ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

নিঝুম দ্বীপ কার, বন বিভাগ নাকি স্থানীয় সরকারের?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩০৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০১৪
নিঝুম দ্বীপ কার, বন বিভাগ নাকি স্থানীয় সরকারের?

নিঝুমদ্বীপ, হাতিয়া, নোয়াখালী থেকে: স্বপ্নের নিঝুম দ্বীপ। নাম শুনলেই কল্পনায় ধরা দেয় স্বপ্নময় এক ভিন্ন জগত।

শুধু যোগাযোগ সংকটের কারণেই সমুদ্রের কোলে উত্তাল ঢেউয়ের ঝাপটায় জেগে থাকা এ দ্বীপটি মেলতে পারছে না ডানা। বন বিভাগ ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে বিরোধ দ্বীপের সম্ভাবনা বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বার বার।

দ্বীপকে ইউনিয়নে রূপান্তর করা হলেও বন বিভাগ বলছে, এখানে ইউনিয়ন কিংবা জনবসতি থাকলে জাতীয় উদ্যান ঘোষিত নিঝুম দ্বীপ হুমকির মুখে পড়বে। অন্যদিকে ইউনিয়ন পরিষদ বলছে, বসতি এলাকা বাদ রেখে বন ও সৈকত অঞ্চল নিয়ে জাতীয় উদ্যান কিংবা পর্যটন কেন্দ্র করা হোক।   
 


সরেজমিনে নিঝুম দ্বীপ ঘুরে দেখা গেছে, শীতকাল নিঝুম দ্বীপের সবচেয়ে জমজমাট মৌসুম হলেও এবার এ সময়ে এখানে পর্যটকের সংখ্যা নেমে এসেছে অর্ধেকে। হরতাল-অবরোধের কারণে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে স্বপ্নের এ দ্বীপে পৌঁছানো সম্ভব নয় অনেকের পক্ষেই। এখানকার হোটেল-বাংলো খালি পড়ে আছে। দোকানপাটে নেই বেচাকেনা। খেয়া নৌকায় নেই লোকের ভিড়। দেশের উত্তাল রাজনীতির ঢেউ লেগেছে নিঝুম দ্বীপেও।  

নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলা সদর ওছখালী থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে নিঝুম দ্বীপ। দ্বীপের তীর জুড়ে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে এখানকার প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। ভোরের সূর্যোদয়, সন্ধ্যার সূর্যাস্ত, মধ্যাহ্নে সমুদ্রের জলরাশিতে প্রখর রোদের ঝিলিক যেন দ্বীপের সৌন্দর্যে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে।
 
নিঝুম দ্বীপের বনের ভেতরে মায়াবী হরিণদলের ছোটাছুটি, দিগন্ত রেখায় মিশে যাওয়া ধূসর প্রকৃতি, সবুজ বাগানের বিরাট প্রাচীরের নয়নাভিরাম দৃশ্য দ্বীপের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দেয়। দ্বীপের ভেতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট্ট কুঁড়েঘর, মাঠে চাষির জোড়া গরুর হাল, দ্বীপের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা সরু সড়ক-খাল, সৈকতে শীতের পাখিদের ওড়াউড়ির দৃশ্যপটের বিশাল বিশাল ক্যানভাস যেন শিল্পীর ফ্রেমবন্দি।

এরই মধ্যে যেন শিল্পীর তুলির আঁচড়ে এ দ্বীপে দিগন্তজোড়া মাঠে রাখালের গরু চরানো, মাঝিদের গুনটানা নৌকা, বনের ভেতরে বন্যপ্রাণীর দাপিয়ে বেড়ানোর দৃশ্য ফুটে উঠেছে।

বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে নিঝুম দ্বীপের নানা সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন স্থানীয় লোকজন। সেইসঙ্গে জানান সমস্যার কথা। তারা মনে করেন, এখানকার অপরূপ সৌন্দর্যের কথা এখন আর কাউকে বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এখন শুধু আসার পথের বাধা দূর করতে হবে। নোয়াখালী সদর থেকে এখানে আসতে দীর্ঘ নদীপথ পাড়ি দিতে হয়। এরপর আছে আরও দীর্ঘ দুর্গম সড়ক পথ। কেউ এখানে আসতে চাইলেও অনেক সময় নিয়ে, অনেক বড় প্রস্তুতি নিয়ে আসতে হয়।

বন বিভাগ আর ইউনিয়ন পরিষদের রশি টানাটানিতে বিভ্রান্ত নিঝুম দ্বীপের বাসিন্দারা। গোটা নিঝুম দ্বীপকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে এটিকে পর্যটকদের আকর্ষণে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালে জাহাজমারা ইউনিয়নের আওতাভুক্ত ওয়ার্ড নিঝুম দ্বীপকে ইউনিয়নে রূপান্তর করা হয়। ৮১ বর্গ কিলোমিটারের এই এলাকাটিতে লোক সংখ্যা ৫৭ হাজারG আর ভোটার ১২ হাজার। রূপান্তরের পর প্রথম নির্বাচিত পরিষদ এ ইউনিয়ন পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে।

নিঝুম দ্বীপকে ইউনিয়ন করা হলেও বন বিভাগ এর বিরোধিতা করছে। নিঝুম দ্বীপের দায়িত্বে থাকা বন বিভাগের জাহাজমারা রেঞ্জের বন কর্মকর্তা জাবের হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, জাতীয় উদ্যান নিঝুম দ্বীপে ইউনিয়ন হওয়ার কথা ছিল না। বন বিভাগের অজান্তে এটা করা হয়েছে। নিঝুম দ্বীপকে রক্ষা করতে হলে এবং এখানকার বন ও বন্যপ্রাণী বাঁচাতে হলে নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন বাতিল করতে হবে।

নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহরাজউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, বন বিভাগ নিঝুম দ্বীপকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণার আগেই জনগণের প্রয়োজনে এটিকে ইউনিয়ন ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে প্রায় ৫৭ হাজার মানুষের বসবাস। তাদের কাছে সরকারের সেবা পৌঁছাতে এখানে ইউনিয়ন পরিষদের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। জাতীয় উদ্যান রক্ষায় আমাদের আপত্তি নেই। ইউনিয়নের লোক বসতির জায়গাটুকু বাদ রেখে বন ও সৈকত এলাকাকে পর্যটন কিংবা জাতীয় উদ্যান হিসেবে রাখা যেতে পারে। আমরা চাই বন্দোবস্ত পাওয়া মানুষরা যেন নিরাপদে বসবাস করতে পারে।

এদিকে নিঝুম দ্বীপে ইউনিয়ন পরিষদ ও বন বিভাগের দ্বৈত শাসনের ফলে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদ চাইছে বন্দোবস্ত পাওয়া লোকদের জমির দখল, আর বন বিভাগ বলছে জাতীয় উদ্যানে কোনো বসতি স্থাপন করা যাবে না। এতে দুই বিভাগের চাপে পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

বন বিভাগ সূত্র বলছে, নিঝুম দ্বীপকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়েছে ২০০১ সালে। জাতীয় উদ্যানের আওতায় রয়েছে চর কালাম, জাহাজমারার একাংশ, টমার চর, চর কবিরা, চর ওসমান, চর কমলা, চর নিউ বালুয়া, চর রওশন, চর ইউনুসসহ ১৩টি চর। উদ্যানে বনায়ন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণসহ অন্য কার্যক্রম রয়েছে বন বিভাগের। নিঝুম দ্বীপের সব বন মিলিয়ে প্রায় ৪৫ হাজার হরিণ রয়েছে।

জানা গেছে, জাতীয় উদ্যানের আওতায় ২০১০-১১ সাল থেকে দ্বীপের নতুন জেগে ওঠা প্রায় ১৭শ হেক্টর চরে বনায়নের কাজ চলছে ইউএনডিপির সহায়তায়। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় দ্বীপে টাওয়ারসহ বেশকিছু স্থাপনা ও দ্বীপে যাতায়াতের সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

তবে নানাম‍ুখী সংকটের কারণে নিঝুম দ্বীপ এখনও ভ্রমণ পিপাসুদের স্বপ্নের কাছেই থাকছে। কারণ চাইলেই সেখানে যাওয়া সম্ভব হয় না। নদীপথ, সড়ক পথ আর দুর্গম রাস্তা পেরিয়ে তবেই পৌঁছানো যায় এই দ্বীপে। সড়ক কিংবা নৌ কোনো পথেই নেই সরাসরি যোগাযোগ। অথচ নিঝুম দ্বীপের সম্ভাবনা বিকশিত করার মধ্যদিয়ে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয়ের পথ বের হতে পারে।

কর্মসংস্থানের সুযোগ হতে পারে বহু মানুষের। দ্বীপের উন্নয়নের ছোঁয়ায় আলোকিত হতে পারে আশপাশের এলাকা।

বাংলাদেশ সময়: ০২৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৭, ২০১৩
আরআইএম/সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।