ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

হাতিয়া নৌপথে মৃত্যুঝুঁকি, যাত্রীরা জিম্মি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৪
হাতিয়া নৌপথে মৃত্যুঝুঁকি, যাত্রীরা জিম্মি

ওছখালী, হাতিয়া, নোয়াখালী ঘুরে এসে: হাতিয়ার নৌরুটে ঝড়-তুফানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে সিন্ডিকেট বাণিজ্য। আকাশে মেঘের আনাগোনা আর জোয়ার-ভাটার গতিপ্রকৃতি দেখে প্রতিদিন এ পথে যাতায়াত করেন হাজারো যাত্রী।

বঙ্গোপসাগরের মোহনা ঘেঁসে প্রায় ২০ কিলোমিটার নৌপথে যাত্রীরা মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে চলাচল করলেও ঝুঁকি কমাতে এখানে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। এমনকি সরকারি সি-ট্রাকেও ভরসা নেই যাত্রীদের।

সরেজমিনে বাংলানিউজের চোখে পড়ে, পড়ন্ত বিকেলে হাতিয়ার চেয়ারম্যান ঘাটে গন্তব্যে ফেরা অসংখ্য মানুষের হুড়োহুড়ি। কে কার আগে যাবে। ট্রলারে উঠবে, নাকি সি-ট্রাকে। ভিড় ঠেলে কিছুদূর এগোলে পথ দেখানোর লোক অপেক্ষা করছে। বলছে, সি-ট্রাক ছাড়তে দেরি হবে, ট্রলারে যান। সি-ট্রাক না ছাড়ার এ খবরে যাত্রীরা শঙ্কায়। নিরূপায় হয়ে ট্রলারেই উঠতে হচ্ছে সবাইকে। নারী-পুরুষ ও শিশু সবাই হুড়োহুড়ি করেই ট্রলারে উঠছে।

ঘাটে বাঁধা সি-ট্রাক। কিছুক্ষণ আগেই এসেছে। দূর-দূরান্ত থেকে অনেক যাত্রী এসেছেন বিকালের এ সি-ট্রাকটি ধরতে। কিন্তু ঘাটে এসে সবাইকেই ঝুঁকি নিয়ে সেই ট্রলারেই পারাপার করতে হচ্ছে। এক টিকেট কাউন্টারে দু ধরনের টিকেট পাওয়া যায়।

সি-ট্রাকের ভাড়া ৯০ টাকা, আর ট্রলারে ভাড়া ১৫০ টাকা। কাউন্টারের জানালায় অনেকের হাত একসঙ্গে। প্রত্যেকের হাতে ১৫০ টাকা। সি-ট্রাক না ছাড়ার ঘোষণায় সবার চায় ট্রলারের টিকেট। ঝুঁকি হলেও এটাই তাদের একমাত্র ভরসা।

কিছুক্ষণের মধ্যে আরও একটি সি-ট্রাক ঘাটে ভিড়ে। কিন্তু তাতে বিপদাপন্ন যাত্রীদের কিছুই যায় আসে না। ততক্ষণে বহু যাত্রী ট্রলারে উঠে পড়েছে। ট্রলারে এক টুকরো জায়গা ফাঁকা নেই। নারী ও শিশুদের অনেকে ট্রলারের নিচে বসেছেন। সাহসী পুরুষদের কেউ আবার উঠেছেন পেছনের ছাদে, ট্রলারের চালকের পাশে।

কেউবা সামনে মাস্তুলের সঙ্গে থাকা উঁচু জায়গাটুকুতে কোনোমতে জায়গা করে নিয়েছেন। কেউবা নোঙরের রশি বাঁধা খুঁটিটায় হেলান দিয়ে বসেছেন। ট্রলারের ইঞ্জিনের আশপাশ, এমনকি টয়লেটের ছাদ কোথাও এক টুকরো জায়গা ফাঁকা নেই। কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে কমপক্ষে ৩০০ যাত্রী নিয়ে ট্রলারটি ছেড়ে যায় হাতিয়ার নলচিরার উদ্দেশে।

এটা মাত্র একদিনে একটা ট্রলার ছাড়ার চিত্র। চেয়ারম্যান ঘাট এবং বিপরীতে নলচিরা ঘাট থেকে এভাবে প্রতিদিন অনেক ট্রলার যাতায়াত করে, দৈনিক পারাপার হয় অন্তত দু হাজার যাত্রী। অথচ এ ট্রালারগুলোর যাত্রী বহনের কোনো ফিটনেস কিংবা রুট পারমিট নেই।

মাছ ধরার জন্য তৈরি এসব ট্রলার বাড়তি রোজগারের লক্ষ্যে এ পথে যাত্রী বহন করছে। ফিটনেসবিহীন এ ট্রলারগুলো যাত্রী নিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার মুখে পড়ছে। স্বাধীনতার পর থেকে এ অবধি অন্তত দু থেকে আড়াই হাজার যাত্রী প্রাণ হারিয়েছেন। কয়েকটি পরিসংখ্যান সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

চেয়ারম্যান ঘাট-নলচিরা রুটে নিয়মিত চলাচলকারী যাত্রীরা বলেছেন, নোয়াখালী সদর থেকে হাতিয়া যেতে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ছাড়াও নানামুখী দুর্যোগে যাত্রীদের ভরসা এ ঝুঁকিপূর্ণ নৌযান।

প্রসঙ্গত, মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস অবধি নদী উত্তাল থাকায় নৌ চলাচলেও ঝুঁকি বেড়ে যায়। বছরের প্রায় সারা মৌসুম ঝুঁকির মুখে থাকা এ নৌরুটে দুটি সরকারি সি-ট্রাক থাকলেও তা চলাচল করে সিন্ডিকেট চক্রের ইচ্ছা-অনিচ্ছায়। ঘাট ঘিরে সি-ট্রাকের ইজারাদার ও ট্রলারের মালিকদের সমন্বয়ে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। আর এ সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি সাধারণ নৌ যাত্রীরা।

সূত্র বলছে, সি-ট্রাকের ইজারাদার গ্রুপের সঙ্গে এ পথে চলাচলরত যাত্রীবাহী ট্রলারের মালিকদের সঙ্গে একটি সমঝোতা আছে। সি-ট্রাক ছাড়বে, নাকি ট্রলার ছাড়বে, তা নির্ধারিত হয় ইজারাদারদের ইচ্ছায়। যাত্রী কম হলে সি-ট্রাক বন্ধ রেখে ট্রলারে যাত্রী তুলে দেওয়া হয়।

এক্ষেত্রে যাত্রীদের নিরাপত্তার কোনো তোয়াক্কা করা হয় না। ফলে যাত্রীরা অনেকটা বাধ্য হয়েই চরম ঝুঁকি নিয়ে এ পথে চলাচল করে। একই ঘাট থেকে ছাড়ে সি-ট্রাক ও ট্রলার। টিকেটও বিক্রি হয় একই কাউন্টারে। ইজারাদারদের সবাই আবার ট্রলার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, ইজারাদারদের নেতৃত্বে আছে একরামুল করিম চৌধুরীর ভাই সহিদ চৌধুরী। তার সঙ্গে আরও আছে ফিরোজ খান, এভোকেট সাইফুল ইসলাম, খোকন গাজী ও মো. কাজল। ইজারাদার গ্রুপের যৌথ তহবিলে এ রুটে এফ বি বারআউলিয়া-১, এফ বি বারআউলিয়া-২ ও এফ বি বারআউলিয়া-৩ নামে তিনটি ট্রলার চলাচল করে।

ইজারাদার গ্রুপের সদস্য সাইফুল ইসলামের একারই কয়েকটি ট্রলার আছে। তা ছাড়া হাতিয়া উপজেলা চেয়ারম্যানের ছেলে শিপলুর এফ বি আল মদিনা-১ ও এফ বি আল মদিনা-২ নামে দুটি ট্রলার চলছে এ রুটে।

স্থানীয় সূত্রের অভিযোগ, সি-ট্রাক ইজারাদার ও ট্রলার মালিকদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকায় যাত্রীরা আরও বেশি ঝুঁকিতে থাকছে। ইজারাদার ও ট্রলার মালিকেরা সব সময়ই লাভবান। সি-ট্রাক বন্ধ থাকায় ট্রলারে যাত্রী গেলেও ইজারাদারদের লোকসান নেই। ট্রলারের জনপ্রতি যাত্রী ভাড়া ১৫০ টাকা থেকে ৫০ টাকা সি-ট্রাকের ইজারাদারদের পকেটে চলে যায়। এ কারণে সি-ট্রাক ছাড়তে সব সময়ই নানা অজুহাত দেখায় ইজারাদারেরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সি-ট্রাকের ম্যানেজার মহিবুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, যাত্রীদের জিম্মি করার কথা সঠিক নয়। যাত্রীদের সুবিধার্থেই সি-ট্রাকের বিকল্প হিসেবে ট্রলার চলাচল করে। জোয়ার না থাকলে সি-ট্রাক ছাড়া সম্ভব হয় না। এ সময় ট্রলারে যাত্রী পারাপার করা হয়। তা ছাড়া ইজারাদারেরাই এখানে চলাচলরত ট্রলারের মালিক।

এ নৌপথে প্রতিনিয়ত হাজারো যাত্রী দুর্ভোগের মুখে পড়লেও বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনের কোনো সুনজর নেই। অথচ প্রশাসনের লোকজনকেও এ ঝুঁকিপূর্ণ পথ পাড়ি দিয়েই হাতিয়া সদরে যেতে হয়।

আলাপ প্রসঙ্গে হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. আবদুল কাদির এখানে চাকরি করতে এসে নিজের জীবনে দুটি তারিখকে ‘ডেথ ডেট’ হিসাবে চিহ্নিত করে রেখেছেন। ৫ মে তার এখানে যোগদানের জন্য আসার কথা ছিল। অথচ ওইদিন সি-ট্রাক দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। ২৬ জুন ট্রলারে পারাপারের সময় ট্রলার দুর্ঘটনার মুখে পড়ে। দুটি দুর্ঘটনা থেকেই বেঁচে যান তিনি।

জানতে চাইলে হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হাসনাত মো. মইনুদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখবো।

বাংলাদেশ সময়: ০৭০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৪
সম্পাদনা: সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।