ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

কাজের হাটে ছোটরা, জীবিকার টানে মাঠে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৩২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১৩
কাজের হাটে ছোটরা, জীবিকার টানে মাঠে

Rofiqul-smখাসেরহাট, সুবর্ণচর, নোয়াখালী থেকে: বড়দের দলে ছোটরা। কারো বয়স সাত বছর আবার কারো বারো-তেরো।

কাজের খোঁজে শ্রমের হাটে ওদের ভিড়। রাস্তার পাশে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

কাজ নেওয়ার জন্য মহাজনের অপেক্ষা। শীতরাতে ঘুমানোর জন্য কাঁথা, ধানকাটার কাঁচি, সবই আছে ওদের সঙ্গে। প্ল্যাস্টিক কিংবা কাপড়ের ব্যাগে আছে কিছু কাপড়।

এ গল্প নোয়াখালীর সুবর্ণচরের খাসের হাটের। ধানকাটা মৌসুমে হাটের দিন এখানে বসে শ্রমের হাট। দূর-দূরান্ত থেকে এখানে মানুষ আসে শ্রম বিক্রি করতে। বড়দের সঙ্গে আসে ছোটরাও। বাবা তার ছোট ছেলেকে, বড়ভাই তার ছোট ভাইকে নিয়ে আসে কাজের সন্ধানে। যে বয়সে মায়ের আঁচলের নিচে ঘুমানোর কথা, সেই বয়সে ওরা মহাজনের বাড়িতে ঘুমানোর সব প্রস্তুতি নিয়ে শ্রমের হাটে আসে।

কেরিং চর এলাকার সিরাজ উদ্দিনের আট বছরের ছেলে রাকিব উদ্দিন কাজের খোঁজে খাসের হাটের শ্রম বাজারে। বাড়িতে মাকে ফেলে রেখে মহাজনের বাড়ি ঘুমাতে পারবে তো? প্রশ্ন করতেই রাকিবের ‘হ্যাঁ’ সূচক জবাব। এটা ওদের গা সওয়া। স্কুলে যাওয়ার কথা এ শিশু কখনোই ভাবেনি। ছোটবেলা থেকে হাত পাকিয়েছে কাজে। রাকিব বলল, সংসার চালাতে টাকার প্রয়োজন, কী করবো।
IMG-bg2
দারিদ্র্যতার কারণে বহু শিশু লেখাপড়া ছেড়ে কাজে। বছর শেষে এ ডিসেম্বরে যখন এ সব ছেলেমেয়েদের বার্ষিক পরীক্ষা কিংবা পরীক্ষা শেষে খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকার কথা, তখন ওরা মাঠে কাজ করতে ছুটে। জীবিকার তাগিদে হাতে তুলে নেয় লাঙ্গল-কোদাল অথবা কাঁচি। দিনভর কঠোর পরিশ্রমের পর মেলে সামান্য মজুরি।

সুবর্ণচরের সেন্টার বাজার ও খাসের হাট শ্রমবাজারের শিশু ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিশুদের কাজে মজুরি কম, খাটুনি বেশি। বর্তমান বাজারে ধানকাটা ও রবিশস্য খামারের কাজে শিশুদের দৈনিক মজুরি ১৩০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা। মজুরি কখনো এর চেয়েও কমে যায়। মজুরি কম হলেও খাটুনি ঠিকই ১০ ঘণ্টা, ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা অবধি। সারাদিনে এক থেকে দেড় ঘণ্টার বিশ্রাম পায়।

শিশু শ্রমিকেরা জানান, কাজে গাফিলতি করলে মজুরি কমে যায়। কিংবা কাজ না পারলে কাজ থেকে চলে যেতে হয়। মহাজনদের বাড়িতে কাজে গিয়ে ভাত খেতে হয় ডাল, মূলা, বেগুন, সবজি ছাড়াও ভিন্ন পদের তরকারি দিয়ে।
IMG-12
শিশু মজুরদের খাবারের বাজেটে মাংস থাকে না। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক শিশুরা মাঠে কাজের উদ্দেশে ছুটে। মহাজনের ইচ্ছানুযায়ী কাজের তালিকায় থাকে ধান কাটা, রবি ফসলের ক্ষেত তৈরি, চারা রোপন, পানি তোলা ছাড়াও নানা ধরনের কাজ।

কাজের খোঁজে খাসের হাটে তেরো বছরের কাওছার। বয়স ১৩ বছর। বাবা মনির আহম্মেদ। বাড়ি ভূমিহীন বাজারে। বাবা আর ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করেই শিশুকাল অতিবাহিত হচ্ছে তার। কাওছার পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু সংসারের অস্বচ্ছলতা তাকে এগোতে দেয়নি। টাকার অভাবে বাবা-মায়ের কাছ থেকে তার ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটেনি। আসতে হয়েছে কাজের হাটে।

মিলন মিয়া। বয়স সবে ১০। বাবা আবদুল খালেক। বাড়ি ভূমিহীন বাজার। চার ভাইবোনের মধ্যে মিলন বড়। তৃতীয় শ্রেণি অবধি পড়েছে। আর্থিক অনটনে লেখাপড়া সামনে এগোয়নি। জীবিকার সন্ধানে বাবার সঙ্গে নামতে হয়েছে কাজে। বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে গিয়ে জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও সে স্বপ্ন তার এখন আর নেই।

চর ক্লার্কের নূরনবীর ছেলে সুমন (১৭), ভূমিহীন বাজারের মো. ইউসুফ আলীর ছেলে মো. রুবেল (১৫), চর মহিউদ্দিনের ছেলে আখতার হোসেন (১৬), দরবেশ বাজারের সৈয়দ আহম্মেদের ছেলে আ. হামিদসহ (৯) আরও অনেক শিশু শ্রমিকের দেখা মেলে খাসের হাটের শ্রম বাজারে।

সুবর্ণচরের আরেকটি শ্রম বাজার সেন্টার বাজার। এখানেও বড়দের সঙ্গে দেখা মেলে বহু শিশুর। শ্রমবাজার ঘুরলে কারো বিশ্বাস হতে চাইবে না, ওরা কাজে এসেছে। কেউ হয়তো বাজারের এক কোণে নীরবে বসে আছে। কেউবা দাম-দরের খোঁজ খবর নিচ্ছে। শিশুদের মধ্যে নতুন আসা শিশুরা সবার মুখের দিকে তাকিয়ে অবস্থা বোঝার চেষ্টা করে, আর পুরোনোরা কাজ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে নানাভাবে।
IMG-220
আরেকটি শ্রমের হাট বসে সেন্টার বাজারে। সেখানে দেখা গেল কাজের সন্ধানে আসা আরো কিছু শিশুকে। বয়ার চরের মো. নিজামউদ্দিনকে (১২) তার বাবা দুলাল উদ্দিন শ্রমের হাটে কাজে নিয়ে এসেছে। নিজাম লেখাপড়া করার সুযোগ পায়নি। বাবার কাছে সংসারের খরচ চালাতে কাজে নামাটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

অভিভাবক দুলাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, একা কাজ করে সংসার চালিয়ে নিতে পারছি না। ছেলেসহ কাজ করলে বেশি টাকা পাওয়া যাবে। সংসারটা একটু ভালো চলবে। আমরা গরিব মানুষ। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করিয়ে আর কতদূর নিতে পারব।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, আমন ধান চাষাবাদের মৌসুম এবং ধানকাটা ও রবি মৌসুমে বড়দের সঙ্গে ছোটরাও কাজে আসে। ছোট বয়সে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে রোজগার করে। সুবর্ণচরের সেন্টার বাজার, খাসের হাট, ছমির হাট, আটকপালিয়া, বাংলাবাজার, আক্তার মিয়ার হাট ও থানাহাটে সবচেয়ে বেশি মানুষ কাজের সন্ধানে আসে। হাটের দিন রাস্তার ওপর এদের দীর্ঘ লাইন পড়ে। সব সময়ই এদের দলে থাকে শিশুরা।

বাংলাদেশ সময় ০৩৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১২
সম্পাদনা: সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।