ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূল

মেঘনায় একখণ্ড সবুজ, জীবিকা হাজারো মানুষের

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ও ছোটন সাহা, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৩
মেঘনায় একখণ্ড সবুজ, জীবিকা হাজারো মানুষের

মদনপুরা(দৌলতখান, ভোলা) থেকে: ভয়াল মেঘনার বুকে জেগে থাকা এক টুকরো সবুজ। জোয়ারের পানিতে ডুবে যায়, আবার জেগে ওঠে ভাটায়।

পানি কমে গেলে বাড়িঘর, রাস্তা, ব্রিজ আর গাছপালা মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। চারিদিকে নেই বেড়িবাঁধ। আছে শুধু পানি আর পানি।

এত পানির রাজ্যে একফোঁটা খাবার পানি সংগ্রহে কষ্টের শেষ সীমা ছাড়িয়ে যায়। চিকিৎসা, শিক্ষা আর কৃষিতে সরকারের সেবা মেলে না। দুর্যোগের সংকেত পেলে ছুটতে হয় কিনারে।

ভোলার দৌলতখান উপজেলার মদনপুরা ইউনিয়নের মানুষগুলো কীভাবে বেঁচে আছে, তা কাছ থেকে না দেখলে বোঝার কোনো উপায় নেই। এদের বেঁচে থাকা পুরোপুরি নির্ভর করে প্রকৃতির ওপর। নেই কোনো খোঁজ নেওয়ার মানুষ।

নির্বাচনের পর জনপ্রতিনিধিদের এসব অঞ্চলে দেখাই মেলে না। চরের বিপন্ন মানুষদের ভোটে জয়লাভ করে এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম নাছির উদ্দিন নান্নু থাকেন ভোলা সদরে।

মন্ত্রী-এমপি কিংবা সরকারি কর্মকর্তাদের পা এখানে পড়ে না। চেয়ারম্যান বাজারের দোকানদার মো. বশির বলেন, নির্বাচনে ভোট দিলেও জনপ্রতিনিধিদের আমরা এলাকায় পাই না বললেই চলে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাঝেমধ্যে এলেও এ এলাকার সংসদ সদস্য তোয়ায়েল আহমেদ নির্বাচনের পর চরে আর পা রাখেননি। আমরা কেমন আছি, কী খেয়ে বেঁচে আছি, তা জানতে কেউ এগিয়ে আসে না।

দৌলতখান ইউনিয়ন। কিন্তু এখানে যাওয়ার সহজ পথ ভোলা সদরের তুলাতলী ঘাট হয়ে। এ ঘাট থেকে দিনের বিভিন্ন সময়ে কয়েকটি ট্রলার ছেড়ে যায় মদনপুরায়। মদনপুরা আর কাছিয়ার চরে ভেড়ে এসব ট্রলার।

তুলাতলীতে মাছধরা ট্রলার ভেড়ে। মেঘনার বুকে জাল ফেলে জেলেরা ছুটে আসেন এখানে। মাছ বেচাকেনার হাটও আছে এখানে। নদী থেকে শুধু তুলে আনা চকচকে ইলিশের দাম হাকান পাইকারেরা। সাধারণ ক্রেতাদের কাছে এ মাছ মোটেও সহজলভ্য নয়। দাম এখানে খুবই চড়া।

বুধবার দুপুর দেড়টা। জোয়ারের পানিতে ফুলে উঠতে শুরু করেছে মেঘনা। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ছিল ঢেউয়ের তীব্রতা। ঢেউয়ের সঙ্গে নেচে নেচে মদনপুরার দিকে এগিয়ে চলে ট্রলার। দূর থেকেই তা বোঝা যায়।

এরই মধ্যে জোয়ারের পানিতে চরাঞ্চল ডুবতে শুরু করেছে। মদনপুরা পৌঁছানোর আগে পানির ভেতরেই নেমে গেলেন ক’জন যাত্রী। ফিরতি পথে পানি কমে যাওয়ার পর বোঝা গেল এটাই চরের মানুষের হাটার পথ। কিন্তু জোয়ারের সময় সেখানে থাকে কোমর সমান পানি।

মদনপুরায় নামতেই মানুষের নানা অভিযোগ। শুধু নেই আর নেই। এখানে কিছুই নেই। মেঘনার বুকে দুর্যোগের হাত থেকে এখানকার মানুষদের বাঁচাতে এতদিনেও কোনো সাইক্লোন আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। বর্তমানের দুটি সাইক্লোন আশ্রয়কেন্দ্রে কাজ চলছে। একটি মাটির কিল্লা থাকলেও সেখানে মানুষের আশ্রয় নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

মদনপুরার চরপদ্মার বাসিন্দা বশির আহমেদ জোমাদ্দার জানান, দুর্যোগের সময় ঘূর্ণিঝড় সতর্ক সংকেত পেলে তারা ছুটে যান ওপারে, তুলাতলী। সেখানে কোনো সাইক্লোন আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠেন। বাঙলা বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ আর আশ্বিন-কার্তিকে ঝড়ের মাস হিসেবে ধরা হয়।

এসব সময়ে এলাকার মানুষ চরম আতঙ্কে থাকেন। এ হিসেবে এলাকায় এখন আতঙ্কের সময়। চরবাসী জানালেন, বিভিন্ন সময়ে বড় দুর্যোগে মদনপুরার ঘরবাড়ি ও গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হয়। তবে প্রয়োজনের তূলনায় সহায়তা মেলে খুব সামান্যই।

মদনপুরা থেকে মুমূর্ষু রোগীদের চিকিৎসার জন্য ভোলা সদরে নেওয়ার পথে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে প্রায়ই। এখানে কমিউনিটি ক্লিনিক আছে মাত্র তিনটি। সেখানে সব ওষুধ পাওয়া যায় না। দুপুরের পর ক্লিনিকে কোনো লোকজন থাকে না।

জরুরি অবস্থায় হাতুরে ডাক্তার আর ওষুধের দোকানদারেরা চিকিৎসা করেন। চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে এ চরে লোনাপানি জমে। প্রায় প্রতি বছরই এ সময় ডায়রিয়া দেখা দেয়। চরের ১০ হাজার মানুষের জন্য নলকূপ আছে মাত্র ১৮টি। এর মধ্যে আবার কয়েকটি অচল। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অপ্রতূলতার কারণে চরের মানুষের জীবন থাকে হাতের মুঠোয়।

মদনপুরা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোশাররফ হোসেন পন্ডিত বলেন, ওয়ার্ডে প্রায় দুই হাজার লোকের বসবাস। রাস্তা করা হয়েছিল, তা এখন পানিতে ডুবে থাকে। জোয়ারের সময় লোকজন চলাচল করতে পারে না। এ ওয়ার্ডে স্কুল, ক্লিনিক, মাদ্রাসা, মসজিদ কিছুই নেই। প্রত্যন্ত এলাকা হিসেবে মদনপুরার জন্য সরকারের বিশেষ কোনো বরাদ্দ থাকে না।

মদনপুরায় মাস্টার্স কিংবা বিএ পাস কোনো শিক্ষিত মানুষ নেই। এখান থেকে বাইরে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ভোলা সদরে অবস্থানকারীদের সংখ্যাও হাতে গোনা। চরের দুর্গম জনপদ থেকে কিছু ছেলেমেয়ে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়। অনেকেই আবার সে সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়।

অধিকাংশ শিশুরা গরু-মহিষের রাখাল কিংবা মাছ ধরায় কাজে বাবাকে সাহায্য করে। চরে তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে।

চরের দুটি বাজারের মধ্যে একটি পাটোয়ারী বাজার। এখানে সমস্যার কথা জানতে গেলে বেশ কিছু মানুষের ভিড় জমে। সবার মুখেই নানা সংকটের কথা। পাটোয়ারী বাজার এলাকার মানুষের আড্ডার স্থান।

সকাল-দুপুর-বিকাল এখানে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ হাটবাজার ছাড়াও সময় কাটাতে আসে। টিভি দেখে। রাজধানীর খোঁজখবর নেয়। আবার কখনও সিনেমা দেখেন। বাজারে বসে কথা বলতে বলতেই চারিদিক জোয়ারের পানিতে ডুবে যায়।

পাটোয়ারী বাজারের পাশে কমিউনিটি ক্লিনিকে যাওয়ার রাস্তা ডুবেছিল জোয়ারের পানিতে। পুরো এলাকায় চলাচলের জন্য বাঁশের সাঁকো আর আধাপাকা ব্রিজগুলো পানিতে ডুবে থাকতে দেখা যায়। আর মানুষজন পার হচ্ছে সাতরিয়ে।

পাটোয়ারী বাজার থেকে চেয়ারম্যান বাজার মাত্র এক কিলেমিটার পথ। বিলের মাঝখানে সরু কাঁচা রাস্তা পানিতে তলিয়ে আছে। হাঁটু কিংবা কোমর পানি ভেঙে চলছে মানুষ। পানি অতিক্রম করে চেয়ারম্যান বাজারের আগেই নতুন মডেলের মদনপুরা ইউনিয়ন পরিষদ ভবন। চারপাশ ডুবে আছে পানিতে। সামনে একটি স্কুল পানির নিতে। স্কুলের সামনের নলকূপটি গলা-পানিতে ডুবে আছে।

এখন গঠনের কাল মদনপুরার। ২৫ বছর বয়সী এ চরটি এখনও শুধুই গড়ছে। রস্তাঘাট, ব্রিজ, সাইক্লোন আশ্রয়কেন্দ্র সবই যেন নতুন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাড়িঘর। জোয়ারের সময় বহু ঘরে পানি ওঠে। কাঁচা সড়কই তখন তাদের আশ্রয়।

স্থানীয় সূত্র বলছে, এক সময় এ ইউনিয়নটি ছিল দৌলতখান উপজেলার মূল ভূখণ্ড সংলগ্ন। মেঘনায় ভেঙে সেই ইউনিয়নটি এপারে এসে চরে রূপান্তরিত হয়েছে। সাতটি মৌজা নিয়ে গঠিত এ ইউনিয়নে লোক সংখ্যা এখন প্রায় ১০ হাজার ছাড়িয়েছে।

মদনপুরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এ কে এম নাছির উদ্দিন নান্নু বাংলানিউজকে বলেন, এ মুহূর্তে মেঘনার বুকে জেগে থাকা এ ইউনিয়নে বেড়িবাঁধ দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। জোয়ারের পানিতেই এলাকার মানুষের বেশি কষ্ট হয়। এজন্য আরও বেশি উঁচু রাস্তা প্রয়োজন। এলাকার মানুষের খোঁজ না রাখার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতি শনিবার ইউনিয়ন পরিষদে মামলা পরিচালনা করি।

এ ছাড়াও মানুষের সমস্যা সমাধান তিনি নিয়মিত উদ্যোগ নেন বলেও দাবি করেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৩
আরআইএম/এসএইচ/এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।