‘বোধের উন্মোচন থেকেই আমি অনুভব করে আসছি— আবদুশ শাকুর যেন তার সহজাত প্রবণতাগুলো নিয়ে ঠিক ততখানি প্রতিকূল ভুবনেই জন্মেছে যতখানি অনুকূল ভুবনে জন্মেছেন, ধরুন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্যাপারটার শাখাপ্রশাখায় বিচরণ না করে এখানে আমি কেবল কাণ্ডখানির দিকে ইঙ্গিত করেই ক্ষান্ত হবো : কর্ণে সুর আর তাল বেজে উঠতেই আমাকে বুঝতে হলো, আমি একটি ঐতিহ্যবাহী আলেম খান্দানের সদস্য।
ওপরের কথাগুলো কথাশিল্পী আবদুশ শাকুরের স্মৃতিকথামূলক রচনা ‘কাঁটাতে গোলাপও থাকে’র একটি অংশ। ২৫ ফেব্রুয়ারি তার জন্মদিন। কিছু কিছু মানুষ আছেন, সাধারণের জন্মদিনের চাইতে যাদের জন্মদিন খানিকটা আলাদা, বিশেষ। আবদুশ শাকুরও সেই বিশেষ মানুষ আর তার জন্মদিনও বিশেষ। সে কারণেই এই নিবন্ধের অবতারণা। কিন্তু নিবন্ধটি কীভাবে শুরু করা যায়, তা কিছুতেই ভেবে পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে তার রচনা থেকে উদ্বৃতি দিয়েই সূচনাটা করা গেল। অবশ্য তা প্রাসঙ্গিক। কেননা তার জন্মদিনকে উপলক্ষ করেই যেহেতু এই নিবন্ধ, সেহেতু তার আত্মজীবনী থেকে জন্মবৃত্তান্তের খানিকটা ব্যবহার করাটা সমীচীন বলেই মনে হয়েছে।
১৯৪১ সালের এই দিনে নোয়াখালী জেলার সুধারাম থানার রামেশ্বরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা-মা অনেক আগেই প্রয়াত মকবুল আহমাদ ও ফায়জুন্নিসা। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে শাকুর সর্বকনিষ্ঠ। তার ভাই-বোন দুজনও অনেক আগেই প্রয়াত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সসহ এমএ এবং হল্যান্ডের আইএসএস থেকে অর্থবিজ্ঞানে এমএস পাস করেন তিনি। কর্মজীবনে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনা, পরে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদান এবং বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণের পর পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন লেখালেখিতে।
আবদুশ শাকুর একজন কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্র ও সংগীত গবেষক এবং নিসর্গলেখক।
তিনি লেখালেখি শুরু করেন উত্তরকৈশোরেই। প্রথম গল্পগ্রন্থ ক্ষীয়মাণ প্রকাশিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে অধ্যয়নকালেই। ছোটগল্প, প্রবন্ধ, রম্যরচনা ও উপন্যাস রচনার পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত বহু চিরায়ত গ্রন্থও সম্পাদনা করেছেন তিনি। বাংলা-আরবি-ফার্সি-উর্দু ভাষায় ব্যুৎপত্তি ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক আবদুশ শাকুরের গদ্যকে করেছে শাণিত এবং প্রবন্ধকে সারগর্ভ। তার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে- মহামহিম রবীন্দ্রনাথ, সংগীত সংবিৎ, গোলাপসংগ্রহ, বাঙালির মুক্তির গান, সংগীত সংগীত, ভাষা ও সাহিত্য, পরম্পরাহীন রবীন্দ্রনাথ, গল্পসমগ্র, রম্যসমগ্র, সংলাপ, ভালোবাসা, আত্মকথনে আবদুশ শাকুর : কাঁটাতে গোলাপও থাকে, ভেজাল বাঙালি, রসিক বাঙালি, উত্তর-দক্ষিণ সংলাপ, নির্বাচিত কড়চা, আবদুশ শাকুরের শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, আবদুশ শাকুরের নির্বাচিত গল্প, রবীন্দ্রনাথকে যতটুকু জানি, কৌতুকনাটক টোটকা ও ঝামেলা ইত্যাদি।
ছোটগল্পে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৭৯ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কারে ভূষিত হন। গল্পসমগ্রের জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে ২০০৩ সালের অমিয়ভূষণ পুরস্কার লাভ করেন। গোলাপসংগ্রহ-নামক গবেষণামূলক প্রবন্ধগ্রন্থের জন্য মননশীল শাখায় প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কার পান ২০০৪ সালে। সমগ্র সাহিত্যকর্মের জন্য অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার পান ২০০৮ সালে এবং শ্রুতি সাংস্কৃতিক অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান ২০১১ সালে। লেখালেখিতে সদা সক্রিয় আবদুশ শাকুর ক্লান্তিহীনভাবে উন্মোচন করে চলেছেন প্রজ্ঞার নতুন নতুন দিগন্ত। ক্লান্তিহীন পথচলার সত্তর বছরে আবদুশ শাকুর এগিয়ে চলুক অনন্তে। এগিয়ে চলুক অসম্ভবে। জন্মদিনে শুভ কামনা।
লেখকদ্বয়: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক