ঢাকা, রবিবার, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ মে ২০২৪, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

জলদস্যুর দৌরাত্ম্য, আতঙ্কে কর্মহীন জেলেরা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০১৪
জলদস্যুর দৌরাত্ম্য, আতঙ্কে কর্মহীন জেলেরা

Rafiqulকালিরচর (বুড়িরচর), হাতিয়া, নোয়াখালী থেকে: নোয়াখালীর হাতিয়া উপকূলে জলদস্যুদের দাপট কমেনি, বার বার অভিযানের পর দস্যুতার ধরন বদলেছে মাত্র। এখনো প্রকাশ্য দিবালোকে সমুদ্রে জেলেদের মাছধরা ট্রলার আটকে আদায় করা হচ্ছে মুক্তিপণ।



অভিযানের পর এখন জলদস্যুদের সুনির্দিষ্ট কোনো আস্তানা নেই। আটক জেলেদের আটকে রাখা হয় সমুদ্রে ভাসমান ট্রলারে। মাছ ধরতে আগের মতোই অর্থের বিনিময়ে টোকেন নিতে হয়। তবে সেই টোকেনে ভরসা নেই। এক গ্রুপ টোকেন দিলে আরেক গ্রুপ নতুন করে টোকেন নিতে বাধ্য করে। ফলে জেলেরা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

জলদস্যুদের আক্রমণে প্রতিনিয়ত আতঙ্কে থাকা হাতিয়ার বুড়িরচর, কালিরচর, বুড়িরদোনা, আলাদিগ্রাম, জাহাজমারা, নিঝুমদ্বীপ, সুখচর সরেজমিনে ঘুরে এসব তথ্য মিলেছে।



জেলেদের অভিযোগ, জলদস্যু দমনে বারবার অভিযান চালানো হলেও জেলেদের আতঙ্ক কাটেনি। অভিযানের পর কদিন কিছুটা শান্ত থাকলেও পরে অল্পদিনের মধ্যেই তাদের তৎপরতা বেড়ে যায়।

হাতিয়া সদর ওছখালী থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে বুড়িরচর ইউনিয়নের কালিরচর গ্রাম। এ গ্রামেই আছে বুড়িরদোনা ঘাট। সরেজমিনে এ ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, বহু মাছধরা ট্রলার ঘাটে বাধা। বহু জেলে আশপাশের দোকানপাটে কর্মহীন দিন কাটাচ্ছে।

সরাসরি আলাপে জানা গেল, কেউ এক সপ্তাহ, কেউ পনেরো দিন আবার কেউ এক মাস ধরে মাছ ধরতে যাচ্ছে না। এসব জেলে পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম সংকটে দিন কাটাচ্ছেন।

বুড়িরদোনা ঘাটের পাশের এক দোকানে জলদস্যুদের নির্যাতনের শিকার জেলেদের সঙ্গে আলাপকালে এগিয়ে আসেন নাজেম মাঝি।

আঞ্চলিক ভাষায় এক নিঃশ্বাসে অভিযোগের সুরে বলতে থাকেন, ওই ব্যাটার বেতন আটকিছে। আমনের কোনো জায়গায় বেতন আটকিছে। এখন বেতন ছুটাইতে আইছেন। আমাগো কতা লিখা লাগবে না। আনেকে তো লিখলো। কি অইলো। আমরা তো সব হারইলাম। সাগরে যাইতে পারি না। কী কইরা খামু?

ভিড়ে জড়ো হওয়া জেলেরা বললেন, নাজেম মাঝি জলদস্যুদের আক্রমণে সব হারিয়ে এখন পাগলপ্রায়। মাথা ঠিক নাই। নাজেম মাঝির মাথা ঠিক থাকুক বা না থাকুক, তার কথা থেকেই জলদস্যুদের আক্রমণে জেলেদের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা মেলে।

জেলেরা জানান, জলদস্যুদের দমনে অভিযান চালানোর পর কিছু দিন শান্ত থাকলেও আবারও তাদের অত্যাচার বেড়েছে। এখন তারা কৌশল বদলেছে। আগে জলদস্যুদের আস্তানা ছিল। এখন তারা ট্রলারে অভিযান চালিয়ে আটক জেলেদের ট্রলারেই আটকে রাখে।

আগে এক বাহিনীর প্রধানের সই করা টোকেন দিয়ে পুরো মৌসুম মাছ ধরা যেত। এখন এক গ্রুপের কাছ থেকে টোকেন নিলে আরেক গ্রুপ আবার টোকেন নিতে বাধ্য করে।

এলাকার সূত্রগুলো বলছে, মাছ ধরার দু মৌসুমেই জলদস্যুদের চাঁদা দিতে হচ্ছে। এ জন্য দু’বার টোকেন নিতে হয়। ইলিশ মৌসুমে টোকেনের মূল্য ১০ হাজার ২০০ টাকা। চিংড়ি মৌসুমে টোকেনের মূল্য ১৫ হাজার ২০০ টাকা। একজন জেলেকে ধরে নেওয়া হলে মুক্তিপণ হিসেবে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা এবং ট্রলার আটক করলে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা দিতে হয়।

স্থানীয়রা বাংলানিউজকে জানান, কালিরচর, আলাদিগ্রাম, বুড়িরদোনাসহ আশপাশের এলাকায় এক সময় দিনের বেলায়ও হাঁটাচলা করা সম্ভব ছিল না। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই এলাকায় নেমে আসতো নীরবতা। কেউ টু শব্দটি করার সাহস পেতো না। সাগরে মাছধরা ট্রলারে ডাকাতি ছাড়াও তারা উঠে আসতো লোকালয়ে। বাড়ির মালামাল লুণ্ঠন ছাড়াও লোকজন ধরে নিয়ে যেতো। মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তি পেতো তারা।

কালিরচরে তথ্য সংগ্রহে এ এলাকার জেলেদের কাছে খবর আগে জলদস্যুরা চারটি ট্রলার আটক করেছে। মুক্তিপণের টাকা বিকাশে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য তারা আটক জেলেদের স্বজনদের কাছে খবর পাঠায়। জেলেরা বলেন, জলদস্যুদের কাছ থেকে প্রায় প্রতিদিনই এমন খবর আসে। আমরা অসহায়। আমরা কারো কাছে অভিযোগ জানাতে পারি না।

জানা গেছে, এ এলাকার বঙ্গোপসাগর লাগোয়া রহমতঘাট, টানবাজার, বুড়িরদোনাঘাট, কাদিরাঘাট, জঙ্গলিয়াঘাট, কালামচর এলাকার জেলেরা প্রতিনিয়ত দস্যুদের আক্রমণের শিকার। এসব ঘাটের মাধ্যমে সাগরে মাছ ধরতে যায় বুড়িরচর, জাহাজমারা, সোনাদিয়া, চর ঈশ্বর, নলচিরা, তমরুদ্দি ও নিঝুমদ্বীপের জেলেরা। এ ছাড়াও হাতিয়ার অন্তত ৮০ শতাংশ জেলে কোনো না কোনোভাবে জলদস্যুদের আক্রমণে নির্যাতিত।

সুখচর ইউনিয়নের হরিণ বাজার, নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের বন্দরটিলা, বুড়িরচর ইউনিয়নের কালিরচর, যেখানেই যাওয়া হয়েছে, লোকের মুখে মুখে একই অভিযোগ।

এ এলাকায় অন্তত ৯০ ভাগ মানুষ মাছধরা পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় জলদস্যুদের আক্রমণই তাদের কাছে প্রধান সমস্যা হিসেবে বিবেচিত।

নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেহরাজ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, এ এলাকায় জলদস্যুদের অত্যাচারে জেলেরা মাছ ধরতে যেতে পারে না। একবার একজন জেলে ধরে নিয়ে গেলে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিতে হয়। এভাবে জেলেরা নিঃস্ব হচ্ছে। এখানে একটি পুশিল ফাঁড়ি থাকলেও তারা সাগরে অভিযান চালাতে পারছে না।

নিঝুমদ্বীপের আটিপাড়া গ্রামে হাঁটতে গিয়ে দেখা হয় বেশ কজন সব হারানো জেলের সঙ্গে। এদের কেউ কেউ জলদস্যুদের নির্যাতনে শুধু সর্বস্ব হারায়নি, শারীরিকভাবেও অক্ষম হয়ে পড়েছে। এ কারণে দস্যুদের বিরুদ্ধে বলতে সাহস পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। এদের ধারণা নাম কিংবা ছবি প্রকাশিত হলে এরা আবারও জলদস্যুদের আক্রমণের শিকার হবে।

বুড়িরচর ইউনিয়নের নয় নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নিজাম উদ্দিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, জলদস্যুদের অত্যাচারে এ এলাকার বহু জেলে নিঃস্ব হয়ে গেছে। সাগরে মাছ ধরে এক সময় বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে পারলেও এখন তাদের চরম দুর্দিন। অভিযান চালানো হলেও দস্যুদের অপতৎপরতা থেমে থাকে না।

হাতিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ সৈয়দ মো. ফজলে রাব্বী বাংলানিউজকে বলেন, নৌযানের অভাবে সাগরে নিয়মিত অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। সাগরে কোস্টগার্ড অভিযান চালায়। তবে এ এলাকার শীর্ষ দস্যুদের নির্ম‍ূল করা হয়েছে। বাকিরাও পর্যায়ক্রমে ধরা পড়বে।

বাংলাদেশ সময়: ০২৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০২, ২০১৪
সম্পাদনা: সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর ও মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।