ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় সম্মান, বেঁচে থাকতে উপেক্ষা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৩
মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় সম্মান, বেঁচে থাকতে উপেক্ষা

Rafiqulখাসেরহাট, সুবর্ণচর, নোয়াখালী থেকে: কেউ দিনমজুর, কেউ বর্গাচাষি, কেউ চা বিক্রেতা, ঠিকাদারের কেয়ারটেকার। আর্থিক অনটনে ধারদেনায় জীবন।

অভাবের কারণে দেনামুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নানা সংকটে জড়িয়ে সব সম্পদ হারিয়ে অনেকের সামান্য ভিটে টিকে আছে। অনেকে সেটাও হারিয়ে ফেলেছেন অনেক আগেই।

নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা এভাবেই বেঁচে আছেন। ’৭১ সালে দেশ রক্ষায় অস্ত্র হাতে পাকিস্তানিদের রুখে দাঁড়ানো এ যোদ্ধাদের এমন আকুতি শোনার কেউ নেই। সে সব যুদ্ধদিনের বীরত্বগাঁথার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে প্রতি পদে।

স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকাটাই অনেকের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। যুদ্ধ করতে গিয়ে কেউ হাত হারিয়েছেন, কেউ হারিয়েছেন পা। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এ বোঝা বহন করা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে।



মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সুবর্ণচর উপজেলা প্রশাসনের সামনে জড়ো হওয়া এখানার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের
সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য মেলে। তাঁরা আক্ষেপ করে বলেন, বেঁচে থাকলে পদে পদে উপেক্ষা। আর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় সম্মান। বছরে দুবার সংবর্ধনায় ডেকে পাঁচ শ টাকা সম্মানি আর একটা খাবারের প্যাকেট। মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রের কাছে এ ‘উপহাসের’ সম্মান আর চায় না।

বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিউল্যার বাড়ি আমানউল্লা ইউনিয়নের চর কাটাবুনিয়া ইউনিয়নে। চট্টগ্রাম ও রংপুর এলাকায় যুদ্ধ করেছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জীবনের কাছে আজ পরাজিত এ যোদ্ধা। শারীরিক সমস্যায় স্বাভাবিকভাবে চলাফেরাও করতে পারেন না। যুদ্ধের সময় তাঁর পায়ে গুলি লেগেছিল। সেই চিহ্ন বহন করে চেয়েচিন্তে চিকিৎসা ব্যয় চালাচ্ছেন তিনি।

চর জব্বরের পশ্চিম চর জব্বর গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সোলায়মান। যুদ্ধ করেছেন কুমিল্লা, ফেনী, পরশুরাম এলাকায়। যুদ্ধ চলাকালে কুমিল্লা সেনানিবাসের ডাইনিং হলে বসে অনেককে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। অলৌকিকভাবে বেঁচে যান এ যোদ্ধা। হার্টের অপরারেশনের পর থেকে শারীরিকভাবে তার নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। জমিজমা নেই। বেঁচে আছেন কোনোমতে, অতিকষ্টে।

চর ক্লার্ক ইউনিয়নের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেছিলেন এক নম্বর সেক্টরে। যুদ্ধে হাত হারিয়েছেন। বাম পায়ে গুলি লেগেছিল। সামান্য পরিমাণ জমিজমা আছে। তা দিয়ে কোনোমতে চলছে জীবন।

একই এলাকার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান যুদ্ধ করেছেন এক নম্বর সেক্টরে ছাগলনাইয়া করিমটিলা এলাকায়। ওখান থেকে চট্টগ্রাম কলেজে গিয়ে অস্ত্র জমা দিয়েছেন। আর্থিক অনটনের জীবন। গাভীর দুধ বিক্রি, বর্গাচাষ, ছোটখাটো ব্যবসায় চলছে তার সংসার। শারীরিক অবস্থাও তেমন ভালো নয়।

দুই নম্বর সেক্টরের লক্ষীপুরের কমলনগর এলাকায় যুদ্ধ করা বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম মৃত্যুঞ্জয় দাস। থাকেন চরবাটার আশ্রয়ন প্রকল্পে। যুদ্ধ করতে গিয়ে আহত হয়েছিলেন। কোনো ভাতা পাননি। জমিজমা নেই। একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কেয়ারটেকারের দায়িত্বে আছেন। সেখান থেকে সামান্য বেতনে চলে তার সংসার।

চর ওয়াবদা ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু বকর সিদ্দিক জীবনের স্বর্ণ সময়টা দেশকে দিয়ে পড়ন্ত বেলায় এখন চা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন। যুদ্ধ করেছিলেন ছাগলনাইয়া, ফেনী এলাকায়। সুবর্ণচরের আবদুল্লা মিয়ার হাটে তার ছোট্ট একটি চায়ের দোকান আছে। চা বিক্রি চলে পাঁচ জনের সংসার।

আলাপে জানা গেল সুবর্ণচর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের নানামুখী সংকটের কথা। কেউ ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারেন না, কেউবা মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেন না, কেউবা পারছেন না দেনা শোধ করতে। প্রশাসন কিংবা স্থানীয় নাগরিক সমাজের সহয়োগিতাও একেবারেই সীমিত।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুবিমল দাস বাংলানিউজকে বলেন, ভূমিহীন ও অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার খাসজমি বন্দোবস্ত দিচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় খাসজমি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হলেও সুবর্ণচরের মুক্তিযোদ্ধারা এ জমি পাচ্ছে না। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানতে পারলেও এ কাজে তেমর কোনো অগ্রগতি খবর নেই।

সুবর্ণচরে ৪৪ জন মুক্তিযোদ্ধা আছেন। এদের মধ্যে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন। এখানকার সব মুক্তিযোদ্ধাই আর্থিকভাবে সংকটাপন্ন। তবে ১৫ জন একেবারেই দুস্থ। এখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাংগঠনিকভাবে এগিয়ে নিতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যালয় স্থাপিত হয়নি। সংসদের কার্যক্রম চলে চায়ের দোকানে অথবা উপজেলা পরিষদে।

সুবর্ণচরের চর জুবিলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফ চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান দিতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর্থিক সংকট কাটাতে এখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের স্থানীয়ভাবে আমরা সহযোগিতা করি।

ভালোভাবে বেঁচে থাকার আকুতি জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, মৃত্যুর পরে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে যেভাবে সম্মান দেখানো হয়, জীবিত থাকতেও যেন তাকে স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে সহায়তা করা হয়।

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বলেন, দেশটা দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। রাজাকারেরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। সংঘবদ্ধভাবে শত্রুদের মোকাবেলা করতে হবে। দেশ বাঁচাতে আমরা প্রয়োজনে আবার ঝাঁপিয়ে পড়বো।

বাংলাদেশ সময়: ০১১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৩
সম্পাদনা: সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।