মৌলভীবাজার থেকে: মদনটাক। পাখিটির নাম পরিচিত আমাদের সবার।
মদনটাক নিয়ে কথা হয় দেশের বরেণ্য পাখি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হকের সঙ্গে।
তিনি বলেন, বড় মদনটাক পাখিটি আমার জীবদ্দশাতেই চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আগামী ৫ বছরের মধ্যে আমাদের দেশ থেকে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাবে ছোট মদনটাকও। প্রাকৃতিক বনাঞ্চল উজাড় করে আমরা মূল্যবান প্রাণিসম্পদ এভাবেই বিলুপ্ত হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছি। বড় গাছ সংরক্ষণ, শিকার না বন্ধ করা এবং বিশেষ উদ্যোগ না নিলে এই পাখিটিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
ইনাম আল হক বলেন, ছোট মদনটাক বাংলাদেশের মহাবিপন্ন পাখি। সারা পৃথিবীতে এটি ‘বিপন্ন’ তালিকভুক্ত। নিয়মিতভাবে সুন্দরবনেই এদের দেখা মেলে। সুন্দরবন ছাড়াও উপকূলীয় প্যারাবনে তাদের বসতি রয়েছে। মৌলভীবাজারের চা বাগানগুলোতে মাঝে মাঝে এদের দেখা যায়। বিপন্ন প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছে দু’একটা। মৌলভীবাজারের চা বাগানগুলো দু’একটা হয়তো এখনো টিকে আছে। হঠাৎ এদের দেখা যায়।
তিনি বলেন, যেহেতু সুন্দরবন এলাকাটা বড়, তাই অনেক বড় পাখি ওখানে টিকে আছে। বড় পাখি বাস করার জন্য বড় এলাকার প্রয়োজন। বাসস্থান ও আহার বড় পাখিদের প্রধান চাহিদা। এগুলো সুন্দরবনে আছে বলেই যেখানে তারা এখনো টিকে আছে।
ইনাম আল হক আরও বলেন, ছোট মদনটাক আমাদের দেশের বড় পাখিদের একটি। উচ্চতায় বেশ বড়সড়। যেহেতু সে বড় পাখি তাই এদের খাবারও বেশি লাগে। আবার তারা খুব ভালো শিকারি নয়। খুব দ্রুত যে প্রাণীগুলো বিরচণ করে তাদের ধরে সে খেতে পারে না। সে খেতে পারে না জীবন্ত মাছ ধরে। মরা মাছ বা মরে পানিতে ভেসে ওঠা মাছটি খায়। মরা, দুর্বল প্রাণী ধরতে পারে। মরা, পচা, অসুস্থ বা পরিত্যক্ত প্রাণীগুলো খেয়েই বেঁচে থাকে সে। শামুক-ঝিনুক ভেঙে খেতে পারে। অন্য শিকারি পাখির মতো ক্ষিপ্রতা নেই ওর। ওরা ধীর গতিতে চলা পাখি।
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘পৃথিবীতে ৩ প্রজাতির মদনটাকের মধ্যে আমাদের দেশে ২ প্রজাতির মদনটাক ছিল। এরমধ্যে বড় মদনটাক পাখিটি পুরোপুটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আমাদের দেশে ছোট মদনটাকের সংখ্যাও একেবারে কমে এসেছে। আমার অনুমান একশোর বেশি নেই বাংলাদেশে। বিশ্বের বিপন্ন এ পাখিটিকে রক্ষা করা বাংলাদেশের মানুষের দায়িত্ব। খারাপ অবস্থায় চলে যাওয়া এ পাখিটিকে রক্ষা করতে হলে সরকারি-বেসরকারিভাবে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে একে টিকিয়ে রাখতে হবে।
বনপ্রাণী আলোকচিত্রী ফিরোজ আল সাবাহ্ মদনটাকের ছবি সম্পর্কে বলেন, এই মদনটাকের ছবিগুলো আমি কিছুদিন আগে অর্থাৎ, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৩ পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারি উপজেলা থেকে তুলেছি। আমার ছোটভাই একটি ব্যতিক্রমী পাখি দেখার কথা বললে আমার ঘুম ভেঙে যায়। ক্যামেরা নিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে একটা বড় পুকুর পাড়ে শিমুল গাছের উপর এই মদনটাকের দেখা পাই। দেখলাম গাছের ডালে বসে থাকতে এক ঝাঁক কাক এসে তাকে বারবার বিরক্ত করছে। এলাকার মানুষজন অবাক হয়ে দেখছিল এই বড় পাখিটি। এতো বড় পাখি জীবনের নাকি দেখেনি -এমন কথা কেউ কেউ বলেছিলেন আমাকে।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব সূত্র জানায়, মদনটাক বৃহৎ ঠোঁটের জলচর পাখি। এর ইংরেজি নাম Lesser Adjutant এবং বৈজ্ঞানিক নাম Leptoptilos javanicus। এদের দৈর্ঘ্য ১১০ সেমি. ও ওজন ৫ কেজি। মদনটাকের পিঠের দিক ঘন কালো। দেহের নিচের দিক সাদা। মুখের চামড়া ও ঘাড় লালচে। পা লম্বা। মাথা ন্যাড়া। এরা জলমগ্ন মাঠ, খাল, জলময় বন, প্যারাবন ও মোহনায় একা বা জোড়ায় বিচরণ করে। অগভীর পানিতে ধীরে হেঁটে এরা খাবার খায়। খাদ্য তালিকায় রয়েছে মাছ, শামুক, ঝিনুক, ব্যাঙ, সাপ, ইঁদুর, টিকটিকি, চিংড়ি জাতীয় প্রাণী ও পশুর মৃতদেহ। নভেম্বর-জানুয়ারি এদের প্রজনন মাস। বড় গাছে ডালপালা দিয়ে বাসা বানায়। ২ থেকে ৫টি ডিম পাড়ে। ৩০ থেকে ৩৫ দিন পর ডিম ফুটে ছানা বের হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৪, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর