ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

বিলুপ্তির পথে এশিয়ার বাঘ

ড. ফোরকান আলী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০১৩
বিলুপ্তির পথে এশিয়ার বাঘ

ঢাকা: বনের অতন্দ্র প্রহরী বাঘ। এশিয়ার বিখ্যাত প্রাণী।

বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। কিন্তু কালের করাল  গ্রাসে এ বাঘ বিলুপ্তির পথে। শক্তি, সাহস, ক্ষিপ্রতা, হিংস্রতা এবং দ্রুততার জন্য এ প্রাণীটি বিখ্যাত। সিংহ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর সঙ্গে বাঘের তুলনা হয় না।

প্রাণী বিজ্ঞানীরা বলছেন, মধ্য এশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চল বাঘদের আদি নিবাস। এ অঞ্চল থেকেই পৃথিবীর নানা এলাকায় বাঘ ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে পৃথিবীতে আটটি উপপ্রজাতির বাঘ দেখা যায়। এ সবই বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, ইরান, চীন, রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং কোরিয়ায় বাস করে। এ আট প্রজাতির বাঘের মধ্যে আমাদের দেশের বাঘই সবচেয়ে সুন্দর এবং বিখ্যাত।

ব্রিটিশরা এদের রাজকীয় স্বভাব এবং ভয়ংকর সৌন্দর্যের জন্য নামকরণ করেছিল ‘দি রয়েল বেঙ্গল টাইগার’। এদের বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে (PANTHE-RA TIGIS) প্যানথারা টাইথিস। বাংলাদেশ ও ভারতের সুন্দরবন অঞ্চল বর্তমানে এদের দখলে। চীনের মাঞ্চুরিয়া এবং রাশিয়ার সাইরেরিয়া অঞ্চলের বাঘ আকৃতিতে সবচেয়ে বড়। আর  ইন্দোনেশিয়ার বাঘ আকৃতিতে সবচেয়ে ছোট। মাঞ্চুরিয়া এবং সাইবেরিয়া অঞ্চলের বাঘের চামড়ার রং একটু ফ্যাকাশে হয়ে থাকে। এ এলাকায়, অতীতে সম্পূর্ণ কালো বা সাদা বর্ণের বাঘ দেখা গেছে। বর্তমানে সম্পূর্ণ সাদা বা কালো বাঘ দুষ্প্রাপ্য।

বাংলাদেশের বাঘের গায়ের রং উজ্জ্বল বাদামি হলুদ বর্ণের। তার উপর কালো ডোরা কাটা দাগের সমন্বয় রয়েছে। ডোরা দাগগুলো দেহের সঙ্গে আড়াআড়িভাবে সাজানো। শরীরের নিচের অর্থাৎ বুকের অংশের এবং পায়ের ভিতরের চামড়ার বর্ণ সাদা। একটি প্রাপ্তবয়স্ক বাঘের ওজন সাধারণত দেড়শ থেকে সাড়ে তিনশ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। বাঘ ঘন দুর্ভেদ্য বনাঞ্চল পছন্দ করে। এরা খাবারের প্রয়োজন না হলে খোলা জায়গায় খুব একটা আসে না। বাঘ চমৎকার সাঁতার কাটতে জানে। সুন্দরবনের বড় বড় নদী এরা সহজেই সাঁতার কেটে পার হয়।

আত্মরক্ষা ও শিকার ধরার জন্য বাঘ নিজেকে সুচতুরভাবে লুকিয়ে রাখতে পারে। এরা সিংহের মতো শিকারের সময় অযথা গর্জন করে না। বাঘ নিরবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শিকারকে অনুসরণ করে। বাঘ রাতের বেলা শিকার করতে পছন্দ করে। অন্ধকারে এরা বিড়ালের মতোই দেখতে পায়। বাঘের চোয়ালে মোট ২৭টি দাঁত থাকে। সামনের চারটি দাঁত আকারে বেশ বড় ও সুতীক্ষè। এরা যখন প্রচন্ড হুংকার দেয় তখন সামনের এই বড় দাঁতগুলির জন্য এদের ভয়ংকর দেখায়। এসময় এদের মুখ থেকে প্রচুর লালা নির্গত হয়। এই লালা খুবই বিষাক্ত। মানুষের দেহে লাগলে ঘা হয়ে যেতে পারে।

নিজের ওজনের দুইগুণেরও বেশি ভারী বোঝা সে সহজে টানতে পারে। বড় বড় গরু, মহিষ মেরে বহুদূরে টেনে নিয়ে মহানন্দে ভোজন করে। বাঘের স্বাভাবিক খাদ্য হরিণ, বুনো শূকর, গাউর, মহিষ, গরু প্রভৃতি। তবে এসব খাদ্য জোটাতে না পারলে মাছ, বনমোরগ, বানর, গুঁইসাপ, কাছিম, কাকড়া, ব্যাঙ ইত্যাদির মাংস খায়।

বাঘ সাধারণত একা থাকতে পছন্দ করে। বাঘিনীও বাচ্চা না থাকলে একা ঘুরে বেড়ায়। বাঘিনীর গর্ভধারণের সময় সাধারণত ১৫/১৬ সপ্তাহ হয়ে থাকে। বাঘিনী সাধারণত দুই থেকে ছয়টি বাচ্চা একত্রে প্রসব করে। বাচ্চারা প্রায় দুই বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে থাকে। এ সময় মায়ের কাছ থেকে শিকার করার কৌশল শিখে নেয়।

আমাদের জাতীয় গর্বের প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগার প্রায় বিলুপ্ত প্রাণীর তালিকায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাঘ সংরক্ষণ করা না গেলে সুন্দরবনে শুধু মাটিই থাকবে। আর গাছপালা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ফলে বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ এবং পৃথিবীর একটি বিশ্ব ঐতিহ্য বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেবে। অথচ সুন্দরবনের বাঘ বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং অর্থনৈতিক উন্নতির চাবিকাঠি হতে পারে।

সবশেষ ২০০৪ সালে বিজ্ঞান ভিত্তিক বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাঘ শুমারি করে। এর হিসাব অনুযায়ী সুন্দরবনে বাংলাদেশ অংশে রয়েছে ৪১৯টি পূর্ণবয়স্ক বাঘ। এর মধ্যে পুরুষ ১২১, স্ত্রী বাঘ ২৯৮টি আর বাচ্চা বাঘের সংখ্যা ২১টি। আর সুন্দরবনের ভারত অংশে রয়েছে ২৭৪টি পূর্ণবয়স্ক বাঘ। এর মধ্যে পুরুষ বাঘ ২৪৯ ও স্ত্রী বাঘ ২৫টি।

তবে ভারতের বাঘ বিশেষজ্ঞ জয়ন্ত খ্রিসা জানান, বাংলাদেশে বর্তমানে সাড়ে ৩০০-এর মতো বাঘ রয়েছে। ইউএনডিপির ২০০৬ সালের পরিসংখ্যানে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪২টি, ২০০৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত তথ্যমতে, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪০। এর আগে ১৯৯৩-৯৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৬২টি। ভারতের বাঘ

বিশেষজ্ঞের মতে, সুন্দরবনে বছরে বাঘ কমছে অন্তত ১০ থেকে ১২টি। বাঘের মৃত্যুর আটটি কারণ চিহ্নিত করেছে সুন্দরবনের বাঘ বিশেষজ্ঞরা। সেগুলো হলো লবণাক্ত পানির কারণে লিভার সিরোসিস, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্যের অভাব, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, বয়স্ক বাঘের স্বাভাবিক মৃত্যু, পুরুষ বাঘের বাচ্চা খেয়ে ফেলা, শিকার এবং লোকালয়ে বাঘ গেলে পিটিয়ে হত্যা।

সম্প্রতি গ্লোবাল টাইগার ফোরাম তাদের ওয়েবসাইটে বলেছে, বিশ্বের ৪০টি দেশের কালোবাজারে বাঘের চামড়া বেচাকেনা হচ্ছে। আর এজন্য নির্বিচারে বাঘ হত্যা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী বাঘের বিপন্নতা লক্ষ্য করে, বাঘ বিলুপ্তি রোধকল্পে ১৯৯৪ সালের মার্চ মাসে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে গ্লোবাল টাইগার ফোরাম প্রতিষ্ঠিত হয়। বাঘ অধ্যুষিত দেশ বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, কম্বোডিয়া, চীন, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মিয়ানমার, নেপাল, উত্তর কোরিয়া, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনাম এ সংগঠনের সদস্য।

বন বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, সুন্দরবনের শরণখোলা, চাদপাই, খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জে তুলনামূলক বেশি বাঘ হত্যা করা হয়। আমাদের বিশ্বাস, সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং রোগাক্রান্ত বাঘের চিকিৎসার সুবিধা না থাকায় বাঘের মৃত্যু বেশি হয়। সুন্দরবন এলাকায় ১৯৮১-১৯৯৯ সালের মধ্যে অবৈধভাবে ৬৩টি বাঘ মারা হয়। গত এক যুগে চোরা শিকারিদের হাতে শতাধিক বাঘ নিধন হয়েছে। বিশ্ব বাজারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া খুবই মূল্যবান। প্রতিটি বাঘের চামড়া কম করে হলেও বাংলাদেশি টাকায় ২৫  থেকে ৩০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা তাদের ড্রইং রুমে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া ঝুলিয়ে নিজেদের আভিজাত্য প্রদর্শন করে থাকেন।

সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জের বনসংলগ্ন গ্রামগুলোয় একাধিক সংঘবদ্ধ বাঘ শিকারি দল রয়েছে। চোরা শিকারিরা জেলে সেজে বন বিভাগের মাছ ধরার পাস নিয়ে গভীর বনে ঢুকে বাঘ শিকার করে। পরে ওই চামড়া বিশেষ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে পাচারকারী চক্রের হাতে তুলে দেয়। চীনের তিব্বতের লাসার জোখাং স্কোয়ারের বাজারে বাঘের চামড়ার কোট অবাধে বিক্রি হচ্ছে। ২০০৩ সালের অক্টোবরে লাসার শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তারা বিপুল সংখ্যক বাঘের চামড়া, হাড় ও অন্যান্য অংশ উদ্ধার করেছে। যা বন্যপ্রাণীর দেহাংশের চোরা ব্যবসার ইতিহাসে নজিরবিহীন।

বিশ্ব বাজারে জ্যান্ত কিংবা মৃত প্রাণীর বেচাকেনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও চীন-তাইওয়ানে তা অহরহ চলছে। বাঘের দেহের উপাদান থেকে পণ্য বা ওষুধ তৈরিসহ বাঘ হত্যা নিষিদ্ধ করেছে আমেরিকান কংগ্রেস। বিশ্বের প্রায় ১৪টি দেশ লন্ডনে টাইগার মিশন নামে একটি বাঘ সংরক্ষণ আন্দোলন শুরু করেছে। এ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারত, আমেরিকা, কানাডা, জাপান, নেপাল, নেদারল্যান্ড, রাশিয়া, চীন, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়শিয়া।

বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ১৯৭৪-এ এই ব্যাপারে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ১৯৯২ সালে সরকার বন ও পরিবেশ সংক্রান্ত নতুন আইন প্রণয়ন করে। সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণে টাইগার অ্যাকশন প্লান তৈরি করছে সরকার। ওয়াইল্ড লাইফ ইন্সটিটিউট অফ ইনডিয়া, ভারতের একটি ফাউন্ডেশন, ওয়ার্ল্ড নেচার ইন্সটিটিউট প্রভৃতি সংগঠন বাঘ সংরক্ষণে সামাজিক সচেতনতার প্রচারণা চালাচ্ছে।

প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাঘের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি বাঘ বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি একমত হয়েছেন, পূর্ব এশিয়াই হলো বাঘের আদি নিবাস। দক্ষিণ চীনের বাঘই আধুনিক বাঘের পূর্বসূরি। বাঘের মাথায় খুলির আকার থেকে তারা একমত হন। তাদের ধারণা, ২০ লাখ বছর আগে দক্ষিণ চীন থেকে দুই দল বাঘ বের হয়। এক দল চলে যায় উত্তর রাশিয়ার দিকে, অন্য দল দক্ষিণ দিকে। দক্ষিণ দিকের দলটি ইন্দোনেশিয়া আর বাংলাদেশ-ভারতের দিকে চলে আসে। এ দলের বাঘই রয়েল বেঙ্গল টাইগার নামে পরিচিত।

গত ৫০ বছর আগেও বাংলাদেশের অনেক জায়গায় এ প্রাণীর অবস্থান ছিল। এখন সুন্দরবন ছাড়া আর কোথাও নেই। পৃথিবীর মধ্যে শুধু এশিয়া মহাদেশেই বাঘ আছে আট প্রজাতির। এর মধ্যে আছে সাইবেরিয়ান বাঘ। রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলে এদের বাস। ১৯৭৭ সালের বাঘ শুমারিতে বলা হয় ২০০ বাঘ আছে। এখন একেবারে বিলুপ্ত। চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বেঁচে আছে ১৭৫টি বাঘ। মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও মালয়শিয়ায় ২ হাজার বাঘ রয়েছে বলে জানা যায়।

সুমাত্রায় ১৯৭৮ সালে বাঘ ছিল এক হাজার। আর এখন আছে মাত্র সাড়ে ৪০০। ইরান, আফগানিস্থান ও তুরস্কে বাঘ আছে ৭০টির মতো। ভারতীয় বাঘ। ভারত ও বাংলাদেশে এদের বাস। ভারত অঞ্চলে এসে এদের শরীরের রং ও স্বভাব কিছুটা পরিবর্তন হলেও সবচেয়ে অপূর্ব সুন্দর এ বাঘ।

১৯২০ সালে এদের সংখ্যা ছিল ৪০ হাজারের মতো। এখন আছে বড় জোর সাড়ে তিন হাজার। বিশ্বের বনাঞ্চলে বর্তমানে প্রায় সাত হাজার বাঘ কোনো রকমে টিকে আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মধ্যে পাঁচ হাজার বাঘই ভারতের অংশে রয়েছে। বিশ্বের চিড়িয়াখানা, বাঘ খামার, সার্কাস দল ও ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে প্রায় পাঁচ হাজার রয়েল বেঙ্গল টাইগার। আসুন এ সুন্দর প্রাণীটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সবাই সচেতন হই।

লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ

বাংলাদেশ সময়: ০৩৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৩, ২০১৩
এএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।