ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

ভাঙনে কমেছে আয়তন, বহাল তবিয়তে চেয়ারম্যান

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৪
ভাঙনে কমেছে আয়তন, বহাল তবিয়তে চেয়ারম্যান ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সুখচর (হাতিয়া, নোয়াখালী) ঘুরে এসে: ইউনিয়নটির দুই-তৃতীয়াংশ কেড়ে নিয়েছে মেঘনা। ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন কয়েক হাজার মানুষ।

ভাঙনে এলাকা ছোট হয়ে যাওয়ায় পরিষদের নির্বাচনও বন্ধ।

অথচ সরকারি বরাদ্দের পুরোটাই পায় ইউনিয়নটি। নির্বাচন ছাড়া চেয়ারম্যানও আছেন বহাল তবিয়তে। এ অবস্থায় জনপ্রতিনিধির জবাবদিহিতা না থাকায় ইউনিয়নের উন্নয়ন বরাদ্দ লুটপাট হচ্ছে। এলাকাবাসী রয়েছেন চরম সঙ্কটে।

উপকূল জেলা নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ইউনিয়ন সুখচরের চিত্র এমনই।

উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরের এ ইউনিয়নটির ইতোমধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মেঘনা গর্ভে হারিয়ে গেছে। ইউনিয়নের ৩, ৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ড সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে। আর ২ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আংশিক অবশিষ্ট আছে।

গত কয়েক বছরে ইউনিয়নের প্রায় ২০ হাজার মানুষ বাসস্থান ও জীবিকার খোঁজে অন্যত্র চলে গেছেন। ভূমি অফিসের রেকর্ডে ইউনিয়ন ছোট হয়ে যাওয়ার এ তথ্য থাকলেও, ইউনিয়নের ৬টি ওয়ার্ড এখনও অবশিষ্ট আছে দাবি ইউনিয়ন পরিষদের।

বাংলানিউজের সরেজমিনে উঠে আসে ক্ষয়িষ্ণু এ ইউনিয়নের নানা তথ্য। ইউনিয়নের পথঘাট ঘুরলেই বোঝা যায় কতটা অবহেলিত এই জনপদ।

বাঁশের সাঁকো আর নৌকা পার হয়ে যেতে হয় কিলোমিটারের পর কিলোমিটার। ভাঙনের মুখে থাকা বসতিগুলো একেবারেই ক্ষণস্থায়ী। বহু মানুষ ঘরবাড়ি বদলাচ্ছেন। কিছু মানুষ রাস্তার পাশে, কিছু আবার দূরে কোথাও মাঠের ভেতরে ঝুপড়ি বানিয়ে বসবাস করছেন।

মেঘনা তীরের বেড়িবাঁধ দিয়ে পায়ে হেঁটে চলতেও পথে পথে বাধার মুখে পড়তে হয়। চোখে পড়ে মানুষগুলোর সঙ্কটের চিত্র। কিন্তু এসব মানুষের নামে আসা বরাদ্দের সিকি ভাগও তাদের কাছে পৌঁছায় না, এমন অভিযোগ এলাকাবাসীর।    

মেঘনার তীর ধরে সুখচর ইউনিয়নের প্রায় আড়াই কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভাঙনের শিকার। নদী ক্রমাগত ভাঙছে, আর কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে। আবার কোথাও সময়মত বাঁধ মেরামত না হওয়ায় ভাঙন খালের রূপ ধারণ করে লোকালয়ের দিকে ঢুকে পড়েছে।

ইউনিয়নের হরিণ বাজার, চেয়ারম্যান বাজারসহ আশপাশের এলাকায় এমন বেশ কয়েকটি খাল চোখে পড়ে। বর্ষায় এ খালগুলো দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ে বসতবাড়িতে।

সরেজমিন তথ্য সংগ্রহের সময় জোয়ার আর জলোচ্ছ্বাসের পানিতে ডুবে বেঁচে থাকার কষ্টের কথাই জানান এলাকার লোকজন।     

সূত্র জানায়, সুখচরের ভাঙন রোধে বরাদ্দ পাওয়া যায় অতি সামান্য। যে বরাদ্দ আসে তা কাজে লাগে না। ইউনিয়নে নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই বলে কাজ বাস্তবায়নে কোনো তাগাদাও নেই। ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান কামালউদ্দিন দায়িত্বে আছেন প্রায় ৯ বছর। সাড়ে তিন বছর আগে পুরোদেশে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় এখানে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও, এলাকা ছোট হয়ে যাওয়ার কারণে নির্বাচন হয়নি।    

ইউনিয়নে নির্বাচিত চেয়ারম্যান না থাকায় এখানে একজন প্রশাসক নিয়োগের দাবি উঠেছে। এলকাবাসীর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন করা হয়েছে। নদীভাঙন, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে পরিষদ পূনর্গঠনের বিধান রয়েছে বাংলাদেশ গেজেটে।

সুখচরের বাঁধ পূনর্নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৩৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল ২০১৩ সালে। টেন্ডারের পর কার্যাদেশও দেওয়া হয়েছিল দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের অসহযোগিতার কারণে তারা কাজ করতে পারেন নি।

বাঁধটি পূনর্নির্মাণ না হওয়ায় ওই বছরের ২৪ জুন পূর্নিমার জোয়ারে প্রায় ৫-৬ ফুট জলোচ্ছাসে পুরো ইউনিয়ন ডুবে যায়। ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে এলাকাবাসী ৩ জুলাই হাতিয়া উপজেলা পরিষদের সামনে সমাবেশ ও মানববন্ধন করে। নেতৃত্ব দেন ক্ষেতমজুর সমিতি নোয়াখালী জেলা কমিটির সভাপতি ও স্থানীয় বাসিন্দা আনোয়ার হোসেনসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।

বরাদ্দ হওয়ার পরও বাঁধ পুনর্নির্মাণ না হওয়া প্রসঙ্গে হাতিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী নাছির উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, বাঁধ নির্মাণের জন্য স্থানীয় পর্যায় থেকে জমি দেওয়াসহ অন্যান্য সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। কিন্তু সুখচরে বাঁধ নির্মাণে সে সহায়তা পাওয়া যায়নি।  

অপর একটি সূত্রের দাবি, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ৩৭ লাখ টাকার কাজের বিপরীতে প্রতি লাখে দুই হাজার টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। সে কারণে কাজ না করে ফিরে যায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দু’টি।

অভিযোগ অস্বীকার করে সুখচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামালউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, বাঁধ নির্মাণ নিয়ে সমঝোতা না হওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ না করে চলে যায়। তাদের কাছে চাঁদা চাওয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন। অন্যান্য অভিযোগও সত্য নয় বলে দাবি তার।  

সূত্র জানায়, এলাকাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২-১৩ অর্থবছরের বরাদ্দ থেকে বাঁধ মেরামতের জন্য দুই খাতে ৪ লাখ ৯০ হাজার এবং ৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কাজটি যথাযথভাবে হয়নি বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। লোক দেখানো কিছু কাজ হলেও তাতে এলাকার মানুষকে পানির তাণ্ডব থেকে বাঁচানোর চেয়ে বরং দুর্ভোগেই ফেলেছে বেশি।

ভাঙনপ্রবণ এলাকা হরিণ বাজারে সরেজমিনে গেলে বাংলানিউজের কাছে স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ তুলে ধরে বলেন, আসলে আমরাই খারাপ। আমাদের জন্যই এলাকার ভাঙন রোধ হয় না। ভালোভাবে বাঁধ নির্মাণের জন্য অনেকেই জমি দিতে চান না।

আলাপকালে অনেক মানুষের ভিড়ে একজন বলে ওঠেন, এই দেশে এতকিছু হয়, আমাদের এই বাঁধটা মেরামতের সামর্থ্য কারও নাই।

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৪
সম্পাদনা: জনি সাহা, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।