ঢাকা: ‘ভোট দিতে ব্যাংকে টাকা নিতে লাইন, বাসে উঠতে লাইন, এখানেও লাইন!’, কথাটি বললেন যিনি, তার মুখে কিন্তু বিরক্তির সামান্যতম চিহ্নমাত্রও নেই। বেশ হাসিমুখেই কথাগুলো বললেন মহিলা অভিভাবকটি।
বলছিলাম শনিবার সকাল এগারোটার দিকে রাজধানীর রামপুরা থানার ওয়াপদা রোডের ওমর আলী লেনস্থ স্কাইলাইন স্কুলে শিশুদের টিকা খাওয়ানোর সময়কার পরিবেশ নিয়ে।
আজ আমার মেয়ে অবন্তিকার বয়স ২৩ মাস পূর্ণ হলো। ওকে টিকা খাওয়াতে নিয়ে স্কাইলাইন স্কুলে ঢুকতেই চোখে পড়েছে দীর্ঘ লাইন। মেয়ের মায়ের কোলে মেয়েকে দিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলাম উৎসবমূখর পরিবেশে টিকা খাওয়ানোর মধুরতম দৃশ্য। কেন্দ্রটিতে ওমর আলী লেন, ওয়াপদা রোড, হাজীপাড়াসহ রামপুরা পূর্ব-পশ্চিমের অনেক এলাকা থেকে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে এসে টিকা খাওয়াচ্ছেন অভিভাবকরা।
বাচ্চাদের টিকা খাওয়ানোয় ব্যস্ত স্বাস্থ্যকর্মী আফিয়া জানালেন, এখন আর শিশুরা টিকা খেতে এসে কান্না করে না। অভিভাবকদের সচেতনতা অনেক বেড়েছে। বেশ আনন্দের সঙ্গেই টিকা খাওয়ানোর কাজ করছিলেন তিনি। বললেন, ‘এতো কেবল বাচ্চাদের জন্যই নয়, পুরো দেশ-জাতিরই সুস্বাস্থ্য গড়বার কাজ। কাজটা তো তাই শুধু পেশাগত নয়, মহত্তমও। ’
শুধু মা-বাবারাই নয়, এসেছেন নাতি-নাতনিকে নিয়ে বৃদ্ধ দাদা-নানারাও। তারাও হাসিমুখে লাইনে দাঁড়িয়ে সব কিছু উপভোগ করছিলেন আর পরিশেষে শিশুগুলোকে টিকা খাইয়ে আদরের নাতি-নাতনিদের রোগমুক্ত সুস্থ জীবনের আকাঙ্খায় ফিরে যাচ্ছিলেন।
স্কুলটিতে যাওয়া-আসার পথে শনিবার সারা দিনই শুধু শিশু আর অভিভাবকদের চলাচলের দৃশ্য। টিকা খাওয়াতে বা খাইয়ে নতুন প্রজন্মের সদস্যদের কোলে করে বা হাঁটিয়ে স্কুলটিতে নিয়ে যাচ্ছেন, বা ফিরে আসছেন।
২০তম জাতীয় টিকা দিবসের প্রথম রাউন্ড শুরুর এ দৃশ্য শুধু স্কাইলাইন স্কুলেই নয়, সারা ঢাকা মহানগরজুড়ে, সারা দেশজুড়ে। সারা দেশের ২ কোটি ২০ লাখ শিশুকে ২ ফোঁটা পোলিও এবং একটি ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হচ্ছে সকাল আটটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত।
২০০৬ সাল থেকেই বাংলাদেশ পোলিওমুক্ত। তাই শিশুদের এ প্রাণঘাতী রোগের পুনঃসংক্রমণ রোধকল্পে ‘বাংলাদেশকে পোলিও মুক্ত রাখুন’- এই শ্লোগান নিয়ে পালিত হচ্ছে এবারের জাতীয় টিকা দিবস।
প্রথম রাউন্ডে এবার ০ থেকে ৫৯ মাস বয়সী সব শিশুকে ২ ফোঁটা পোলিও টিকা খাওয়ানো হচ্ছে। ৬ থেকে ১১ মাস বয়সী সব শিশুকে একটি নীল রংয়ের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল এবং ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের একটি লাল রংয়ের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হচ্ছে। পোলিও টিকার সঙ্গে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ালে শিশু মৃত্যুহারও কমবে, তাই এ উদ্যোগ।
শুধু তাই নয়, কোনো শিশু টিকা খাওয়া থেকে যেন বাদ না পড়ে সে জন্য রোববার থেকে বুধবার পর্যন্ত চলবে ‘বাদ পড়া শিশু অনুসন্ধান’ কার্যক্রম।
অতএব, ‘শিশু, শিশু, সকল শিশু-বাদ যাবে না কোনো শিশু’ এ শ্লোগানও সফল হতে চলেছে দেশজুড়ে।
জাতীয় টিকা দিবসের ২য় রাউন্ড অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন শূন্য থেকে ৫ বছরের শিশুকে ২ ফোঁটা পোলিও টিকা এবং ২ থেকে ৫ বছরের শিশুকে ১টি কৃমিনাশক ট্যাবলেট খাওয়ানো হবে।
শনিবার প্রথম রাউন্ডের টিকা খাওয়ানোর সময় ২য় রাউন্ডেও যার যার শিশুদের নিয়ে আসার এ কথাটি মনে করিয়ে দিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। আর শিশুদের টিকাদান কেন্দ্রে আনার সময় ভরাপেটে নিয়ে আসার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এবার ১ লাখ ৬০ হাজার কেন্দ্রের মাধ্যমে এবার শিশুদের টিকা খাওয়ানো হচ্ছে। এর মধ্যে ২০ হাজার রয়েছে ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্র। অফিসে আসার পথে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এ ধরণের একটি ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্র চোখে পড়েছে, সেখানেও টিকা খাওয়ানোর লাইন আর ভিড়। মধ্য বাড্ডায় রোটারি ক্লাবের স্বেচ্ছাসেবকরা চেয়ার-টেবিল দিয়ে অস্থায়ী টিকাকেন্দ্র বানিয়ে টিকা খাইয়েছেন বাচ্চাদের। সেখানে বেজেছে টিকা দেওয়ার সপক্ষে উদ্দীপণামূলক গানও।
এসব কেন্দ্রের স্বাস্থ্যকর্মীরা আরো জানালেন, যদি কোনো শিশু গত ৪ মাসের মধ্যে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খেয়ে থাকে, তবে সেই শিশুকে ক্যাম্পেইনে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো যাবে না। যদি কোনো শিশু ১ মাসের মধ্যে কৃমিনাশক ট্যাবলেট খেয়ে থাকে, তবে সেই শিশুকে কৃমিনাশক ট্যাবলেট খাওয়ানো যাবে না। কান্নারত অবস্থায় শিশুকে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল ও কৃমিনাশক ট্যাবলেট খাওয়ানো যাবে না। তবে উভয় রাউন্ডে পাঁচ বছরের কম বয়সী কোনো শিশু আগে জাতীয় টিকা দিবসে বা নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় বা অন্য কোনোভাবে পোলিও টিকা খেয়ে থাকলেও তাকে পোলিও টিকা খাওয়াতে হবে।
বাংলাদেশকে পোলিওমুক্ত রাখতে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতীয় টিকা দিবসের গুরুত্ব এখন আর কোনো অভিভাবককেই বুঝিয়ে বলতে হচ্ছে না। খবরটি শুধু জানা থাকলেই হলো। নির্দিষ্ট দিনে আশপাশের টিকাকেন্দ্রে সবাই ঠিকই হাজির থাকছেন।
দেশকে পোলিওমুক্ত রাখা ও পোলিও পুনঃসংক্রমণ রোধকল্পে এর মধ্যেই দেশের শতভাগ শিশুকে টিকা প্রদান নিশ্চিত করা হয়েছে। শিশু মৃত্যুহার হ্রাসসহ স্বাস্থ্য খাতে সাফল্যের জন্য জাতিসংঘের এমডিজি-৪ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে বাংলাদেশ। তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের গুণগত মানোন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পেয়েছেন ‘সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড-২০১১’।
আমরা এখন অনেক ধরনের লাইনে দাঁড়াই। সব লাইনেই সেই দীর্ঘ অপেক্ষার ক্লান্তি, আগে যাওয়ার জন্য ধাক্কাধাক্কি, লাইন ভাঙা কিংবা মাঝ লাইনে কারো ঢুকে পড়া নিয়ে ঝগড়াঝাটি। এই প্রথম দেখলাম, লাইনে সেসবের বালাই নেই।
লাইনটি যে, নিজের নিজের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ সন্তানের সুস্থতার জন্যে।
শিশুদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে আমরা একটি সুস্থ জাতি গঠনের পথে এগিয়ে যাচ্ছি। আর এসবই সম্ভব হয়েছে শিশুদের টিকা খাওয়ানোর লাইনের দৈর্ঘ্য বেড়েছে বলেই।
তাই, শিশুদের কোলে মায়েদের, বাবাদের, দাদা-নানা বা অন্য স্বজনদের এই লাইন আরো বড়ো হোক, আরো........
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৭, ২০১২