ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

গাছখেকোরা কি দেশপ্রেমিক?

নূসরাত খান, এনভায়রনমেন্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০১৪
গাছখেকোরা কি দেশপ্রেমিক? ছবি:বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: পুরো ২০১৩ সাল কেটেছে রাজনৈতিক অস্থিরতায়। বছরজুড়ে ছিল হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি।

এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়েও ছিল উত্তেজনা। এরই মধ্যে ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে গাছ কাটার মহোৎসব চালায় হেফাজত। সে সময় থেকে তাদের নাম হয়ে যায় ‘গাছ খেকো হেফাজত’।

বিএনপি-জামায়াতও কম যায়নি। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় ও হরতাল-অবরোধ কেন্দ্র করে সারা দেশে কাটা পড়ে কয়েক হাজার গাছ। এই গাছ কাটার মহোৎসব চলছে এখনো।

এতে ধ্বংস হচ্ছে দেশের প্রাণ, সবুজ। দিনে দিনে কমছে আমাদের নিঃশ্বাসের নির্মল উৎস। হরতাল-অবরোধের নামে হাজার হাজার মূল্যবান গাছ কেটে কলঙ্কিত করছে সবুজ শ্যামল বাংলাকে।

৫ মে অত্যাধুনিক যন্ত্রচালিত করাত দিয়ে ঢাকা শহরের সড়কদ্বীপের গাছ কেটে তাণ্ডব চালায় হেফাজত।

অবরোধে রাস্তায় যান চলাচলে বাধা সৃষ্টি করতে বিএনপি-জামায়াতগোষ্ঠী নির্বিচারে রাস্তার দু’পাশের বড় বড় গাছ কেটে ফেলে রাখে। পরবর্তীতে গাছগুলো লুট করে নিয়ে যায় স্বার্থান্বেষী মহল।

এ ধরনের পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যকলাপের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুরো দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ। ক্রমাগত তাণ্ডবে কাটা পড়েছে বাবলা, শিশু, মেহগনি, তাল, রেইনট্রি, শিল কড়ই, আম, কাঁঠাল, ইপিলইপিলসহ বহু ইউক্যালিপ্টাস গাছ। যার বেশিরভাগই বিশ-ত্রিশ বছরের পুরোনো।

কিছু শতবর্ষী গাছও এ সহিংসতায় কাটা পড়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এই ক্ষতি শুধু অর্থ দিয়ে প্রকাশ করা হলেও এ শুধু লুটপাট হওয়া কাঠের ক্ষতি তা কিন্তু নয়। গাছগুলোর উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা পাখ-পাখালির আবাসও হুমকির মুখে।

কেটে ফেলা গাছগুলো মূলত বনবিভাগ, জেলা পরিষদ, সড়ক ও জনপথ বিভাগসহ স্থানীয় এনজিও এবং জনগণের।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) একটি জরিপ শেষে গত ২৬ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনে জানায়, সারাদেশে গত মার্চ মাস থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৫৭ হাজার ৯টি গাছ নিধন করা হয়েছে, যার অর্থমূল্য প্রায় ৩৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা।

এর মধ্যে সাতক্ষীরায় কাটা পড়েছে ৮ হাজারের বেশি গাছ, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা। রংপুরে কেটেছে ১ হাজার গাছ, যার আর্থিক মূল্য ৫০ লাখেরও বেশি টাকা।

গাইবান্ধায় কাটা পাঁচশ’ গাছের অর্থমূল্য ২৫ লাখ টাকা। এছাড়া, দিনাজপুরে এক হাজার গাছ কাটা পড়ায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৫০ লাখ টাকা। ঠাকুরগাঁও জেলায় পাঁচশ’ গাছ, জয়পুরহাটে তিনশ’ গাছ, বগুড়ায় কাটা পড়া দুই হাজার গাছের মূল্য প্রায় ১ কোটি টাকা।

মেহেরপুরে ৫শ’টি গাছ কাটা পড়ায় আর্থিক ক্ষতি ২৫ লাখ টাকা। নীলফামারীতে ৩শ’টি গাছের মূল্য ১৫ লাখ টাকা। চট্টগ্রামে ৪ হাজার ৫শ’টি গাছ কাটা পড়ায় ক্ষতি হয়েছে ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। কক্সবাজারে কাটা পড়েছে ৩ হাজার গাছ। যার আর্থিক মূল্য ৫ কোটি টাকারও বেশি। লক্ষ্মীপুরে ৮ হাজার গাছের আর্থিক ক্ষতি ৪ কোটি টাকা। চাঁদপুরে ৮ হাজার গাছ- ৪কোটি টাকা, পাবনায় ১৫শ’ গাছ-৭৫ লাখ টাকা, নোয়াখালীতে ১০ হাজার গাছ- ৫ কোটি টাকা, যশোরে ৫ হাজার গাছ- ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা, পিরোজপুরে ৩ হাজার গাছ দেড় কোটি টাকা, চুয়াডাঙ্গায় পাঁচশ’ গাছ ২৫ লাখ টাকা।
 
তবে, গত দু’মাসে সাতক্ষীরায় গাছ নিধনের এই বিধ্বংসী যজ্ঞের কথা সরেজমিনে বাংলানিউজ প্রতিনিধি শেখ তানজির আহমেদ জানান, বনবিভাগ নিয়ন্ত্রণাধীন ১২০০ কিলোমিটার রাস্তায় দু’ধারে প্রায় তিনশ’ গাছ কেটেছে অবরোধকারীরা। জেলা পরিষদের গাছ ছিল ১ হাজার, যার ক্ষয়ক্ষতির মূল্য প্রায় ২০ লাখ টাকার বেশি।

এ ব্যাপারে ১৬টি মামলা দায়ের করেছে জেলা পরিষদ। সড়ক ও জনপথ বিভাগের একশ’র মতো গাছ কেটেছে হরতাল-অবরোধ সমর্থকরা। যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫ লাখ টাকা। আর এসব গাছ কেটেছে অবরোধ সমর্থিত এলাকাবাসী।

অপরদিকে, যশোরের প্রতিনিধি মিলন রহমান জানান, বিভিন্ন সড়ক মহাসড়কের প্রায় ৩ হাজার গাছ কাটা হয়েছে। এতে প্রায় ২ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে যশোর জেলা পরিষদ বিভিন্ন সড়কে তাদের যে গাছ কাটা পড়েছে তার একটি খতিয়ান তৈরি করেছে। এ খতিয়ান অনুযায়ী, জেলায় তাদের ৩৭৬টি গাছ কাটা পড়েছে। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩১ লাখ ১ হাজার টাকা।

একই ভাবে, বগুড়ার প্রতিনিধি টিএম মামুন জানান, বগুড়ায় বন বিভাগের বগুড়ার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. সুনীল কুমার কুণ্ডু বন বিভাগের প্রায় ৬০৪টি গাছ কাটা পড়েছে বলে জানান। যার আর্থিক মূল্য ১০ লাখ টাকা।

সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, এ বিভাগের আওতায় থাকা প্রায় ৮১৪টি গাছ কাটা পড়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। যার অর্থমূল্য ২৮ লাখ ৪৯ হাজার টাকা।

একই সঙ্গে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির (এলজিইডি) গাছ কাটা হয়েছে ৯০টি, যার মূল্য ৪৫ হাজার টাকা।

রাস্তার দু’পাশের এই গাছগুলো শুধু যে রাস্তা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন তা নয়। শব্দ দূষণ এড়ানো ও রাস্তাকে ছায়া নিবিড় করে রাখতেও এসব গাছ বিশেষ প্রয়োজন।

এছাড়া, গাছ কাটার ফলে পরাগায়ণে সহায়তাকারী কীট-পতঙ্গ প্রাকৃতিকভাবে ভারসাম্যহীন অবস্থার মধ্যে পড়বে। যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা। পরবর্তীতে কৃষি উৎপাদনেও এর প্রভাব দেখা যাবে। কিছু বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির পাখি, কীট-পতঙ্গ আর কখনই ফিরে আসবে না বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন উদ্ভিদ গবেষক মোকারম হোসেন।

তিনি বলেন, মূলত যে গাছগুলো কাটা পড়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে দেশীয় গাছ, ওষুধি গাছসহ অনেক ফলজ গাছ। এসব গাছকে কোনকিছু দিয়েই প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়।

তবে এসব গাছের পরিবর্তে যদি ইউক্যালিপ্টাস ও অ্যাকাসিয়ার মতো গাছ নির্বাচন করা হয়, তবে তা কোনভাবেই পরিবেশের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে না। যদিও এধরনের গাছগুলো দ্রুত বাড়ে। কিন্তু, তার পরিবেশগত বিরূপ প্রভাব ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।

সম্প্রতি, আমাদের দেশে এধরনের বিদেশি গাছ বেশ জনপ্রিয় করে তুলছেন বন অধিদপ্তর। কিন্তু, যে গাছগুলো কাটা পড়ল, তার ক্ষতি দেশি প্রজাতির গাছ দিয়েই পূরণ করা সম্ভব। আর গাছ রোপণের পর এসব উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতিতেও যেন গাছগুলো পরবর্তীতে রক্ষা পায়, তার যথাযথ প্রচারণা কার্যক্রম চালানোর দায়িত্ব নিতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে।

প্রচুর গাছ কাটা পড়েছে যশোর-খুলনা মহাসড়ক, যশোর বেনাপোল মহাসড়ক, যশোর-মাগুরা মহাসড়ক, মণিরামপুর-রাজগঞ্জ সড়ক, রাজারহাট চুকনগর সড়ক, মণিরামপুরের বিভিন্ন সংযোগ সড়ক, যশোর-বাঘারপাড়া সড়ক, চুড়ামনকাটি-চৌগাছা সড়ক থেকে।

তাদের তথ্য অনুযায়ী, যশোরে ৫ হাজার গাছ কেটে আড়াই কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি করা হয়েছে। তবে যশোর জেলা পরিষদ বিভিন্ন সড়কে তাদের যে গাছ কাটা পড়েছে তার একটি খতিয়ান তৈরি করেছে। এ খতিয়ান অনুযায়ী, জেলায় তাদের ৩৭৬টি গাছ কাটা পড়েছে। এতে তাদের ক্ষতি হয়েছে ৩১ লাখ ১ হাজার টাকা।

এতদিন ধরে এই ধ্বংসযজ্ঞ চলমান থাকলেও পরিবেশবাদীদের টনক নড়েছে অনেক পরে। সম্প্রতি পবার সংবাদ সম্মেলন ছাড়াও ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বিক্ষোভ সমাবেশ করে।

বাপা’র সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. আব্দুল মতিন বাংলানিউজকে জানান, বাংলাদেশে এখনও পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় গাছের ভূমিকা সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়।

সরকার বনের গাছ রক্ষা নীতিমালা করেছে ঠিকই, কিন্তু কোনো বনরক্ষা নীতিমালা নেই। গাছ শুধু অর্থনৈতিক দিক দিয়ে লাভজনক, এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরকারকেও বেরিয়ে আসতে হবে।

পরিবেশ রক্ষায় এসব গাছ জরুরি, তা গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করতে হবে বলে তিনি জানান।

একই সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের গাছ কাটা বন্ধে এখনই সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাতে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান ডা. মো. আব্দুল মতিন।

দেশটা আমাদের সবার। কিন্তু ধর্ম, রাজনীতি, অধিকার আদায়ের আন্দোলনের নামে যারা নির্মমভাবে প্রকৃতির সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সম্পদ গাছ ধ্বংস করছে তারা এদেশকে কতটা নিজেদের মনে করে আর ভালোবাসে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০১৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০২, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ ও মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।