ভূ-খন্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। মেঘনা নদীর ভাঙনে এ জনপদ বিলীন হয়ে এপারে এসে চর সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে এখানে বসতি শুরু হয়। নদী ভাঙনের শিকার মানুষগুলো এখানে এসে ঘর বাঁধে। বসতি স্থাপনের পর থেকে নানা নির্যাতন সহ্য করে চরের বাসিন্দারা এ অবধি এসেছে। এখনো সব নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত তারা।

ওপারে হাতিয়া উপজেলা সদর, আর তার অধীনে এপারে উপজেলার দুটি ইউনিয়ন। মাঝখানে প্রায় ২০ কিলোমিটার নদীপথ। দুর্গম যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে ওপার থেকে এপারে সরকারি দপ্তরগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় ইউনিয়নের হাজারো মানুষ। প্রশাসন যথাযথভাবে এ দূর জনপদের প্রতি নজরও রাখতে পারে না।

চানন্দী ইউনিয়নের বেশ কজন বাসিন্দা জানালেন, এ দুর্গম এলাকায় কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। অন্যসব স্থানে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও এ ইউনিয়নে নেই। ফলে যথাসময়ে চিকিৎসা সেবা নেওয়া এখানকার মানুষের জন্য খুব কষ্টসাধ্য। পুরো এলাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। বেসরকারি কিছু স্কুল থাকলেও তাতে লেখাপড়া করার মতো কোনো পরিবেশ নেই। ফলে বহু ছেলেমেয়ে শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

সরেজমিনে এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলার সময় তারা ইউনিয়ন দুটিকে সুবর্ণচরের আওতাভুক্ত করার দাবি তোলেন। অনেকে আবার বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বানের সময় এ দুই ইউনিয়নের মানুষ হাতিয়া আসনেই ভোট দিয়ে থাকে। কিন্তু সরকারি উন্নয়ন কর্মকান্ড সুবর্ণচর উপজেলা থেকে পরিচালিত হোক। তাহলে এলাকার মানুষ নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত হবে না।

বাংলাদেশ সময়: ০২১১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৪
সম্পাদনা: সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।