রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার খোড়াগাছ ইউনিয়ন। গাছপালায় ঢাকা ছোট সুন্দর একটা গ্রাম ‘সিরাজ’।
গ্রামে গেলে প্রায় সময় রাতে অদ্ভুত একটা আওয়াজ শুনতে পেতাম। বনের ভিতর থেকে আওয়াজটা আসত। ছোট বেলায় অনেক ভয়ও পেতাম। এটা কোনো সুরেলা আওয়াজ ছিল না। মনে হতো কেউ শুকনো বাঁশে জোরে আঘাত করছে। ভয় ভাঙানোর জন্য একদিন আমার দাদী বললেন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এটা একটা পাখির ডাক।
পাখির নাম জানতে চাইলে দাদী বললেন ‘আকওয়াল ভুরকা’। নামের অর্থও বুঝিয়ে বললেন। আমাদের গ্রামের ভাষায় আকওয়াল অর্থ হলো রাখাল। আর ভুরকা অর্থ ছলনা করা। এই আজব নামকরণের কারণ তখনও বুঝতে পারি নি। পরে আমার বাবার কাছে নামকরণের কারণ জানতে চাইলাম।
তিনি বললেন, এটা একটা রাতচরা পাখি। দিনের বেলা এরা নিজেদের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রাখে। রাখালরা গরু নিয়ে মাঠে গিয়ে ঝোপের ছায়ায় বসে থাকে। কখন তাদের চোখে পড়ে যায় পাখিটা। তখন তারা পাখিটা ধরার চেষ্টা করে। পাখিটা কিছুদূর উড়ে গিয়ে চুপ করে বসে যায়। রাখাল আবার ধরার চেষ্টা করে। এভাবে রাখালের সময় নষ্ট হয় কিন্তু পাখি আর ধরা দেয় না। এজন্যই পাখির নাম ‘আকওয়াল ভুরকা’ বা রাখালের সঙ্গে ছলনাকারী।
বাবা আর দাদীর কাছে শুনে শব্দের প্রতি যে ভয় ছিল তা কেটে গেল। কিন্তু নতুন করে আগ্রহ তৈরি হলো পাখিটাকে এক নজর দেখার। অনেক চেষ্টা করেও দেখা পাই নি। তবে ভাগ্য এবার সুপ্রসন্ন হলো। গত বছরের শেষের দিকে দেখা হয়ে গেল পাখিটার সঙ্গে। ঈদ করতে সবাই এবার গিয়েছিলাম গ্রামের বাড়িতে। বাড়ি গিয়ে সন্ধ্যা থেকেই বাড়ির আশেপাশে কয়েকটা লম্বা লেজ রাতচরার ডাক শুনতে পেলাম।
ক্যামেরা আর টর্চলাইট নিয়ে ছোটাছুটি করে খুঁজলাম। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। পাখি মহাশয় কিছুতেই দর্শন দিল না। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন ঈদ হওয়ায় ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ঘুম থেকে উঠলাম। উঠে আবার সেই ডাক শুনতে ফেলাম। কিন্তু ডাকটা এবার বেশি দূরে নয়, আমার ঘরের পিছন থেকে আসছে।
আলো ফোটার পর ঘরের পিছনের বাঁশঝাড়ে গেলাম। অনেক খোঁজাখুজির পর মহাশয়ের দেখা পেলাম। একটা শুকনো বাঁশের গোড়ার সাথে নিজেকে এমনভাবে লুকিয়ে রেখেছে যে, দেখে মনে হচ্ছে পাখিটা নিজেও বাঁশের অংশ। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা ছবি নিয়ে সেখান থেকে চলে এলাম। পাছে না আবার ওর ঘুমের কোনো সমস্যা হয়।
এতক্ষণ যে পাখির কথা বলছিলাম তার ইংরেজি নাম হলো Large Tailed Nightjar। বাংলায় ‘ল্যাঞ্জা রাতচরা’। এরা সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনের বাসিন্দা। এছাড়াও ছোট চিরসবুজ বন ও লোকালয়ের আশেপাশে ঝোপঝাড়েও এদের দেখা মেলে।
পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারদর্শী এই পাখি বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, পাকিস্তান, লাওস, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, চীন, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে এদের দেখা যায়। সাধারণত মার্চ-মে মাসে এদের প্রজনন কাল। বাসা তৈরি না করেই এরা মাটিতে ২টি ডিম পাড়ে। ডিমের ওজন ৮-৯ গ্রাম, ১৬-১৮ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।
বন-জঙ্গল উজাড় হওয়ার কারণে অন্য পাখির মতো এই পাখিটিও বাংলাদেশে কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে এখনি পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ।
হাসান আল রাজী
প্রাণিবিদ্যা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৪
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর