ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

জীবনতরীতে জলদাস, জলে-জালে বসবাস

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১৪
জীবনতরীতে জলদাস, জলে-জালে বসবাস

Rafiqulকোড়ালিয়া (তমরুদ্দি), হাতিয়া, নোয়াখালী ঘুরে এসে: জালের সঙ্গে বাঁধা জীবনতরী। যে জালে মাছ শিকার, সেই জালেই বন্দি জীবন।

শিশুকাল থেকে বাবার কাছে মাছ ধরতে শেখা। এরপর বড় হয়ে দক্ষ জেলে হয়ে ওঠা।

মৃত্যুর আগ অবধি এ পেশাতেই জীবিকা। বাপ-দাদার আদি পেশা আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা সবার। এ পেশা বাদ দিয়ে কেউ অন্য পেশায় জীবিকার পথ খোঁজেনি। শিক্ষা-দীক্ষায় জীবনের গতি বদলানোর চেষ্টাও করেনি। তবুও জীবন যুদ্ধে পরাজিত ওরা।

এ গল্প আদি বৃত্তিজীবী জলদাস সম্প্রদায়ের। উপকূল জেলা নোয়াখালীর হাতিয়ার তমরুদ্দি ইউনিয়নের কোড়ালিয়া গ্রামে এ সম্প্রদায়ের বেশ কিছু লোকজনের দেখা মিলল। মেঘনা নদীর ভাঙনের তীরে প্রতিনিয়তই দুর্যোগ-দুর্বিপাকে জেগে আছে জলদাস পল্লী।



নারী-পুরুষ ও শিশুদের একই কাজ। নদী থেকে মাছ ধরা, মাছ ধরে আনার পর বাছাই করা, শেষে বাজারে বিক্রি করা। এতেই তাদের জীবিকা। ভোর থেকে ভোররাত অবধি হাড়ভাঙ্গা খাটুনি, আর রাতে রাস্তার পাশে ঝুপড়ির মতো ঘরে মাথাগোঁজা।

জলদাস সম্প্রদায়ের নারী ও পুরুষের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, সমুদ্র আর নদীর উত্তাল তরঙ্গের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে টিকে আছে এরা। চারপাশের বিকৃত পুঁজিবাদী সমাজের আক্রমণে রাহুগ্রস্থ এরা। শোষণ, দাদন, মধ্যসত্ত্ব প্রথা ছাড়াও নানা প্রতিবন্ধকতা এ আদি জেলেদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখেছে।

দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে এ সম্প্রদায়ের নাগরিকেরা চরম সংকটের মুখে। একদিকে সমুদ্র-নদীতে মাছ ধরতে প্রতিবন্ধকতার শেষ নেই। অন্যদিকে পেশা ছেড়ে অন্য কাজে ফেরাও এদের পক্ষে অসম্ভব। কারণ মাছধরা ছাড়া কোনো কাজই এরা জানেন না।

গবেষণা সূত্র বলছে, জলদাস সম্প্রদায়ের অধিকাংশই সমুদ্র তীরবর্তী জেলে। নদী তীরবর্তী জেলেদের চেয়ে সমুদ্রতীরবর্তী জেলেরা তুলনামূলক সংকটে থাকে। কারণ নদী তীরবর্তী জেলেরা নদীতে মাছ না পেলে অন্য কাজ করতে পারেন।

কিন্তু সমুদ্রতীরবর্তী জেলেদের অন্য কাজে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিংবা গভীর সমুদ্রে গিয়ে মাছধরার সামর্থ্যও নেই তাদের। ফলে জলদাসদের চরম দারিদ্রতার মধ্যে বসবাস করতে হয়। এর মধ্যে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ছাড়াও অন্য সব বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ থাকে না তাদের।

কোড়ালিয়া গ্রামের রতন চন্দ্র জলদাসের বয়স চল্লিশের ঘরে। নিকট সমুদ্র আর নদীতে মাছ ধরে চলে নিত্যজীবন। সেই ছোটবেলায়, যখন কাপড় পড়ার প্রয়োজন হয়নি, তখন থেকেই বাবার সঙ্গে মাছ ধরেন। এ বয়সে এসে দক্ষ জেলে। হাল নেই, চাষ নেই, জমি নেই, মাছ ধরেই কোনোমতে ধুঁকে ধুঁকে চলে জীবন।

নদীতে জাল ফেলতে হয় চুরি করে। এ সম্প্রদায়ের উপার্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম এ জাল ফেলায় আছে আইনি নিষেধাজ্ঞা।

জীবনে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে সমুদ্র আর নদীতে মাছ ধরে পরাজিত ৬৫ বছরের হিরন্ময় চন্দ্র জলদাস। শারীরিক সমস্যার কারণে এখন আর কাজ করতে পারেন না। চিকিৎসায় ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সামর্থ্যও নেই। ছেলে গীরেন্দ্র জলদাসের সংসারের বোঝা এখন।

ছেলেরও সম্পদ নৌকা আর জাল। হিরন্ময় জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন। এখন হাল ধরেছেন তার ছেলে। এক সময় হয়তো তার ছেলেরও প্রস্থান ঘটবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এ সম্প্রদায়ের অবস্থার কোনো উন্নয়ন ঘটবে না।

জলদাস সম্প্রদায়ের এসব মানুষের সঙ্গে কথা হচ্ছিল তমরুদ্দি ইউনিয়নের পশ্চিম জোড়খালী গ্রামের বাজারে। সম্প্রদায়ের সংকটের তথ্য নিতে আর ছবি তুলতে গেলে ভিড় জমে যায়। ভর দুপুরে এঘর-ওঘর থেকে ছুটে আসছেন অনেকে।

নারী-পুরুষেরা প্রত্যেকেই কথা বলতে চান। সবার কাছেই আছে কষ্টকর জীবনের এক একটি বিরাট গল্প। মাছ না পাওয়া, নদীতে জাল ফেলায় নিষেধাজ্ঞা, দেনার দায়ে জর্জরিত, মাছের দাম না পাওয়া, কাজকর্ম না থাকায় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটানো, মহাজনদের কবজায় বন্দি থাকা এসব এলাকার নিত্যগল্প। এসব গল্প ওদের জীবনকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে রাখছে যুগ যুগান্তর।

পশ্চিম জোড়খালী গ্রামের বিসম্বর জলদাসের বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই। মাত্র সাত বছর বয়সে নদীতে। বাবার সঙ্গে মেঘনার উত্তাল ঢেউয়ে, আর অন্যের ট্রলারে সমুদ্রে মাছ ধরেছেন। এ হিসেবে সমুদ্র আর নদীর সঙ্গে তা বসবাস ষাট বছর পেরিয়ে গেছে।

সরেজমিন বাংলানিউজকে বিসম্বর বলেন, আমাগো ব্যবসা হলো মাছ ধরা। যদি লেখাপড়ার কথা বলেন, তাহলে আমাদের পেট চলবে কী করে। তিনবেলা ভাত তো যোগাড় করতে হবে।

ত্রিশ বছর বয়সেই বিধবা অঞ্জলি জলদাস। মাছ ধরতে গিয়ে ঝড়ের কবলে পড়ে আর ফিরে আসতে পারেনি। ষোল বছর বয়সী ছেলে কিশোর প্রাণনাথ জলদাস জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। তার কাজে সাহায্য করে অঞ্জলির অপর দুসন্তান দশ বছরের প্রিয় জলদাস ও আট বছর বয়সী যমুনা জলদাস। এ বয়সেই ওরা জীবিকার চাকা ঘুরানোর কাজে নিয়োজিত।

মাছ ধরতে গিয়ে কমলা জলদাসের স্বামী কৃষ্ণ কুমার জলদাস, কানু চন্দ্র জলদাসের স্বামী নেপাল চন্দ্র জলদাস ছাড়াও অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন। ফলে ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে এ পরিবারগুলো দিন কাটাচ্ছে চরম সংকটে।

কোড়ালিয়া ও পশ্চিম জোড়খালী গ্রামের জলদাস সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের মধ্যে স্কুলে যাওয়ার হার বলতে গেলে শূন্য। অভিভাবকদের কাছে সংসারের আর্থিক অনটনের কারণে শিশুদের স্কুলে পাঠানোর চেয়ে কাজে পাঠানোর গুরুত্ব বেশি। পুরো এলাকায় সুনীল চন্দ্র জলদাসের ছেলে সুমন চন্দ্র জলদাস স্কুলে যায়।

স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে সে। এভাবে কালেভদ্রে দু-একজন ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে। কিছু অভিভাবক অন্য পেশায় জীবিকা খোঁজার প্রয়োজনীয়তা থেকে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠালেও আর্থিক অনটনে তা খুব বেশি দূর এগোতে পারে না।

জলদাস সম্প্রদায়ের সমস্যা ও সংকট সম্পর্কে বাংলানিউজ কথা বলেছে ঔপন্যাসিক হরিশংকর জলদাসের সঙ্গে। তিনি এ সম্প্রদায়ের এক পরিবারে জন্ম নিয়েও বহু সংগ্রামের ভেতর থেকে উঠে এসেছেন। বর্তমানে অধ্যাপনা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্প্রদায়ের নানাদিক তুলে ধরে দারিদ্র্যতাকেই প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখছেন তিনি।

জলদাসরাই আদি জেলে। একমাত্র মাছ ধরেই এদের জীবিকা চলে। নিত্যনৈমিত্তিক জলফসল তুলতে এরা জাল ফেলে সমুদ্র কিংবা নদীতে। এ সম্প্রদায়ের পিছিয়ে থাকার মূল কারণ দরিদ্র্যতা। এ কারণে লেখাপড়াও এগোচ্ছে না। এদেরকে উৎসাহিত করতে হবে। দিতে হবে প্রণোদনা। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর গুরুত্বটাও কমবেশি বোঝাতে হবে।

বাংলাদেশ সময় ০১৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১৪
সম্পাদনা: সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।