ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

বাংলাদেশের মৌমাছি: হুমকি অসচেতনতা-কীটনাশক

আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৩
বাংলাদেশের মৌমাছি: হুমকি অসচেতনতা-কীটনাশক

ঢাকা: মৌমাছিকে বলা যায় প্রকৃতির বিস্ময় পতঙ্গের একটি। সবচেয়ে উপকারী পতঙ্গ বললেও ভুল হবে না।

অসংখ্য উপকার ছাড়া এরা মানুষের কোনো অপকার করে না। উদ্ভিদের পরাগায়নে সবচেয়ে গুরুত্ব বহন করা প্রাণীও মৌমাছি। আর সুষ্ঠু পরাগায়ন হলেই কেবল পুষ্ট ফুল, ফল, ফসল পাওয়া সম্ভব।

বিস্ময়কর হলেও সত্য বিশ্বের অন্তত এক লাখ ৩০ হাজার উদ্ভিদের পরাগায়ন সরাসরি মৌমাছির ওপর নির্ভরশীল। আর একটি মৌচাকে যতো মৌমাছি বাস করে তার চারপাশে ৪০০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে যত ফুল ফোটে, একদিনে সেগুলোতে ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ ও পরাগায়ন করতে সাহায্য করে এসব মৌমাছি।

এক পাউন্ড মধু উৎপাদনে এদের বসতে হয় ২০ লাখ ফুলে। একদিনে ছুটতে পারে প্রায় ১৬ কিলোমিটার এলাকা।

সবুজ শ্যামল বাংলাদেশে রয়েছে অসংখ্য ফুলের সমাহার। ফুল-ফসলের লীলাভূমি বাংলাদেশ। প্রাকৃতিকভাবে ও চাষের মাধ্যমে তাই বিপুল পরিমাণ মধু উৎপাদন হয় এখানে। কিন্তু ক্ষতিকর মাত্রারিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, কৃষকদের অসচেতনা, কুসংস্কার, মধু আহরণে অসাবধানতাসহ আরও নানা কারণে মৌমাছির ক্রমাগত মৃত্যুর হার বাড়ছে। ফলে হুমকিতে দেশের খাদ্য উৎপাদনও।

এর প্রয়োজনীয়তার কথা উপলব্ধি করে ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে মৌমাছি রক্ষায় নেওয়া হয়েছে নানা কার্যকরী পদক্ষেপ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নিষিদ্ধ করেছে মৌমাছির জন্য ক্ষতিকর সব ধরনের কীটনাশক। কিন্তু বাংলাদেশের এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে এখনো দেখা যায়নি।

বাংলাদেশের মধু উৎপাদনের প্রধান জোন পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রাজশাহী, দিনাজপুর, ঈশ্বরদী, গোপালগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, সুন্দরবন প্রভৃতি এলাকা। একেক অঞ্চলে উৎপাদন হয় একেক ধরনের মধু।

প্রায় ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে মৌচাষ করছেন সাতক্ষীরা সুন্দরবন এলাকার এম ডি সাহিদুর রহমান মিন্টু। তিনি একজন মৌ বিশেষজ্ঞও। বাংলাদেশের মৌমাছি নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।

দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, বিগত কয়েক বছর দেশে মৌমাছি মৃত্যুর হার অনেক বেড়ে গেছে। আমরা যখন কোনো খামার বা ক্ষেতে মৌবাক্স রাখি তখন মাঝে মাঝে দেখা যায় অর্ধেকের বেশি মৌমাছি সেখানেই মারা পড়েছে।

কৃষকদের কিছু ভুল ধারণার কারণেই এটা হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

সাহিদুর রহমান বলেন, কৃষকরা মনে করেন শুধু কীটনাশক ব্যবহার করলেই ফসল ভালো হয়। আমরা অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু সবাই শোনেন না। তাদের ধারণা, সরিষা ক্ষেতে মৌবাক্স বসালে সরিষা পুষ্ট হয় না। মৌমাছি ফুল থেকে মধু শুষে নিয়ে অপুষ্ট করে দেয়। কিন্তু আমরা কোনো কোনো চাষিকে কোনো কীটনাশক ব্যবহার করতে না দিয়ে মৌবাক্স বসিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছি যে, মৌমাছির জন্যই তাদের ফলন বেশি হয়েছে।

এর প্রমাণ মেলে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ শহীদুর রশিদ ভুঁইয়ার একটি নিবন্ধেও।

বীজ ও ভালো ফসল উৎপাদনে পরাগায়ন অত্যাবশ্যক উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, বীজ ফসলের মাঠে কীটপতঙ্গ দ্বারা পরাগায়ন অধিক কার্যকর। যেসব ফসলে কীটপতঙ্গ দ্বারা পরাগায়ন ঘটে এদের ফুলগুলো একটি দলে সজ্জিত থাকে অথবা এদের ফুলগুলো আকৃতিতে কিছুটা বড় হয়। কীটপতঙ্গ যেন ভালোভাবে এসব ফুল বা ফুল দলের ওপর বসতে পারে সে ব্যবস্থাটি থাকে। অনেক ফসল (সবজি) আর কীটপতঙ্গের মাঝে পরাগায়নের জন্য শত শত বছর ধরে চমৎকার সহ-অভিযোজন ঘটেছে।    

রশিদ ভুঁইয়া তার নিবন্ধে আরও উল্লেখ করেছেন, দিন দিন পরাগায়নকারী কীটপতঙ্গের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। মৌমাছি, ভোমরা পোকা ইত্যাদি কীটপতঙ্গের সংখ্যা নানা কারণেই কমে যাচ্ছে। বন-জঙ্গলে বৃক্ষের ডালে মৌমাছি বাসা বাঁধে। সাধারণত দুপুর পর্যন্ত ফসলের মাঠে বিচরণ করে এরা বাসায় ফিরে আসে। বিশেষ করে দুপুর একটার ভেতরে মাঠে কীটনাশক ছিটিয়ে দিলে মৌমাছির মতো বহু উপকারী কীটপতঙ্গ বিষাক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এসব কারণে সবজির মাঠে পরাগায়ন নিশ্চিত করার মতো কীটপতঙ্গের উপস্থিতি প্রায়শই থাকে না। ফলে প্রাকৃতিক কীটপতঙ্গ পরাগায়নের ওপর নির্ভর করে সবজির বীজ উৎপাদনও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। সেজন্য (সবজির বীজ) ফসলের মাঠে পরাগায়ন সহায়ক কীটপতঙ্গের সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে মৌমাছির বাসা স্থাপন বেশ লাভজনক বলে প্রমাণিত হয়েছে।

ফসলের ক্ষেতে মৌমাছির উপকারিতার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বাঙ্গি ফসলে ১০টি ফুলের জন্য একটি মৌমাছি যথেষ্ট। শসা, তরমুজ, মিষ্টি কুমড়া আর লাউয়ের ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ ফুলের জন্য একটি মৌমাছির উপস্থিতির প্রয়োজন হয়। বাঁধাকপি, ফুলকপি প্রভৃতি ফসলের ক্ষেত্রে হেক্টর প্রতি ফসলের (বীজ) জন্য  দু’টি বা তিনটি মৌমাছির বাসা মাঠের উপযুক্ত স্থানে বসিয়ে দিলেই পরাগায়ন নিশ্চিত হয়।

মুলার ক্ষেত্রে যেহেতু ফুল একেবারেই আকর্ষণীয় নয়, সেজন্য মাঠে অধিকসংখ্যক কীটপতঙ্গের উপস্থিতির প্রয়োজন হয়। তাই প্রতি হেক্টর মুলার জমিতে তিন-চারটি মৌমাছির বাসা মাঠে বসিয়ে দিলে বীজের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পায়।

পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কমসংখ্যক মৌমাছির উপস্থিতির প্রয়োজন হয়। এক থেকে ১০ হেক্টর পেঁয়াজের ফসলের (বীজ) মাঠে একটি মৌমাছির বাসা বসিয়ে দিলেই চলে। গাজরে একই সঙ্গে বায়ু পরাগায়ন ও কীটপতঙ্গ পরাগায়ন সম্পন্ন হয়। তবে মৌমাছি গাজরের পরাগায়নে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে। প্রতি হেক্টর গাজরের জমিতে একাধিক মৌমাছির বাসা স্থাপন করলে ভালো কাজ হয়।

ধান সাধারণত বায়ু পরাগায়নে নির্ভরশীল। কিন্তু মৌ বিশেষজ্ঞ মিন্টু জানান, তারা ধান ক্ষেতের পাশে মৌবাক্স বসিয়ে দেখেছেন ধানের ফলন অন্য ক্ষেতের চেয়ে বেশি হয়েছে।

মধুর জন্য নাম রয়েছে টাঙ্গাইলের মধুপুরের। লালমাটির মধুপুর গড় এলাকার মধুপুর, মুক্তাগাছা, ফুলবাড়ীয়া, ঘাটাইল, সখীপুর, ভালুকা ও জামালপুর সদর উপজেলায় আনারস, কাঁঠাল, কলা, সরিষা, তিল, তিষি, জলপাই, লিচু, আম, পেঁপে, কুল, আদা, হলুদ, মিষ্টিকুমরা, লাউ, শিম, আলু, কাসাবা, কপি, গাজর, মুলাসহ বিভিন্ন কৃষিজ ফসল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদন করা হয়। ফলে এসব এলাকায় রয়েছে কয়েক হাজার মৌচাষি।

কিন্তু অধিক ফলন ও মুনাফার আশায় প্রায় ৩০ ধরনের হরমোন ও ২০ ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করছেন চাষিরা। এর মধ্যে রয়েছে নিষিদ্ধ ঘোষিত ডিডিটিও।

রাজশাহী, দিনাজপুর, ঈশ্বরদী, পাবনা, বগুড়া প্রভৃতি জেলায় লিচু, আম, সরিষা প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়। গোপালগঞ্জ আবার কালোজিরা ও ধনিয়া মধুর জন্য বিখ্যাত। কিন্তু এসব এলাকার চাষিরাও কীটনাশক ব্যবহারে সচেতন নয়। এতে প্রাকৃতিকভাবে মৌমাছিসহ পরাগায়ন সহায়ক পতঙ্গ মরে যাচ্ছে। এতে যে মৌমাছি মরছে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাওয়া যায় যখন মৌচাষিরা বাক্স রাখেন। সিজন শেষে দেখা যায় বাক্সে অর্ধেক মৌমাছিও নেই।

প্রাকৃতিকভাবে মধুর বড় একটি উৎস সুন্দরবন। এ অঞ্চলের মৌমাছির অবস্থা নিয়ে মিন্টু জানান, সুন্দরবনে কেওড়া ও খলিসা ফুল মৌমাছিদের প্রথম পছন্দ। কিন্তু সহজলভ্য ও গাছ কিছুটা ছোট হওয়ায় প্রচুর নিধন হয়। তাছাড়া এ অঞ্চলে লোনা পানি হওয়ায় মৌমাছি ফুলের মধুর ওপরই অনেকটা নির্ভরশীল। ফলে মৌমাছির সংখ্যা কমছে।

তাছাড়া বন থেকে মধু আহরণের ক্ষেত্রে নিয়ম না মেনে আগুন দেওয়ায় অসংখ্য মৌমাছি মারা পড়ছে। এর মধ্যে রয়েছে রানী মৌমাছিও।

মৌমাছির নিরাপত্তার জন্য কি করা উচিত এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা ব্যক্তিগতভাবে চাষিদের বোঝাচ্ছি। তবে সবাই বোঝে না। আবার কেউ কেউ বোঝেও। প্রত্যেক থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষিকর্মকর্তারা যদি চাষিদের বোঝান তাহলে আরও বেশি উপকার হবে। কারণ প্রত্যেক উপজেলায় কৃষি কর্মকর্তা রয়েছেন। অনেকে বিষয়টি নিয়ে কাজও করছেন। এই সচেতনতা আরও বাড়ানো উচিত।

যেহেতু আশি ভাগ ফুলের পরাগায়ন মৌমাছির মাধ্যমে হয়, তাই বিষয়টি নিয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন মিন্টু।

ইউরোপের মতো আমাদের দেশেও ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

মৌমাছি সংরক্ষণে সরকারি কোনো উদ্যোগ না থাকায় দিন দিন কমছে মৌমাছি। বেসরকারিভাবে যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে সেগুলো পর্যাপ্ত নয়। অচিরেই যদি ইউরোপ, আমেরিকার মতো এই উপকারী পতঙ্গটি সংরক্ষণে সরকারি বড় কোনো উদ্যোগ না নেওয়া হয় বীজ ও ফসলের জন্য তা হবে মারাত্মক হুমকি।

জেনে নিন মৌমাছি নিয়ে কিছু তথ্য:

৫০০ গ্রাম মধু তৈরি করতে মৌমাছির ২ মিলিয়ন ফুলের দরকার হয়! এই একই পরিমাণ মধু তৈরি করতে মৌমাছির ভ্রমণ করতে হয় ৯০ হাজার কিলোমিটার!

মধু সংগ্রহের পরিভ্রমণে যে কোনো মৌমাছি ন্যূনতম ১০০ ফুলে বসে। মৌমাছিরা ১০ থেকে ২০ মিলিয়ন বছর আগে থেকেই মধু তৈরি করছে।

মৌচাকে গড়ে প্রায় ৬০ হাজার মৌমাছি থাকে। মৌমাছির চারটি পাখা কিন্তু মাছির দুইটি। মানুষ খুব সহজেই মধু হজম করতে পারে, কারণ মানুষ খাওয়ার আগেই মৌমাছিরা তা একবার খেয়ে পরিপাক করে রাখে। মধু পৃথিবীর একমাত্র খাবার যা সহজে পচে না!

বাংলাদেশ সময়: ১২২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।