কলকাতা: বাংলা ছবিতে প্রায় ৭৫ বছর আগে চালু হয় প্লেব্যাক প্রথা। ১৯৩৫ সালে নীতিন বসুর ‘ভাগ্যচক্র’ ছবিটি দিয়ে প্লেব্যাক প্রথার সূত্রপাত।
এরপর ছবিতে বহু গান ব্যবহার হয়েছে। বহু পরিচালকই দৃশ্য অনুযায়ী ছবিতে গান প্রয়োগ করেছেন। সাধারণত ছবির পরিচালকেরা প্রধান চরিত্রের অর্থাৎ নায়ক-নায়িকার লিপে গান ব্যবহার করে থাকেন। এর ব্যতিক্রমও ঘটেছে। অনেক পরিচালক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ছবিতে নেপথ্যে বা কোনো ছোট চরিত্র বা শিশু শিল্পীর লিপেও গান ব্যবহার করে দেখিয়েছেন যে সেই গানও জনপ্রিয় হয়।
বাংলা ছবির গানের স্বর্ণযুগ বলা হয় গত শতাব্দীর পাঁচ ও ছয়ের দশককে। সেই গান এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে, দোলা দেয় হৃদয়ে। একদিকে, চলচ্চিত্রের গান, অন্যদিকে মাঠ-ময়দানে গণ আন্দোলনের গানও আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল গোটা বাংলায়। তবে এখানে ১৯৫০-র দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ৮০-র গোড়ার দিক পর্যন্ত কিছু ছায়াছবির গানের উল্লেখ করা হলো।
১৯৫৪-তে অগ্রদূত পরিচালিত ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সেই মনকাড়া গান-
‘জীবন নদীর জোয়ার ভাঁটায়
কত না ঢেউ ওঠে পড়ে
সে হিসাব কভু রাখে না কালের খেয়া ...’
এই গানের কথা ও সুর ছিল গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও অনুপম ঘটকের। ছবিতে দেখা গেছে, একজন মাঝি নৌকা বাইবার সময় গানটি গাইছেন। মাঝির চরিত্রটিকে কেউ মনে রাখেননি, কিন্তু গানটি এখনও জনপ্রিয়।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যেমন বহু নায়কের লিপে গান গেয়েছেন, তেমনি অজস্র ছবিতে তার কণ্ঠে গান শোনা গেছে। সেইরকম কয়েকটি ছবি উল্লেখ করা যেতে পারে।
প্রথমেই ১৯৫৭-তে অজয় কর পরিচালিত, সুচিত্রা-উত্তমের সেই বিখ্যাত ছবি ‘হারানো সুর’-এ গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নিজেরই সুর ও কণ্ঠের গানটি —
‘আজ দুজনার দুটি পথ ওগো/দুটি দিকে গেছে বেঁকে ...। ’
ছবিটিতে দেখা গেছে, নায়িকার জীবনে চরম অস্থিরতা, টানাপড়েনের মূহুর্তে রেডিওতে ভেসে আসে গানটি। অনেক না বলা কথা গানের মধ্যেই প্রকাশ পায়। গানটি সে বছর জনপ্রিয় হয়। বহুবার শোনার পরেও আজও জনপ্রিয়। ঐ একই বছরে মঙ্গল চক্রবর্তীর পরিচালনায় ‘তাসের ঘর’-এ গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর ও কণ্ঠের নেপথ্য গানটি — ‘‘শূন্যে ডানা মেলে পাখীরা উড়ে গেলে/নিঝুম চরাচরে তোমারে খুঁজে মরি ...। বা অসিত সেনের ‘জীবন তৃষ্ণা’ ছবিটিতে ভূপেন হাজারিকার সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের গানটি একজন পূজারির লিপে ছিল। ‘‘সত্যম শিবম সুন্দরম হে তুমি/গানে গানে পঞ্চপ্রদীপ জ্বালো’’ ...। এইভাবে কখনো সূর্যতোরণ, শিকার ছবিতে নেপথ্য বা পার্শ্বচরিত্রের লিপে হেমন্ত ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে পাওয়া যায়।
অগ্রদূতের ‘সূর্যতোরণ’ (’৫৮) ছবিটি ভিন্ন ধরনের ছিল। অনেক সমবালয় সংলাপের পরিবর্তে গানের মধ্য দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ পায়। এখানে একটি নেপথ্য গান ছিল। গানের কথা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর ও কণ্ঠে গাওয়া — ‘‘ তুমি তো জান না, আমার এ হাসিতে/কত ব্যথা ঢেকে রেখেছি’’ ...। ওই বছরে একই গীতিকার ও সুরকারের দায়িত্বে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় মঙ্গল চক্রবর্তীর ‘শিকার’ ছবিতে গাইলেন — ‘‘সরমে জড়ানো আঁখি মুখপানে মেলে রাখি/বল কিছু আমি শুনি’’ ...। ইন্দ্রানী ছবিটি নীরেন লাহিড়ীর পরিচালনা ছিল। নচিকেতা ঘোষের সুরে ও শৈলেন্দ্রর (মুম্বাই) গীত রচনায় একটি হিন্দি গান ব্যবহার করেছিলেন। গানটির দৃশ্যায়ন ছিল এককথায় চমৎকার। একজন মুসাফিরের লিপে মহম্মদ রফির গাওয়া গানটি — ‘‘সব্হি কুছ্ লুটাকর হুয়ে হম তুম্হারে/কি হ্যয় জিৎ উস্কি যো দিল্ আজ হারে’’...।
ছয়ের দশকের গোড়াতেই কিছু অন্য ধরনের ছবি তৈরির প্রচেষ্টা যেমন হয়েছিল, তেমনই সুন্দর গানেরও প্রয়োগও হয়েছে। যেমন অসিত সেনের ‘দ্বীপ জ্বেলে যাই’ (১৯৫৯) একটি মানসিক চিকিৎসালয়কে কেন্দ্র করে ছবিটি তৈরি হয়। একজন মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীর একটি ছোট্ট চরিত্রে অনিল চট্টোপাধ্যায় অসাধারণ অভিনয় করেন। তাঁরই লিপে মান্না দে-র গাওয়া— ‘‘এমন বন্ধু আর কে আছে/তোমার মত মিস্টার। কখনো বা ডালিং কভু তুমি জননী/কখনো বা স্নেহময়ী সিস্টার’’ ...। গানটির মধ্যে যেন কত আকুতি ছিল। এ ছবির অপর গানটি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া —‘‘এই রাত তোমার আমার/ঐ চাঁদ তোমার আমার/শুধু দুজনে’’ ...। দুটি গানের কথা ও সুর গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আজও গানগুলি বারবার শোনা যায়।
বিকাশ রায় অভিনয়ের পাশাপাশি কয়েকটি ছবিও পরিচালনা করেন। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ছবি ছিল ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ (১৯৫৯)। এ ছবির সুর ও কথার দায়িত্বে ছিলেন সেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। এঁরা একটা সময় ধরে জুটি বেঁধেছিলেন। একটার পর একটা ছবিতে সাফল্যও পেয়ে এসেছেন। এই ছবির সংক্ষিপ্ত ঘটনা ছিল — দুর্গম পথ দিয়ে হিংলাজের দিকে একদল তীর্থযাত্রী নিজেদের মনোস্কামনা পূর্ণ করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে অনেক কষ্ট স্বীকার করেও। যাত্রাপথে এ ছবিতে গান এসেছে। এ ছবিতে একজন ছড়িদারের ভূমিকায় একটি পার্শ্বচরিত্রে অনিল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন, তাঁরই লিপে দুটি গান ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। প্রথম গানটি : তোমার ভুবনে মাগো এত পাপ/এ কি অভিশাপ — নাই প্রতিকার’’ ...। অপর গানটি : ‘‘পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব/মাগো বল কবে শীতল হব’’...। এ গানের জনপ্রিয়তা দশকের পর দশক রয়েই গেছে।
ঐ বছরে মঙ্গল চক্রবর্তীর ছবি ‘সোনার হরিণ’ ছবিটিতে গীতা দত্ত’র গাওয়া গান একজন বার সিঙ্গারের লিপে ছিল। গীতা দত্ত’র নিজস্ব ঢঙে গাওয়া গানটি অন্যমাত্রা এনে দেয় ছবিতে। গানটি লিপ দিয়েছিলেন নমিতা সিন্হা। গানটি ছিল, ‘‘এই মায়াবী তিথি/এই মধুর গীতি’’...। গানের কথা ও সুর গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজে ছবি প্রযোজনা করেন ‘নীল আকাশের নীচে’ (’৫৯)। ছবিতে সুর রচনা তাঁরই ছিল এবং অবশ্যই গীতিকার ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। মৃণাল সেন পরিচালিত এই ছবিতে এক চীনের মনুষের চরিত্রে কালী বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনয় করেন। চরিত্রটির নাম ছিল ওয়াংলু। এ ছবির দুটি গান আজও কালজয়ী হয়ে রয়েছে। প্রথম গানটি, ‘‘ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে/বল কোথায় তোমার দেশ, তোমার নেই যে চলার শেষ’’ ...। অন্যটি, ‘‘নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী/পৃথিবীর পরে ঐ নীলাকাশ/তুমি দেখেছ কি’’ ...।
রাজেন তরফদারের গঙ্গা (’৬০) একটি বিখ্যাত ছবি। পশ্চিমবঙ্গের মৎসজীবীদের জীবন সংগ্রামের কাহিনী নিয়ে তোলা। এ ছবিতে দেখা গেছে তাঁরা বছরের বেশিরভাগ সময় জলে ভাসেন, তার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের গান ব্যবহার হয়। মূলত লোকসঙ্গীতই, দায়িত্বে ছিলেন নির্মলেন্দু চৌধুরী। ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেন সলিল চৌধুরী। এ ছবিতে কয়েকটি গান উল্লেখযোগ্য। যেমন মান্না দে-র গাওয়া, ‘‘আমায় ডুবাইলিরে/আমায় ভাসাইলিরে/অকুল দরিয়ার বুঝি কুল নাই রে’’ ...। অথবা— ‘‘ইচ্চা করে ও পরানডারে/গামছা দিয়ে বান্ধি’’ ...। এই গানটি পঙ্কজ মিত্রের গাওয়া।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পাশাপাশি সেই সময় শ্যায়মল মিত্রের জনপ্রিয়তাও কম ছিল না। ইনি বহু নায়কের লিপে যেমন গান গেয়েছেন, পাশাপাশি নেপথ্যেও তাঁর গান শোনা গেছে। তিনি সুরকার হিসাবেও সফল। যেমন ১৯৬৩-র তিনটি ছবিতে কখনো সুরকার কখনো কণ্ঠ দেন। প্রথমে গুরু বাগচী পরিচালিত ‘দ্বীপের নাম টিয়া রং’, কথা ও সুর ছিল প্রণব রায় ও রবীন চট্টোপাধ্যায়ের। এই ছবির গানটি একদম ভিন্ন ধরনের ছিল। ‘‘পীরিতি বসত কুরে যি দিশে/সিথা গিয়া ভিড়াই সাম্পান/আমি চান্দেরই সাম্পান যুদি পাই/সাত সাগরে পাড়ি দিয়া তরে নিয়া যাই’’ ...।
‘ভ্রান্তিবিলাস’-এর পরিচালক মানু সেন। ছবির দৃশ্যটি ছিল এইরকম — ভোর হয়ে আসছে, ছবিতে নায়ক বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার মূহুর্তে গানটি নেপথ্যে ভেসে আসে — ‘‘সেই বাসরও নেই, বাঁশরী নেই/ভোর যে হ’য়ে গেল’’ ...। গানের কথা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের ও সুর শিল্পী নিজেই ছিলেন।
‘দেয়ানেয়া’ সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ছবিটি গান ও হাসিতে ভরা ছিল। ছবিটিতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সেই বিখ্যাত গান —‘‘এ গানে প্রজাপতির পাখায় পাখায় রঙ ছড়ায়/এ গানে রামধনু তার/সাতটি রঙের দোল ঝরায়’’ ...। ছবিটিতে দেখা গেছে একজন নবাগতা গায়িকা গানটি রেকর্ড করছেন, ঐ শিল্পীকে একটি দৃশ্যেই দেখা যায়। এরকমভাবে অজস্র গান বারবার ছবিতে এসেছে। যেমন পিনাকি মুখোপাধ্যায়ের ‘অশান্ত ঘূর্ণী’ (’৬৪) ছবিতে রাজেন সরকারের সুর ও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে, ‘‘লজ্জায় থর থর বৃষ্টি, বৃষ্টি গো/সন্ধ্যায় ঝর ঝর বৃষ্টি’’ ...। ঐ বছরেই সুশীল মজুমদারের ‘লালপাথর’। সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে শ্যামল মিত্র ও সবিতা চৌধুরী গাওয়া—‘‘ডেকো না মোরে ডেকো না গোর আর/ডেকো না অমন করে’’...। গানটিতে লিপ দিয়েছিলেন নির্মলকুমার ও শ্রাবনী বসু।
১৯৬৫তে অগ্রদূত পরিচালিত সূর্যতপা ছবিতে গৌরীপ্রসন্নর কথায় ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে দুটি গান সন্ধ্যা ও হেমন্তর কণ্ঠে—‘‘ওগো স্বপ্ন ভ্রমর গুন গুন গুন সুরে গাও/আহা কেন ডাকে না/কাছে থাকো না’’ ...। অন্যটি—‘‘সব কিছু বোঝানো কি যায়? মনের গভীরে যে কথা লুকায়ে থাকে’’ ...। দুটি গানই ছিল বার সিঙ্গারের লিপে।
১৯৬৬-তে ‘মণিহার’ ছবিটি সলিল সেন পরিচালনা করেন। সেই ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুর দেন, গান রচনা করেছিলেন মুকুল দত্ত ও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ছবির সব গানই হিট ছিল। একটি গানের কথাই উল্লেখ করা হলো। সুমন কল্যানপুরের গাওয়া, ‘‘দুরে থেকো না/আরো কাছে এসো/পরশ করে দেখো আমায়’’ ...।
ঐ বছরেই পীযূষ বসু পরিচালিত অপরেশ লাহিড়ীর সুরে ‘সুভাষচন্দ্র’ ছবিতে একটি দেশাত্মবোধক গান ব্যবহার করা হয় এবং সেটি আজ ও কানে বাজে। লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া—‘‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’’...।
উত্তমকুমার সুরকার হিসাবেও সার্থক। প্রথম সঙ্গীত পরিচালনা করেন ‘কাল তুমি আলেয়া’(’৬৬)। এ ছবিতে তিনটি গান ব্যবহার করেন। গানের কথা ছিল পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। একটি নেপথ্যে ও অপর দুটি পার্শ্বচরিত্রের লিপে। আশা ভোঁসলের গাওয়া প্রথম গানটি ছিল —‘‘আহা পাতা কেটে চুল বেঁধে কে/টায়রা পরেছে/কেগো, খোঁপার পাশে পাশ-চিরুনী/বাহার করেছে। অপর গানটি ছিল একজন বাঈজীর লিপে যে চরিত্রে অভিনয় করেন নীলিমা দাস। গানটি ছিল —‘‘আমার মনের মানুষ ফিরলো ঘরে/একটু বেশি রাতে’’ ...। ছবির শেষ গানটি ছিল নেপথ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে—‘‘যাই চলে যাই/আমারে খুঁজো না তুমি/বন্ধু বুঝোনা ভুল কাল সে আলেয়া শুধু ... তিনটি গান জনপ্রিয় হয়।
১৯৬৭তে অরুন্ধতী দেব পরিচালিত ও সুরারোপিত ‘ছুটি’ ছবিতে নবাগতা নন্দিনী মালিয়ার লিপে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া সেই কালজয়ী গান— ‘‘আমার হাত ধরে/তুমি নিয়ে চল সখা/আমি যে পথ চিনি না’’ ...। অন্যটি —‘‘আমার জীবন নদীর ওপারে/এসে দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে’’...।
৬০’র দশকের একদম শেষে এসে ‘বাঘিনী’ (’৬৮)। বিজয় বসু এ ছবির প্রতিটি গানই পার্শ্বচরিত্রে লিপে ব্যবহার করেন। পুলক বন্দোপাধ্যায়ের ও মুকুল দত্ত’র কথায় এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর রচনায় সব কটিই গানটি সিনেমার ভাষায় সুপারহিট। একজন বৈরাগীর লিপে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের দুটি গান। প্রথমটি —‘‘যখন ডাকলো বাঁশী/তখন রাধা যাবেই যমুনায়’’ ...। অন্যটি—‘‘ও রাধে থমকে গেলি কেন/চলতে গিয়ে পায়ের কাঁটা/বিঁধলো বুকে যেন’’ ...। মান্না দে’র গাওয়া গানটি একজন গো-চালকের লিপে ছিল। ‘‘ও কোকিলা তোরে শুধাইরে/সবারই তো ঘর রয়েছে’’ ...। এইভাবে লতা ও আশার কণ্ঠে— ‘‘যদি ও রজনী পোহালো তবুও/দিবস কেন যে এলো না’’ ...। অথবা—‘‘মন নিয়ে কি মরব না কি শেষে (ও আমি)/পিরিতের আগুন তোরা নিভিয়ে দে না এসে’’ ...।
৭০ দশকেরও বেশ কিছু গান বেশ জনপ্রিয় হয়। ‘পান্না হীরে চুনি’ (’৬৯) অমল দত্ত পরিচালিত অজয় দাশ সুরারোপিত (সম্ভবত প্রথম সুর রচনা করেন) শ্যামল মিত্র, পিন্টুক ভট্টাচার্য ও চন্দ্রানী মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের গানগুলি মানুষের মুখে মুখে ফিরতো। যেমন, ‘‘আজি এই আসরে আমার/তোমরাই বন্ধু —এ বেদনা জানাবার’’ ...। আরেকটি ‘‘সহসা এল বরষা বৈশাখে’’ ...। অথবা ‘‘বলনা বলনা নেশা নেশা ভালবাসা’’ ...। একই বছরে হরিসাধন দাশগুপ্ত’র ‘কমললতা’ য় রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ও প্রণব রায়ের কথায় শ্যামল মিত্রের গাওয়া—‘‘সে বিনে আর জানে না/জানে না এ মন’’...। অন্য গানটি, ‘‘ও মন কখন শুরু/কখন যে শেষ কে জানে/এ যে বাজিকরের খেলা রে ভাই’’ ...।
নিশিপদ্ম (’৭০) অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ও নিজেরই লেখা নচিকেতা ঘোষের সুরে শ্যামল মিত্রের একদম নতুন আঙ্গিকে গাওয়া গান—‘‘রাজার পঙ্খী উইড়্যা গেলে/রাজা নতুন পঙ্খী বান্ধে’’...। পরের বছর ঐ একই পরিচালকের ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবিটি আগাগোড়া হাসির ছবি। ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে এ ছবি এগিয়েছে। এ ছবির সব গানও আজ সমানভাবে জনপ্রিয়। এ ছবির সুরকারও নচিকেতা ঘোষ এবং গীতিকার ছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রণব রায়। মান্না দে’র কণ্ঠে — ‘‘লাঠিবাজি হকি নয়/সব খেলার সেরা বাঙালীর তুমি ফুটবল’’ ...। এই গানটি কোরাসে, বহু পার্শ্বচরিত্রের লিপ ছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের গান দুটি ছিল বৈরাগীদার লিপে। ‘‘এ ব্যাথা কি যে ব্যথা/বোঝে কি আনজনে’’ ...। অন্যটি, ‘‘রাধে মনটারে রেখে এলি/বল কোন মথুরায়’’ ...।
একই বছরের অগ্রদূতের ‘ছদ্মবেশী’তে সুধীন দাশগুপ্ত’র সুরে অনুপ ঘোষালের কণ্ঠে একটি গান বিখ্যাত হায়ে আছে। ড্রাইভারের চরিত্রে জহর রায়ের লিপে গানটি ব্যবহার করা হয়। ‘‘আরে ছো ছো ছো ছো ক্যা সরম্ কী বাত্/ভদ্দর ঘরকা লড়কী ভাগে ডেরাইভারকা সাথ্’’ ...।
সলিল দত্ত’র ‘স্ত্রী’(’৭২) ছবির একটি নেপথ্য গান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে জনপ্রিয় হয়। গানের কথা পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ছবিতে বিচ্ছেদের দৃশ্যে এই গানটি শোনা যায়। গানটি ছিল—‘‘সাক্ষী থাকুক ঝরাপাতা/আকাশ বাতাস সাক্ষীো থাকুক/সাক্ষী থাকুক বনলতা’’ ...। গানটির দৃশ্যায়ন এককথায় চমৎকার।
উত্তমকুমার পরিচালিত ‘বনপলাশীর পদাবলী’ (’৭৩)-তে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুর ও কণ্ঠে একটি নেপথ্যে গান শোনা যায় তখনই, যখন ছবিতে নায়কের ফাঁসির আদেশ হয়ে যায়। গানটি ছিল—‘‘এই তো ভবের খেলা/সাগরে মিশিলে নদীর মরণ নাহি হয়’’...।
সত্তরের দশকেই মান্না দে’র কণ্ঠে কয়েকটি নেপথ্যে গান বিভিন্ন ছবিতে দেখা যায়। যেমন নিজেরই সুর করা ‘শেষপৃষ্ঠায় দেখুন’, বা ‘রৌদ্রছায়া’, ‘সুজাতা’, ‘বাঘবন্দী খেলা’, ‘হারমোনিয়াম’ প্রভৃতি ছবির গানগুলি আজও বেশ জনপ্রিয়।
বাংলা ছবিতে ছোটদের ছবি খুব বেশি না হলেও বিভিন্ন সময় ছবির শিশুশিল্পীর লিপে বহু গান ব্যবহার হয়েছে। উল্লেখযোগ্য হলো, তপন সিন্হার ‘কাবুলীওয়ালা’, অগ্রদূতের ‘বাদশা’, সুনীল বসু মল্লিকের ‘জয়জয়ন্তী’ উমাপ্রসাদ মৈত্র’র ‘এক যে ছিল বাঘ’, অজিত গাঙ্গুলির ‘হংসরাজ’, গুরু বাগচীর ‘জয়’, জয়ন্ত সাহার ‘বালক শরৎচন্দ্র’।
এই ছবিগুলিতে কখনো রানু মুখোপাধ্যায়, শিপ্রা বসু, চৈতি রায়, শ্রাবন্তী মজুমদার, হৈমন্তী শুক্লা, এবং আরতী মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে গাওয়ানো হয়। বাংলা ছবিতে এমন কোন নায়িকা নেই যে তাঁদের লিপে আরতী গান গেয়েছেন। তবুও একটা সময় শিশু শিল্পীদের লিপে তাঁর গান অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। যেমন ‘জয়জয়ন্তী’, ‘হংসরাজ’ (সে বছরের সেরা গায়িকা নির্বাচিত হন) ছাড়াও ‘মান অভিমান’, ‘লাট্ট’, ‘হীরেমানিক’, ‘দুষ্টুমিষ্টি’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘শত্রু’ প্রভৃতি ছবিতে তাঁর সুমধুর কণ্ঠ শোনা যায়। এই গানের কথা সেই গৌরীপ্রসন্ন ও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সুধীন দাশগুপ্ত, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অজয় দাশ ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মত সুরকারেরা।
৮০’র দশকে এসে গান কিছুটা থমকে যায়। গানের কথা ও সুরের পরিবর্তন আসে, নেপথ্য গানও তাঁর জনপ্রিয়তা হারায়। তবুও তারই মধ্যেই দু’একটি গান শোনা যায়। যেমন নির্মল সবজ্ঞর জি টি রোড ছবিটিতে অনল চট্টোপাধ্যায়ের সুর করা শ্যামল মিত্রের গাওয়া—‘‘এই পথেই জীবন/এই পথেই মরন আমাদের’’ ...। অথবা তপন সাহার ‘উপলব্ধি’ ছবিতে একই সুরকার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে গাওয়ান—‘‘গোলাপের আতর আছে/এসেছ তাই আমার কাছে’’ ...।
গান তখনই জনপ্রিয় হয়, দক্ষ সুরকার, গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পীাদের সমন্বয়ে, নেপথ্যের যন্ত্রসঙ্গীতকারদের নিয়ে। সেকারণেই ঐ সময়ের ছবির গানগুলি বহুশ্রুত হলেও আজও শুনতে ভাল লাগে। নস্টালজিয়া’য় ভোগায়।
বাংলাদেশ সময় ১৬১৫, নভেম্বর ২০, ২০১১