ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

উত্তাল সমুদ্রে ভাসা ট্রলার, কারিগরের নিজস্ব জ্ঞানে নির্মাণ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৫৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৪, ২০১৪
উত্তাল সমুদ্রে ভাসা ট্রলার, কারিগরের নিজস্ব জ্ঞানে নির্মাণ

Rofiqul-sm2Rofiqul-sm2নোয়াখালী থেকে: হাতুরির শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে লোকালয়ে। হাতুরির আঘাতে শক্ত কাঠ ভেদ করে ঢুকছে পেরেক।

কেউ কাঠ সমান করছেন, কেউ তেল মাখাচ্ছেন, কেউবা লাগাচ্ছেন রং। কাজ চলছে রাতদিন। এভাবে আড়াই থেকে তিন মাসের মধ্যে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য এক একটি ট্রলার প্রস্তুত হচ্ছে।

হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়নের কাটাখালী খালের পাড়ে এমন দৃশ্য থাকে বছরের প্রায় ছ’মাস। চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থান থেকে কাঠ আসে, জড়ো হয় শ্রমিক, একের পর এক তৈরি হয় ট্রলার। বছরের পর বছর এমন হাজারো ট্রলার উত্তাল সমুদ্রে যাত্রা করে। ব্যবহৃত হয় মাছধরা, খেয়া পারপার, মালামাল বহনসহ বিভিন্ন কাজে।
IMG_bg201
অথচ উপকূল অঞ্চলের জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ যানটি তৈরি হয় কারিগরদের নিজস্ব জ্ঞানে। ট্রলার উচ্চতা, গভীরতা, দৈর্ঘ্য কিংবা প্রস্থের পরিমাপ ঠিক করেন তারাই। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই তাদের। ৬ থেকে ৭ বছর কাজ করতে করতে হাত পাকিয়ে একেকজন হয়ে উঠেন দক্ষ কারিগর। তবে উন্নতমানের ট্রলার তৈরিতে তারা এখন আধুনিক জ্ঞান চান।

ট্রলারের কারিগর মিরাজ মিস্ত্রি বাংলানিউজকে বলেন, যুগ যুগ ধরে এভাবেই তৈরি হচ্ছে সমুদ্রে চলাচলকারী ট্রলারগুলো। সব মিস্ত্রিরাই এক সময় শ্রমিক হিসাবে কাজ করতেন। মিস্ত্রিরাই ঠিক করে দেন ট্রলারের মাপ কেমন হবে, ডিজাইন কী হবে? তবে আমাদের এই জ্ঞানের সঙ্গে আধুনিক জ্ঞানের সমন্বয় করতে পারলে ট্রলারগুলো হয়তো আরও বেশি ঝড়-ঝঞ্ঝা সহনশীল হতে পারে।
IMG_120
জাহাজমারা ইউনিয়নের কাটাখালীতে সংরক্ষিত বন লাগোয়া একটি খালের পাড়ে সারিবদ্ধভাবে ট্রলার নির্মাণের দৃশ্য চোখে পড়ে। কোনোটির কাজ প্রায় শেষ, কোনোটির কাজ কেবল শুরু, আবার কোনোটি নির্মাণের জন্য কেবল কাঠ এসে পৌঁছেছে। শ্রমিকদের ব্যস্ততা সারাক্ষণ। কথা বলারই সুযোগ নেই তাদের। নির্মাণ কাজের পাশেই দূর-দূরান্ত থেকে আসা শ্রমিকদের থাকার জায়গা বানানো হয়েছে। স্থানীয় শ্রমিকেরাও এখানেই থাকেন।

ট্রলার নির্মাণ কারিগরেরা জানান, ট্রলার তৈরিতে সবচেয়ে ভালো কাঠ জারুল, লোহা, গর্জন, গুডগুইড্ডা। তবে মেহগিনি, আকাশমনি, চাম্বল কাঠও ব্যবহৃত হয়। এ কাঠের বেশিরভাগ চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে জন্মে। সেখান থেকেই সরাসরি কাঠ এখানে আনা হয়।

ট্রলারের মাস্তুল স্থানীয় ভাষায় ‘রথ’ নামে পরিচিতি। ট্রলারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ এটি। এ রথ তৈরির কাজটাই কঠিন। শুধু রথ নির্মাণে ব্যবহৃত কাঠের দাম এক লাখ টাকা।

নতুন কাঠ দিয়ে একেকটি ট্রলার তৈরিতে সব মিলিয়ে খরচ পড়ে প্রায় ৩০-৩৫ লাখ টাকা। জাহাজমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম সিরাজুল ইসলাম একটি ট্রলার তৈরিতে হাত দিয়েছেন। তিনি বাংলানিউজকে জানান, একটি নতুন ট্রলার তৈরিতে কাঠের মূল্য ও মজুরি মিলিয়ে খরচ পড়ে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা। ভালো কাঠ দিয়ে ট্রলার তৈরি করা হলে ১০-১৫ বছর নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে।
IMG_22
সংশ্লিষ্টরা জানালেন, ট্রলার নির্মাণ প্রক্রিয়া চুক্তিভিত্তিক। মালিকের সঙ্গে চুক্তি হয় ট্রলারের কারিগর বা মিস্ত্রির। কাঠসহ প্রয়োজনীয় সব মালামাল সরবরাহ করবেন মালিক আর মিস্ত্রি তার শ্রমিক দল নিয়ে ট্রলারের কাজ সম্পন্ন করে দেবেন। একটি ট্রলার তৈরিতে মজুরি দিতে হয় আড়াই লাখ টাকা। কেউ আটজন, কেউ দশজন আবার কেউ ছয়জন শ্রমিক নিয়ে আড়াই থেকে তিন মাসের মধ্যে ট্রলারের কাজ সম্পন্ন করেন। দক্ষতা ভেদে শ্রমিকেরা দৈনিক মজুরি পান ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। প্রতিদিন ট্রলার নির্মাণের কাজ চলে ৮-১০ ঘণ্টা।

আরেক ট্রলার মালিক মেরাজ উদ্দিনের নির্মাণাধীন ট্রলারের রথ (মাস্তুল) উঠে গেছে, চান্দার (পেছনের দেয়াল) কাজ শেষ হয়েছে। ট্রলারের নিচের বাঁকা অংশও অনেকটাই বেঁকে উঠেছে। দ্রুত চলছে নির্মাণ কাজ। এই নির্মাণে যোগ দিয়েছেন ছয়জন শ্রমিক।

জাহাজমারা ইউনিয়নের আমতলী গ্রামের শ্রমিক মো. ইউসুফ জানালেন, দৈনিক মজুরি পান ৪০০ টাকা।
IMG_42
কারিগরেরা জানান, এই এলাকায় তৈরি বড় সাইজের ট্রলারের উচ্চতা ৭ ফুট, দৈর্ঘ্য ৫০ ফুট আর প্রশস্থ ১২ ফুট। এইসব ট্রলার পানির নিচে থাকে দেড় থেকে দুই ফুট। এই মাপ কোনো বইপত্রে লেখা নেই। একেবারেই কারিগরদের নিজস্ব জ্ঞান।  

ট্রলারের দক্ষ কারিগর মিরাজ মিস্ত্রি। বাড়ি জাহাজমারা ইউনিয়নে। চট্টগ্রামে এক নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে সাত বছর ট্রলার নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করে এখন মিস্ত্রি। ৩০ বছরে ট্রলার নির্মাণ করেছেন ১৫০টি। পাঠ্য বইয়ের কোনো কারিগরি জ্ঞান নেই। সই করতে জানেন মাত্র। তবে ট্রলার নির্মাণে পাকা। চলতি মৌসুমে আটটি ট্রলার তৈরির কাজ পেয়েছেন। এগুলো তৈরিতে প্রায় ৫০ জন শ্রমিক কাজ করছেন।  

বাংলাদেশ সময়: ০১৪৩ ঘণ্টা, ০৪ জানুয়ারি ২০১৪
সম্পাদনা: শরিফুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।