ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

পাখিপ্রেমীদের গ্রাম ভাটিনা

সালেক খোকন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৩
পাখিপ্রেমীদের গ্রাম ভাটিনা ছবি: সালেক খোকন

মাস তিনেক আগের কথা। ভাটিনার উদ্দেশ্যে আমরা পা রাখি দিনাজপুর শহরে।

রাজবাড়ীকে পেছনে ফেলতেই উঁচু বাঁধের পথ। পাশেই গা ছমছম করা শ্মশান। দূরে কালীপূজার মেলা বসেছে। বাঁধের দু’পাশে শুধুই সবুজ ধানক্ষেত। দূর থেকে বাতাসে ভেসে আসছে গানের সুর- ডাক দিয়াছে দয়াল আমারে, রইব না আর বেশি দিন, তোদের মাজারে। ’

খানিকটা যেতেই পানির বাধা পড়ল।   খেয়ার মাঝি জানান, এটি গর্ভেশ্বরী নদী। চর পড়ে নদীটি মৃত হলেও এক সময় এর গর্ভ স্পর্শ করা ছিল প্রায় অসম্ভব। ওপারে চওড়া রাস্তার দুধারে সারি সারি লিচু গাছ। লোকবসতি বেশ কম। কিছুদূর এগোতেই এক কৃষক দেখিয়ে দিল ভাটিনা গ্রামের মেঠোপথটি।

ঢুকতেই থমকে দাঁড়ালাম। বড় একটি সাইন বোর্ডে লেখা ‘পাখি সংরক্ষিত এলাকা, পাখি মারা নিষেধ’। ভাটিনার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই চোখে পড়ার মতো বাঁশঝাড়। সারা গ্রামেই রয়েছে ছোট ছোট পুকুর। পুকুরগুলো বাঁশ আর আম গাছে ঘেরা। চারদিকে বিস্তীর্ণ সবুজ ধানক্ষেত। একটি বড় পুকুর পেরিয়ে যতই এগোচ্ছি ততই শত শত পাখির চিৎকারের শব্দ স্পষ্ট হচ্ছে। সামনে আসতেই আমরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম খানিকক্ষণ। একটি বাঁশবাগানের প্রায় প্রতিটি ডালেই দেখা গেল নানা জাতের শত শত পাখি। মনের আনন্দে সবাই চেঁচাচ্ছে। এ যেন পাখির মহামিলন স্থল।

m1201মনের ভেতর ভালোলাগা টের পেলাম। অন্যরকম মন জুড়ানো এক দৃশ্য। পাশের আরেকটি বাঁশঝাড়ে বসেছে অজস্র বক আকৃতির কালো পানকৌড়ি। চোখের সামনেই কয়েকটি পানিতে ডুবে ঠোঁট দিয়ে ধরে আনল বেশ কয়েকটি মাছ। একটি দেশি শালিককে দেখা গেল বড় একটি পানকৌড়িকে ঠোকর দিতে পিছু নিয়েছে। পাখির রাজ্যে আমরা হারিয়ে ফেলি নিজেকে।

ছোট্ট একটি পুকুরের চারদিকের গাছগুলোতে অজস্র বক আকৃতির এক ধরনের বাদামি রঙের পাখি দেখা গেল। চোখ বন্ধ করে বেশ আয়েশি কায়দায় শান্তভাবে ঘুমাচ্ছে তারা। পেছন থেকে একজন জানাল, এরা রাতচোরা। হয়তো এ কারণে চোরদের মতো দিনে ঘুমাচ্ছে। লোকটির কথা শুনে আমরা মুখ টিপে হাসি। পাখি ওড়াতে একজন বিশেষ কায়দায় শব্দ করতেই বিস্ময়কর এক দৃশ্যের অবতারণা হলো। হাজার হাজার পাখি গাছ থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে ছুটে চলল।

মনেই হয়নি গাছগুলোতে এত পাখি ছিল। এ এক অন্যরকম দৃশ্য। মাথার ওপর আকাশের সবখানেই হাজার হাজার পাখি উড়ছে। মনে হচ্ছে ক্রমেই আকাশ থেকে পাখিদের একটি বড় জাল আমাদের ঢেকে দিচ্ছে।

ভাটিনা গ্রামের লোকেরা এ রকম মন জুড়ানো দৃশ্য দেখছেন প্রতিদিন। শত শত পানকৌড়ি, সাদা বক, কুনি বক, গুটকল, রাতচোরা, ঘুঘু, শালিক, টিয়া আর ময়নার ভয়হীন অবাধ আনাগোনা চলে গ্রামটিতে। কাদের মহতী উদ্যোগে তৈরি হয়েছে পাখিদের এমন প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য? স্থানীয় লোকেরা এক বাক্যে জানাল আলোর ভুবন যুব সমবায় সমিতির কথা।

১৯৯৬ সাল। ভাটিনা গ্রামের লোকরা তখন খানিকটা শিক্ষাবিমুখ। আর্থিক দৈন্য এর প্রধান কারণ। পরিবেশগত কারণে গোটা গ্রামেই ছিল পাখির আনাগোনা। ফাঁদ পেতে বক ও পাখি ধরাই ছিল গ্রামবাসীর দৈনন্দিন ব্যাপার। এছাড়া গ্রামটিতে বিত্তশালীদের এয়ারগান আর বন্দুকের শব্দ চলত প্রায় সারাদিন। দিন শেষে একঝাঁক মৃত পাখির দেহ ঝুলতে থাকত শিকারিদের মোটরসাইকেলে। m22013

গ্রামের কলেজ পড়ুয়া একরামুল হক থাকেন খালার বাড়িতে। নিজেদের ভাগ্য গড়া আর গ্রামের জন্য কাজ করার স্বপ্ন ছড়িয়ে দেন যুবকদের মাঝে। অল্প সময়ে তৈরি হয় আলোর ভুবন যুব সমবায় সমিতিটি। প্রথমে ২৫টি পরিবার থেকে শিক্ষাবৃত্তির জন্য প্রতিসপ্তাহে সংগ্রহ করা হয় ১ টাকা করে। তার সঙ্গে অন্য সদস্যদের সঞ্চয় দিয়ে চলে শিক্ষা কার্যক্রম। যুবকদের এই উদ্যোগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন স্থানীয় মেম্বার ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা হাশেম তালুকদার।

মূলত হাশেম তালুকদারের সম্পৃক্ততার কারণেই সমিতিটি সহজেই গোটা গ্রামে আলো ছড়িয়ে দিতে থাকে। অল্প সময়েই আলোর ভুবন সমিতি  মানুষের মনে জায়গা করে নেয়। কয়েক মাস কেটে গেলে সমিতির সভাপতি একরামুল প্রস্তাব করেন গোটা গ্রামটিতে পাখির অভয়ারণ্য তৈরি করার। প্রথমেই পাখি না মারার প্রস্তাবে সম্মতি দেন হাশেম তালুকদার নিজেই। পাখি মারার দীর্ঘদিনের অভ্যাস ত্যাগ করে ছুড়ে ফেলেন নিজের এয়ারগান আর বন্দুকটি। গ্রামের প্রভাবশালী হওয়ায় অন্যরাও অনুসরণ করে তাকে। গোটা গ্রামবাসী মেতে ওঠে পাখিপ্রেমে। পরিকল্পনা মোতাবেক ভাটিনায় ঢোকার ৩টি প্রবেশমুখে টাঙিয়ে দেওয়া হয় পাখি মারা নিষেধ লেখা বড় সাইনবোর্ড।   গ্রামবাসীর ভালোবাসায় ক্রমেই ভাটিনা পরিচিত হয়ে ওঠে পাখিগ্রাম হিসেবে।

দিনাজপুর শহরের ইমরান জানায় নিজের অভিজ্ঞতার কথা। একবার সাইনবোর্ডের নির্দেশ উপেক্ষা করে পাখি মারতে ইমরান ঢোকেন ভাটিনা গ্রামে। পাখি মারার অপরাধে গ্রামের ছোট ছেলে-মেয়ে ও নারী সবাই তাকে কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখেন। পাখি না মারার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা পান তিনি। এরপর থেকে ইমরান আর পাখি শিকার করেন না। পেছনের কথা মনে হলে পাখি হত্যার অপরাধে আজও তিনি লজ্জিত হন।

ভাটিনা গ্রামটি সারা বছরই থাকে নানা ফসলে ভরপুর। টমেটো আবাদ হয় শত শত একর জমিতে। টমেটো চাষি মনসুর জানান, সাধারণত টমেটো ক্ষেতে পোকার উপদ্রব এত বেশি হয় যে কীটনাশক ছিটিয়েও তা রক্ষা করা সম্ভব হয় না। কিন্ত ভাটিনা গ্রামের শত শত পাখি ওই সব পোকা খেয়ে ফেলে। ফলে কীটনাশক ছাড়াই পোকা দমন হয়। এ কারণে এখানকার কৃষকরা টমেটো ক্ষেতে বাঁশের কঞ্চি গেড়ে পাখিদের বসার বিশেষ ব্যবস্থা করে রাখে। তাছাড়া পাখি থাকার কারণে ধানক্ষেতে কারেন্ট পোকার আক্রমণ নেই বললেই চলে।

আলোর ভুবন সমিতির বর্তমান পরিকল্পনার কথা জানায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম। পাখিদের খাদ্যের কথা চিন্তা করে ইতোমধ্যে সমিতির উদ্যোগে গ্রামের রাস্তার পাশে লাগানো হয়েছে প্রায় ৩০০টি বট ও পাকুড় গাছ। এছাড়া অন্য গ্রামেও পাখি মারা বন্ধ করতে সমিতি প্রতি শুক্রবার মসজিদে মসজিদে সচেতনতামূলক প্রচার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।

৫টি পুকুর নিয়ে মাছ চাষ প্রকল্প এবং একটি লেয়ার মুরগির ফার্মসহ বিভিন্ন আয় বৃদ্ধিমূলক প্রকল্প থাকলেও সমিতির সদস্যরা মনে করেন পাখি রক্ষার উদ্যোগটিই তাদের ব্যাপক পরিচিতি ঘটিয়েছে, করেছে সম্মানীত।

ঝড়ের পর পরই ভাটিনাবাসী বেরিয়ে পড়েন কুলা হাতে। খুঁজে খুঁজে বের করেন ঝড়ে আহত পাখিগুলোকে। সাধ্যমতো চিকিৎসা করে ছেড়ে দেন তাদের গন্তব্যে। পাখিদের সঙ্গে রয়েছে গ্রামবাসীর নাড়ির টান। পাখি রক্ষার নায়ক একরামুলের স্বপ্ন এক সময় ভাটিনাসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে পাখি মারা নিষেধ সংশ্লিষ্ট সব সাইনবোর্ড উঠে যাবে। পাখির মতো একটি প্রাণীকে হত্যা করার কথা কারো চিন্তায়ও আসবে না। ছোট শিশুরা বেড়ে উঠবে পাখিদের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে। পুঁথিগত শিক্ষা না পৌঁছালেও জীবের প্রতি দয়ার মহত্ব নিয়ে বেড়ে উঠবে শিশুরা। সবার মনে পাখির প্রতি থাকবে মমতাবোধ ও ভালোবাসা।

সালেক খোকন: লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।