ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

ভরসা কবিরাজ, বেহাল স্বাস্থ্যসেবা

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৪
ভরসা কবিরাজ, বেহাল স্বাস্থ্যসেবা

ওছখালী, হাতিয়া, নোয়াখালী ঘুরে এসে: আধুনিক চিকিৎসার এ যুগেও ভরসা ফকির-কবিরাজ। সব রোগ সারাতে ঝাঁড়ফুক আর তাবিজ-কবজই সম্বল।

ডায়রিয়া থেকে প্রসব জটিলতা, সব রোগের দাওয়াই পাওয়া যায় হাতুরে ডাক্তারের কাছে। সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রত্যন্তের বহু এলাকায় পৌঁছেনি। যেটুকু পৌঁছেছে তাতে সেবা দেওয়া যাচ্ছে খুব কম সংখ্যক মানুষকে।

উপকূল জেলা নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার প্রত্যন্ত এলাকার স্বাস্থ্য চিত্রটা অনেকটা এমনই। উপজেলার নিঝুম দ্বীপ, বুড়িরচর, সুখচর, তমরুদ্দি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া যায় নানা তথ্য।

প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, দূর-দূরান্ত থেকে দুর্গম পথ পেরিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসেও সেবা মিলছে না। উপজেলা হাসপাতালে সবই আছে। কিন্তু সেবা দেওয়ার লোকেরই শুধু অভাব। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সরকারি হাসপাতালে কেউ যায় না।

বেসরকারি উদ্যোগে প্রত্যন্ত এলাকায় কিছু স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছালেও বড় সমস্যায় এ উপজেলা হাসপাতালেই আসতে হয়। এ দ্বীপ থেকে মুমূর্ষু রোগী নিয়ে জেলা সদরে যাওয়া ভাগ্যনির্ভর।

হাতিয়া উপজেলা হাসপাতালে চক্কর ঘুরে এলেই এখানকার স্বাস্থ্যসেবার চিত্রটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে হাসপাতালের ভেতরটা একবার ঘুরে আসাটা অত্যন্ত কঠিন। টয়লেটের ধারে কাছে যাওয়া তো দূরের কথা, ওয়ার্ডে রোগীদের কাছাকাছি পৌঁছাটাই কষ্টকর। দুর্গন্ধে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ওয়ার্ডের মেঝে, বিছানার চাদর, পর্দা এসব কবে পরিস্কার করা হয়েছে কেউ বলতে পারে না। ময়লা-আবর্জনা জমে থাকে বারান্দাতেও।

সরেজমিনে হাসপাতাল ঘুরে বাংলানিউজের নজরে আসে, ওয়ার্ডগুলোতে বহু ধরনের রোগীর ভিড়। তবে ডাক্তারের দেখা নেই। রোগীরা জানালেন খুবই অল্প সময়ের জন্য ডাক্তারের দেখা পান তারা। বহু বেডে নেই বিছানার চাদর। আবার বিছানার একাংশ ছিড়ে মেঝেতে পড়ে আছে।

হাসপাতালের প্রধান গেট থেকে ওয়ার্ড অবধি বহিরাগতদের অবাধ চলাচল সব সময়ই চোখে পড়ে। ওয়ার্ডে ঠাঁই মিলছে না। তাই বহু রোগী বারান্দায় কিংবা সিঁড়ির ওপরে চিকিৎসাধীন সময়টুকুর জন্য জায়গা করে নিয়েছেন।

রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেডের রোগীরা স্বপ্নের মত দু-একবার ডাক্তারের দেখা পেলেও বারান্দা ও সিঁড়িতে জায়গা করে নেওয়া রোগীরা পুরোপুরি সেবা থেকে বঞ্চিত। বারান্দায় ঠাঁই নেওয়া রোগীদের সঙ্গে আসা স্বজনেরাই রোগীর শরীরে স্যালাইন লাগাচ্ছে, খুলছে। এ রোগীদের জন্য হাসপাতালে আসতে পারার প্রশান্তিটুকুই যেন যথেষ্ট। আছে হাসপাতালে দালালদের দৌরাত্ম্য।

সরেজমিন সূত্র বলছে, প্রায় তিন বছর হল হাসপাতালটি ৩১ থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে। এখানে ২৯ জন ডাক্তারের মধ্যে আছেন মাত্র পাঁচজন। প্রসূতি বিভাগের প্রসূতি কক্ষে এক যুগেও কোনো সন্তানের জন্ম হয়নি।

কারণ এ বিভাগে কোনো ডাক্তার নেই। ১৬ জন নার্সের মধ্যে হাসপাতালটি কোনোমতে চালিয়ে রাখছেন মাত্র ৬ জন নার্স। এদের মধ্যে একজন আবার স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার আবেদন করেছেন। ৮ জন সুইপারের মধ্যে কাজ করছেন মাত্র একজন।

হাসপাতাল চত্বরে ডাক্তার ও কর্মকর্তা কর্মচারিদের আবাসিক ব্যবস্থা আছে এখানে, শুধু থাকার লোকেরই অভাব। লোকবলের অভাবে হাসপাতালের অনেক কক্ষ বছরের পর বছর খোলাই হয় না। ৫০ শয্যায় উন্নীত হওয়ার পর বেশ কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি এসেছে এখানে। কিন্তু মূল্যবান এ সব যন্ত্রপাতির কিছু প্যাকেট যথাযথ লোকের অভাবে এখন অবধি খোলাই সম্ভব হয়নি। এতে কী যন্ত্রপাতি আছে, তাও হাসপাতালের কেউ বলতে পারে না।

শূন্যপদ সম্পর্কে জানতে চাইলে হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. আবদুল কাদির বাংলানিউজকে বলেন, কী নেই তা জানতে চাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করুন এখানে কী আছে। ‘নেই’ তালিকার চেয়ে ‘আছে’ তালিকাটা অনেক ছোট হবে। বাইরে থেকে এসে এখানে ডাক্তার-কর্মকর্তা-কর্মচারিরা থাকতে চান না। অনেককে এখানে বদলি করা হলেও এসেই অন্যত্র চলে যাওয়ার তদবির শুরু করেন।

এদিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, এ হাসপাতালে মৃত শিশুর জন্ম তুলনামূলক বেশি। কারণ প্রসবকালীন জটিলতায় রোগীকে প্রথমে নেওয়া হয় গ্রামের হাতুরে ডাক্তারের কাছে। শুধু বড় কোনো সমস্যায় পড়লেই এখানে আনা হয়। এর মধ্যে অনেক সময় পেরিয়ে যায়। ফলে শেষমেশ নবাগত শিশু বাঁচিয়ে রাখা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ জন্য মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।

প্রত্যন্ত এলাকার মানুষদের যথাসময়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়া এবং প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার লক্ষ্যে হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ ছাড়াও কয়েকটি এলাকায় কাজ করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা। চার বছর আগে এখানে একটি প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক চালু করা হয়। এ ছাড়াও এ ক্লিনিকের অধীনে তিনটি স্যাটেলাইট ক্লিনিক আছে।

ক্লিনিকের মেডিকেল অ্যাসিসট্যান্ট জয়দেব দাস বাংলানিউজকে বলেন, এ ক্লিনিকে গর্ভবতী মায়েদের পরিচর্যা, প্রসূতি মায়েদের সেবা, শিশু ও বড়দের নানা সমস্যার প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে ক্লিনিকে মা ও শিশুদের সেবাই প্রাধান্য পায়। বেসরকারি পর্যায়ের এ সেবা চালুর আগে এ এলাকার মানুষ প্রাথমিক চিকিৎসাটুকুও পেতো না। এখন অন্তত কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা এবং কী অসুখে কোথায় যেতে হবে, এমন ধারণা পান তারা। এলাকার মানুষদের ফকির-কবিরাজ ও হাতুরে ডাক্তারদের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে।

নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহরাজ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরের এ এলাকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বেশ নাজুক। অনেক কষ্টে দীর্ঘপথ পেরিয়ে উপজেলা হাসপাতালে গিয়েও ভালো সেবা পায় না এখানকার মানুষ। একটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলে এখানকার মানুষ উপকৃত হতো।

হাতিয়া দ্বীপে দীর্ঘদিন কর্মরত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রফিকুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে অন্য সব ক্ষেত্রের মতো এখানকার মানুষ চিকিৎসা ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। প্রত্যন্ত এলাকার মানুষদের কথা বিবেচনায় রেখে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে বেসরকারি সেবা সম্প্রসারনের উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশ সময় ১২০২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৪
সম্পাদনা: সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।