ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

খাদ্য সংকটে লোকালয়ে বনের পশু, হারাচ্ছে প্রাণ

ড. ফোরকান আলী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৩
খাদ্য সংকটে লোকালয়ে বনের পশু, হারাচ্ছে প্রাণ

সুন্দরবনসহ দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলে পানীয় জল ও খাদ্যের অভাবে লোকালয়ে এসে প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য বন্যপ্রাণী। বনের রাজা বাঘসহ ক্ষুধার তাড়নায় লোকালয়ে এসে স্থানীয় বাসিন্দাদের তাড়া খেয়ে ক্ষুধার্ত ও দুর্বল বন্যপ্রাণীগুলো পালাতে না পেরে মারা যাচ্ছে প্রায়ই।



সাধারণত, নভেম্বরের প্রথম থেকে এপ্রিল-মে মাস পর্যন্ত উপকূলীয় নদীগুলোতে লোনা পানি থাকে। বন্যপ্রাণীরা তীব্র লবণাক্ত এই পানি পান করতে না পেরে লোকালয়ে এসে পুকুরের পানি পান করে। অন্যদিকে খাদ্য সংকট তো রয়েছেই।

এছাড়া বন উজাড় হয়ে যাওয়ায় বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থলও সংকুচিত হয়েছে।

m6sপরিসংখ্যান অনুযায়ী, খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে এসে এক যুগে জনপদের বাসিন্দাদের পিটুনি ও বন্দুকের গুলিতে মারা গেছে ১২টি মাঘ। একই সময় বাঘের আক্রমণে সুন্দরবন সংলগ্ন জনপদের ৬ নারী-পুরুষ নিহত হয়েছেন।

সাতক্ষীরার বাঘ-বিধবাদের (বাঘের আক্রমণে নিহতদের স্ত্রী) সংগঠন ‘লিডার’-এর পরিচালক মোহন মণ্ডল জানান, গত ১১ বছরে কেবল সাতক্ষীরার সুন্দরবন সংলগ্ন জনপদে কমপক্ষে ২৮টি বাঘ নদী সাঁতরে লোকালয়ে প্রবেশ করে। এর মধ্যে ১২টি বাঘ গণপিটুনি ও বন্দুকের গুলিতে মারা যায়।

বন বিভাগের হিসাবে, ১৯৮৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মোট ৬৩টি বাঘ হত্যার শিকার হয়েছে। ২০০৯ সালের শেষের দিকে দু’টি বাঘ গণপিটুনিতে মারা যায়। ১৯৯৭ সালে সবচেয়ে বেশি (৮টি) বাঘ লোকারয়ে এসে মারা যায়। এর মধ্যে বেশি মারা পড়ে চাঁদপাই রেঞ্জে।

সুন্দরবনে চোরা শিকারি, কাঠ পাচারকারীদের উৎপাত বেড়ে যাওয়ায় বাঘের আবাসস্থলের প্রকৃতি পরিবর্তন, জলবায়‍ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সুন্দরবনের সমুদ্র উপকূলবর্তী গভীর জঙ্গলে উচ্চ পানির চাপ তৈরি হওয়ায় পানোপযোগী মিঠা পানির অভাবে বাঘ সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ে ঢুকে পড়ে।

এছাড়া সুন্দরবনে পেশাজীবীরা অবৈধভাবে বনজ সম্পদ সংগ্রহের জন্য বনোঞ্চলের গভীরে চলে যাওয়ায় বাঘের সঙ্গে ঘন ঘন দেখা হয়ে য‍াচ্ছে মানুষের। m5s

সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক রাজেশ চাকমার মতে, চোরা শিকারিদের হাতে বছরে যত সংখ্যক হরিণ মারা যায় সে সংখ্যক জন্ম নিচ্ছে না। এছাড়া অব্যাহত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সুন্দরবনের পরিবেশের ক্ষতি হয়ে শিকার কমে যাওয়ায় বনের পাশের শুকিয়ে যাওয়া নদী বা খাল পার হয়ে খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে প্রবেশ করছে বাঘ।

সুন্দরবন সংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে অবিবেচকের মতো বিভিন্ন উন্নয়নমূলক স্থাপনার প্রভাবও বন উজাড় হওয়ার জন্য কম দায়ী নয়। গণআন্দোলনের মুখে সুন্দরবনে এসবিসিপি প্রকল্পের কালো অধ্যায় শেষে এবার বাস্তবায়ন হচ্ছে মার্কিন অর্থায়নে আইপ্যাক প্রকল্প। এ প্রকল্পের ফলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য বিপন্ন ও তেল-গ্যাস লুণ্ঠনের শঙ্কা আরও প্রকট হয়েছে। আইপ্যাক প্রকল্প সম্পর্কে জানার জন্য বন সংলগ্ন অঞ্চলের বাসিন্দা ও পরিবেশবাদী সংগঠনের কর্মীরা প্রথম থেকেই প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন। আন্দোলনের মুখে সুন্দরবন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ প্রকল্প (এসবিসিপি) বন্ধ রয়েছে। ২০০৮ সালে মার্কিন সাহায্য সংস্থা (ইউএসএআইডি) ও পরামর্শক সংস্থা (আইআরজি) বন ও পরিবেশ পর্যটন উৎসাহিত করতে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ডরমেটরি, ট্রেইল, হাঁটার পথ এবং ব্রিজ তৈরির পরিকল্পনা নেয়। এতেও দেশের প্রচলিত বন আইন উপেক্ষার অভিযোগ রয়েছে।

পর্যটক আকৃষ্ট করতে গহিনবনে রঙিন সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ড বাঘ-হরিণের চলাচল ও প্রজনন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করে। যা বণ্যপ্রাণী বিলুপ্তিতে ভয়ানক ভূমিকা পালন করে।

এ পরিস্থিতিতেই সুন্দরবনে শুরু হতে যাচ্ছে বাঘ শুমারি। বাঘ শুমারির জন্য ইতোমধ্যে ৩৩ জন শুমারকর্তাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। ইউএনডিপির ২০০৬ সালের পরিসংখ্যানে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪২টি, ২০০৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩রা মার্চ পর্যন্ত তথ্যমতে, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪০। এর আগে ১৯৯৩-৯৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৬২।

m3s201অন্য একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মৌলভীবাজার জেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বন্যপ্রাণীরা খাদ্যের জন্য লোকালয়ে আসছে। আর লোকালয়ে আসায় কখনও মানুষের হাতে, কখনও গাড়ি চাপা পড়ে শুধু গত বছরই জেলায় ১১টি বন্যপ্রাণী মারা পড়ে।

তবে বন্যপ্রাণী বিলুপ্তি বা মৃত্যুর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। গত বছর জেলার কুলাউড়া বড়লেখা সড়ক, রাজনগর কুলাউড়া সড়ক ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শ্রীমঙ্গলে গাড়িচাপায় চিতা, বনবিড়াল, ‌উল্লুক, অজগর ও ২টি মেছোবাঘ মারা পড়ে। এছাড়া কমলগঞ্জে আদিবাসীদের হাতে ধরা পড়ে ‘ধূমকল’ নামক বিরল প্রজাতির এক প্রাণী।

বন্যপ্রাণীদের হতাহতের কোনো হিসাব বা পরিসংখ্যান সংশ্লিষ্ট দফতরে নেই। আবার পত্র-পত্রিকায় বন্যপ্রাণীর হতাহতের সব ঘটনাও প্রকাশ পায় না। কিন্তু বাস্তবতা হলো দেশে বন্যপ্রাণী, বিরল প্রজাতির প্রাণী হতাহত হচ্ছে প্রতিদিনই। চিড়িয়াখানার তত্ত্বাবধানে থেকেও মারা যাচ্ছে বিরল প্রজাতিরে অনেক প্রাণী।

বনাঞ্চলের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে সুন্দরবনের কথা। সুন্দরবনে রয়েছে ৩৩৪ প্রজাতির গাছ-গাছালি। ৫ হাজার ৭৭২ বর্গমাইলের সুন্দরবনের আয়তন বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৪ দশমিক ২ শতাংশ। সুন্দরবনে তিনটি অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি সুন্দরবনের আয়তন ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। নির্বিচারে উজাড় হচ্ছে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত সুন্দরবন। অথচ এখানে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, বানর, বন্য শূকর, উদ, অজগর ও বন বিড়ালসহ নানা জাতের প্রাণী। রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির সরীসৃপ ও বহু ধরনের হাঙ্গর ও কুমির। m2s20131

১৯৮৭ সালে সুন্দরবন উপকূলে মোট ম্যানগ্রোভ অরণ্যের আয়তন ছিল ৪২০ হাজার হেক্টর। পরবর্তী দশ বছরে এর আয়তন হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ২১২ দশমিক ৩ হাজার হেক্টরে। নির্বিচারে বন নিধন ও বনাঞ্চল নিশ্চিহ্ন হওয়ায় দুই-চারটা অভয়ারণ্যে বন্যপ্রাণীদের স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না। বাধ্য হয়েই বন্য প্রাণী লোকালয়ে চলে আসছে।  

চীনা বিজ্ঞানীরা ১২টি শহরের ১৪৩ প্রজাতির প্রাণীর ওপর গবেষণা করে দেখতে পান যে, সাপ ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে সক্ষম। ভূমিকম্পের ৫ দিন আগে ১২০ কিলোমিটার দূরে থেকেও সাপ আসন্ন ভূমিকম্পের আভাস পায় এবং অদ্ভুত আচরণ শুরু করে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, খামারে সাপের এই আচরণ থেকে সংকেত পেয়ে মানুষ যদি আগেই সতর্কতা অবলম্বন করে, তাহলে ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা থেকে লাখ লাখ প্রাণ বাঁচানো সম্ভব।

ফসলের ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে ব্যাঙ ফসল রক্ষা করছে। আর ব্যাঙ হচ্ছে সাপের খাদ্য। আবার গ‍ুঁইসাপ যদি সাপের ডিম না খায় তাহলে সাপের অত্যধিক প্রাদুর্ভাবে ভূ-পৃষ্ঠে মানব জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ত। এভাবেই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হয়।

আজ আমরা বন-জঙ্গল উজাড় করে মেছো বাঘ, চিতাবাঘ, বন বিড়ালের মতো বন্যপ্রাণীর জীবনধারণ অসম্ভব করে তুলেছি, তারাও কোনো না কোনোভাবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অবদান রাখে।

ইতোমধ্যে বিশ্বখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, পরিবেশের ভারসাম্যহীনতায় অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবী মনুষ্য বাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। পরিবেশের এই ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলে মানুষকে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অন্য কোনো গ্রহে আবাসস্থল খুঁজতে হবে। বন্যপ্রাণীর জন্য বন-জঙ্গল সৃষ্টি ও সংরক্ষণের গুরুত্ব এখানেই।

লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৩
সম্পাদনা: জাকারিয়া খান ও আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।