ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূল

জলাবদ্ধতায় বিপন্নপ্রায় অর্ধকোটি মানুষের জীবন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫২৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৩
জলাবদ্ধতায় বিপন্নপ্রায় অর্ধকোটি মানুষের জীবন

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মরছে কপোতাক্ষ। দিনে দিনে পরিবর্তনের প্রভাবকগুলো আরও দৃশ্যমান হচ্ছে।

এরসঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অপরিকল্পিত উন্নয়ন। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতি ঘেরা এ নদীর মৃত্যুঘন্টা ক্রমেই এগিয়ে আসছে। কপোতাক্ষের বড় অংশ মরে গিয়ে লাখো মানুষের সংকট বাড়িয়েছে। বছরের প্রায় ছ’মাস জলাবদ্ধতায় ডুবছে বাড়িঘর-রাস্তাঘাট। প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে নতুন সংকট। কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়, সংকট কাটে না। কপোতাক্ষ-তীর ঘুরে এসবের আদিঅন্ত খোঁজ নিয়ে ‘কপোতাক্ষে বাঁচামরা’ শিরোনামে বাংলানিউজের ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব  পড়ুন শুক্রবার।  

কপোতাক্ষ তীরের জলাবদ্ধ এলাকা ঘুরে এসে: ‘সেতুর চারপাশে কপোতাক্ষ মরে গেছে। চারশ ফুট নদী মরে এখন হয়েছে ত্রিশ ফুট। নদীর সঙ্গে আমরাও মরছি। পানির জন্য শুস্ক মৌসুমে হাহাকার, বর্ষায় হাবুডুবু। অন্যত্র চলে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নাই। ’

সাতক্ষীরার তালা উপজেলা মোবারকপুরে কপোতাক্ষ নদীর উপর নির্মিত সেতুর নিচে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল তুলে জলাবদ্ধ এলাকার মানুষের কষ্টের কথা বর্ণনা করলেন ষাট বছরের বৃদ্ধ হাশেম আলী। হাশেম আলীর এসব কথার সত্যতা মেলে জলাবদ্ধ এলাকা ঘুরে।

যে কারণে জলাবদ্ধতা
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ উপকুলীয় এলাকায় একহাজার ৫শ ৫৬ কিলোমিটার বেড়িবাধ নির্মাণের জন্য স্থাপিত ৩৭টি পোল্ডার ও দুইশ ৮২টি স্লুইসগেট। এ সব পোল্ডার ও স্লুইসগেটের কারণে একশ ৯৭ কিলোমিটার কপোতাক্ষের বেঁচে আছে মাত্র ২৫ কিলোমিটার।

প্রতি বছরই মরছে ৭-৮ কিলোমিটার করে। একইসঙ্গে প্রাণহীন হচ্ছে সংযুক্ত খালগুলো। এ কারণে বিপন্ন হয়ে পড়েছে প্রায় অর্ধকোটি মানুষের জীবন ।

একটি বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষা বলছে, সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, খুলনা জেলার ১৪টি উপজেলার ৭১টি ইউনিয়নের ৮০২টি গ্রামে ১৪ লাখ ৭৬ হাজার ২’শ ৫৩ জন মানুষের বসবাস কপোতাক্ষ পাড়ে।

এসব মানুষের জীবিকা কপোতাক্ষ কেন্দ্রিক। এতে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৩০ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে।

জলাবদ্ধতার আওতা বাড়ছে
নদী গবেষণায় নিয়োজিত সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্র্যাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসসহ (সিইজিআইএস) একাধিক প্রতিষ্ঠান বলছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জলাবদ্ধতার স্থায়িত্ব ও এলাকা প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে।

পানি কমিটির সর্বশেষ জরিপ বলছে, চলতি বছর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জলাবদ্ধতায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। এবার জলাবদ্ধতায় প্রায় তিনফুট পানি বেড়েছে ২০০৯ সালের তুলনায়। এতে ৪৭০টি গ্রামের নয় লাখ ৪৭ হাজার ৩৪৯ জন মানুষ জলাবদ্ধতার শিকার হয়।  

২০০৮ সালে জলাবদ্ধতায় ডুবেছিল যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা ও ঝিনাইদহের ৮টি উপজেলার ৩৮ হাজার ২০ হেক্টর এলাকা।

পাঁচ বছর আগে যশোর ও সাতক্ষীরার পাঁচটি উপজেলার বারো হাজার ৬৮৭ হেক্টর এলাকা জলাবদ্ধতায় ডুবেছিল। ওই বছর ৭৭টি গ্রামের এক লাখ পনেরো হাজার ২শ’ মানুষ জলাবদ্ধতার শিকার হয়।  
পানি কমিটির সভাপতি শফিকুল ইসলাম প্রতি বছর পলি পড়ে কপোতাক্ষের সাত-আট কিলোমিটার মরার কথা নিশ্চিত করে বাংলানিউজকে বলেন, ১৯৭ কিলোমিটারের মধ্যে আছে মাত্র ২৫ কিলোমিটার। জলাবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত বেশি হলে জলাবদ্ধতা আরও বাড়বে।     

অপরিকল্পিত বাঁধ-স্লুইসগেট     
জলাবদ্ধ এলাকা ঘুরে জানা গেছে, অপরিকল্পিত বাঁধ কপোতাক্ষের পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ বাঁধ ও স্লুইস গেটকেই মনে করছেন জলাবদ্ধতা নিয়ে কর্মরত ব্যক্তি ও সংগঠনের নেতারা।

সূত্র বলছে, গত শতাব্দীর ষাটের দশকে তৎকালীন সরকার সারা বছর উচ্চফলনশীল ধান চাষের জন্য জলাভূমিকে শুষ্ক ভূমিতে রূপান্তর করতে উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দেশে চার হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, ৭৮২টি স্লুইসগেট এবং ৯২টি পোল্ডার নির্মিত হয়। শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এক হাজার ৫৫৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, ২৮২টি স্লুইসগেট এবং ৩৭টি পোল্ডার নির্মাণ করা হয়।

এ প্রকল্পে এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশ বিচেনায় নেওয়া হয়নি। ফলে প্রকল্প শেষ হওয়ার মাত্র এক দশক পর থেকে নানামুখী সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে। এ কারণে বহু পানি নিষ্কাশন খাল বন্ধ হয়ে যায়।     
অপরিকল্পিত বাঁধ ও স্লুইসগেট প্রসঙ্গে যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা বলেন, ‘বাঁধ ও স্লুইসগুলোর কারণে জলাবদ্ধতার বিষয়টি একদম উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে ওই সময় মানুষের জীবিকা নির্বাহের জন্যেই এগুলো নির্মাণ প্রয়োজন ছিল। ’

অপরিকল্পিত উন্নয়ন
তালার পাটকেলঘাটা থেকে কপোতাক্ষের তীর ধরে যশোরের মনিরামপুরের রাজগঞ্জ এলাকা ঘুরে নদীটি মরে যাওয়ার চিত্র চোখে পড়ে। দাঁদপুরের মেলেকবাড়ি এলাকায় কপোতাক্ষ তীরে গড়ে উঠেছে একাধিক ইটভাটা। তালা উপজেলার পাটকেল ঘাটা থেকে কেশবপুরের সুরিঘাটা পর্যন্ত কপোতাক্ষ খননে ২০০৩ সালে ২৮ কোটি টাকার প্রকল্পের আওতায় ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদী খননের কথা থাকলেও কাজ হয়েছে নামমাত্র।

যশোরের কেশবপুরের সুরিঘাটা বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আবদুল পাইক ও কৃষক হাবিবুর রহমান জানান, কপোতাক্ষ খননের জন্য এখানে একটি ক্রস বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। পানি সেচে কপোতাক্ষ খননের কথা ছিল।

কিন্তু বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় খনন হয়নি। পরে বাঁধটি অপসারণ না করায় পলি পড়ে কপোতাক্ষ ভরাট হয়েছে।
এলাকা ঘুরে দেখা যায়, একইভাবে খননের জন্য ক্রস বাঁধ দেওয়া হয়েছিল যশোরের মনিরামপুরের পাজাখোলায়। খননের পর বাঁধটি অপসারণ করা হয়নি।

এর ফলে আশপাশের এলাকা পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। অন্যদিকে খাল খনন করে নদী তীরে বাঁধ দেওয়ায় বাঁধের ভেতরে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।

২০০৪ সালে ঝাঁপা বাজারের নিকটে কপোতাক্ষের ওপর সেতু নির্মাণের সময় আড়াআড়ি বাঁধ দেওয়া হলেও পরে সে বাঁধ অপসারণ করা হয়নি। মনিরামপুরের সরষকাঠি, তালা উপজেলার মোবারকপুরসহ আরও অনেক সেতুর অবস্থা একই রকম।  
    
খাল ইজারা-দখল
তালা উপজেলা সদরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষের দু’তীরে চোখে পড়ে বহু বাড়িঘর। এর মধ্যে বহু পাকা স্থাপনা রয়েছে। কোথাও গড়ে উঠেছে ইটভাটা। তালা থেকে খুলনার পাইকগাছা পর্যন্ত একই দৃশ্য চোখে পড়ে। মাঝখানে মরা কপোতাক্ষ আর দু’তীরে অবৈধ বাড়িঘর। বর্ষায় নদীর দু’তীর উপচে পানি চলে যায় বাড়িঘরে। সংযোগ খালগুলো ইজারা দেওয়ার বিধান না থাকলেও শালিখা, গজেশ্রী, বুড়িভদ্রাসহ কপোতাক্ষের বেশকিছু সংযোগ খালের বিভিন্ন অংশ ইজারা দেওয়া হয়েছে। এতে পানি নিষ্কাশন পথে পথে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।  

জলাবদ্ধতা নিয়ে কর্মরত পানি কমিটির সাধারণ সম্পাদক মীর জিল্লুর রহমান বলেন, ‘নদী ভরাটের সঙ্গে অসাধু চক্র জড়িত। এরা ভূমি অফিসের সঙ্গে যোগসাজসে নদী তীরের জমি দখল করছে। কখনো ইজারা বন্ধ থাকলেও মৌখিকভাবে অনুমতি নিয়ে দখল করা হচ্ছে। ’

এ বিষয়ে তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘কপোতাক্ষ তীরের কিছু এলাকায় অবৈধ দখলদার রয়েছে। তালিকা তৈরি করে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে। ’

বাংলাদেশ সময়: ০৫১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।