ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

কোরবানির ইতিহাস ও তাৎপর্য

মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৫২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১১
কোরবানির ইতিহাস ও তাৎপর্য

রাসূল (সা) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা আজহার দিনকে এ উম্মতের জন্য মনোনীত করে এতে ঈদ প্রবর্তনের জন্য আমাকে আদেশ করছেন। ’ যে বিষয়গুলো ঈদুল আজহাকে সার্থক ও আলোকোজ্জ্বল করেছে তার মধ্যে কোরবানি অন্যতম বিধান।


আরবি ‘কোরব’ ধাতু থেকে কোরবানি অথবা সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্য উৎসর্গিত বস্তু। ইসলামি পরিভাষায় আল্লাহর সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আল্লাহরই নামে নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট নিয়মে নির্দিষ্ট পশু জবাই করাকে কোরবানি বলে (ফতওয়ায়ে শামি)। কোরবানি উম্মতে মুহাম্মদির জন্য কোনো বিশেষ প্রথা বা অভিনব হুকুম নয়। মৌলিক ইবাদতের পাশাপাশি এ কোরবানি প্রথা হজরত আদম (আ.) থেকে এ পর্যন্ত সব শরিয়তেই বিদ্যমান ছিল। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে¬ ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানি নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেওয়া চতুষ্পদ জন্তু জবাই করার সময় তাঁর নাম স্মরণ করে’ (সূরা আল-হজ, আয়াত-৩৪)।

ইসলামি শরিয়তে কোরবানির গুরুত্ব অপরিসীম। রাসূল (সা.) বলেছেন,¬ ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে’ (ইবনে মাজাহ)। পূর্ববর্তী শরিয়তের কোরবানি ও উম্মতে মুহাম্মদির কোরবানির উদ্দেশ্য এক হলেও পদ্ধতিগত বিধানের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।
সাহাবাদের কোরবানি সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে রাসূল (সা.) বলেছিলেন,¬ ‘সুন্নাতা আবিকুম ইবরাহিম’ অর্থাৎ এটা তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম আঃ-এর প্রতিষ্ঠিত আদর্শ (ইবনে মাজাহ)।
হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর কোরবানি মূলত মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে একটি মহান পরীক্ষাস্বরূপ ছিল। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে,¬ ‘নিশ্চয়ই এটা ছিল সুস্পষ্ট পরীক্ষা’ (সূরা সাফফাত-আয়াত-১০৬)। পবিত্র কুরআনের সূরা আস সাফফাত, ৯৯ থেকে ১১৩ নম্বর আয়াতে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর কোরবানি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। একান্ত প্রার্থনায় ৮৬ বছর বয়সে হজরত ইবরাহিম (আ. পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে লাভ করেন। তাফসিরে মাজহারির বর্ণনা মতে, হজরত ইসমাঈল (আ.)-এর বয়স যখন ১৩ বছর (মাত্র বালেগ), তখন পিতা ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্নে দেখেন, তিনি প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাঈল-কে (আ.) জবাই করছেন। (কোনো কোনো তাফসিরে বর্ণিত আছে¬, এ স্বপ্ন হজরত ইবরাহিমকে (আ.) তিনবার দেখানো হয়)। আম্বিয়া কেরামের স্বপ্ন যেহেতু ওহি হিসেবে গণ্য, তাই তিনি ৯৯ বছর বয়সে প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.)-এর সম্মতিক্রমে আল্লাহর আদেশ পালনার্থে প্রস্তুত হন। কিন্তু শয়তান পিতা-পুত্রের সে সাধনায় বাদ সাধে। মহামহিম আল্লহতায়ালার সে অগ্নিপরীক্ষায় পিতা ইবরাহিম (আ.) ও পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর আত্মত্যাগ যেন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, শয়তান সে লক্ষ্যে তিন তিনবার ধোঁকা দেয়। প্রতিবারেই পিতা-পুত্র পর্বতসম ঈমানী চেতনা নিয়ে সে চক্রান্ত প্রতিহত করেন। ২১টি প্রস্তর নিক্ষেপে শয়তানকে নিরাশ করে তারা সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। (এ জন্যই হাজিরা মিনায় শয়তানকে ২১টি পাথর নিক্ষেপ করেন। ) তাদের উভয়ের প্রতি আল্লাহ খুশি হয়ে পুত্র ইসমাঈলের পরিবর্তে ফেরেস্তাদের দ্বারা আনীত পশু কোরবানির ব্যবস্থা করেন।
উম্মতে মুহাম্মদির কোরবানি হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর কোরবানিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর গোটা জীবন ছিল কোরবানি তথা অতুলনীয় আত্মোসর্গ ও আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল। প্রিয় পুত্র ইসমাঈলকে কোরবানি করা ছিল ইবরাহিমি জীবনের অসংখ্য কোরবানির চরম ও শ্রেষ্ঠতম ঘটনা।
‘কোরবানি’ ও ‘ইসলাম’ উভয়‌ আনুগত্য, আত্মসমর্পণ, আত্মত্যাগ ও উৎসর্গীকরণের অর্থ বোঝায়। তাই পবিত্র কুরআনে ইবরাহিমি কোরবানির এ মহান আদর্শ ‘ইসলাম’ শব্দের মাধ্যমে প্রকাশিত। এরশাদ হয়েছে : ‘ইজ কলা লাহু আসলিম, কলা আসলামতু লি-রাব্বিল আলামিন’ অর্থাৎ তার প্রতিপালক যখন তাকে (ইবরাহিমকে) বলছিলেন আত্মসমর্পণ করো, তিনি বললেন, বিশ্বজগতের প্রতিপালকের কাছে আত্মসমর্পণ করলাম (সূরা বাকারাহ, আয়াত-১৩১)। ওই আয়াত প্রমাণ করে যে, ইবরাহিমি মিল্লাতের মৌলিক নীতি ও স্বরূপ ‘ইসলাম’ শব্দের মধ্যেই নিহিত (মা’রেফুল কুরআন, মাওলানা মহিউদ্দীন খান অনূদিত পৃষ্ঠা ৬৭)। শুধু তাই নয়, হজরত ইবরাহিম (আ.)আল্লাহর কাছে দোয়া করছিলেন¬ ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে (ইবরাহিম ও ইসমাঈল) মুসলিম (আনুগত্যশীল) করো এবং আমাদের বংশধর থেকেও একদলকে আনুগত্যকারী করো। ’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১২৮)।

উম্মতে মুহাম্মদি তথা মুসলমান তারই দোয়ার ফসল। আগেই তিনি এ জাতির নাম মুসলমান রেখেছিলেন। এরশাদ হয়েছে, ‘এটা তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আ.-এর ধর্ম। তিনিই ইতঃপূর্বে তোমাদের ‘মুসলমান’ নামকরণ করেছেন এবং এতেও (কুরআনে) এ নাম রাখা হয়েছে (সূরা হজ, আয়াত-৭৮)। ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনাদর্শে মুগ্ধ হয়ে মহান আল্লাহতায়ালা উম্মতে মুহাম্মদিকে তাঁর আদর্শের প্রতি দীক্ষিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘বলো আল্লাহ সত্য বলেছেন, অতঃপর একনিষ্ঠভাবে ইবরাহিমী মিল্লাত অনুসরণ করো’ (সূরা আল ইমরান, আয়াত-৯৫)। সূরা মুমতাহিনায় এরশাদ হয়েছে ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য হজরত ইবরাহিমের মধ্যে উৎকৃষ্ট আদর্শ বিদ্যমান রয়েছে’ (আয়াত-৪)।
কোরবানির তত্ত্বকথা

আল্লাহতায়ালা ফরমান ‘অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন’ (সূরা কাওসার)। নামাজ শারীরিক ইবাদতগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ এবং কোরবানি আর্থিক ইবাদতের মধ্যে স্বতন্ত্র ও বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। কোরবানি তাকওয়া অর্জনের শিক্ষা দেয়। মহান আল্লাহ বলেন,¬ ‘আল্লাহর কাছে এর (কোরবানির পশুর) গোশতও পৌঁছে না, রক্তও না; তবে তোমাদের অন্তরের তাকওয়া পৌঁছে থাকে (সূরা হজ, আয়াত-৩৭)। আলোচ্য আয়াতে এ কথার উদ্দেশ্য যে, কোরবানি একটি মহান ইবাদত; কিন্তু আল্লাহর কাছে এর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না এবং কোরবানির উদ্দেশ্যও এটা নয়; বরং আসল উদ্দেশ্য জন্তুর ওপর মহান আল্লাহর নাম স্মরণ করা এবং আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর আদেশ পালন করা। অন্যান্য ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যও তাই। নামাজে ওঠা-বসা করা, রোজায় ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকা আসল উদ্দেশ্য নয়; বরং আল্লাহর আদেশ পালন করাই উদ্দেশ্য। আন্তরিকতা ও মহব্বত বর্জিত ইবাদত প্রাণহীন কাঠামো মাত্র (তাফসিরে মা’রেফুল কুরআন, মাওলানা মহিউদ্দীন খান অনূদিত, পৃষ্ঠা ৯০২)। তত্ত্বজ্ঞানীদের মতে, পশু কোরবানি মূলত নিজের নফস তথা মন্দ প্রবৃত্তিকে কোরবানি করার প্রতীক (আহকামুল কুরআন দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৯৬)। তাই পশু কোরবানির পাশাপাশি কুফর, শিরক, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ, রিয়া, পরনিন্দা, অহঙ্কার, কৃপণতা, ধন-লিপ্সা, প্রভুত্ব-প্রিয়তা, সম্মান-কামনা দুনিয়ার মায়া-মহব্বত এবং আরো ও অসংখ্য পাপ-পঙ্কিলতা ও কলুষতার মর্মমূলে ছুরি চালাতে হবে। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্য, আজ্ঞাপালন ও তাকওয়ার দ্বিধাহীন শপথ গ্রহণ করতে হবে। আর এখানেই কোরবানির গুরুত্ব, তাৎপর্য, শিক্ষা ও সার্থকতা নিহিত। মহান আল্লাহ আমাদের সে শিক্ষাই দিচ্ছেন¬, ‘আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার কোরবানি এবং আমার জীবন-মরণ বিশ্ব পালনকর্তা আল্লাহর নিমিত্তে উৎসর্গিত (সূরা আনআম, আয়াত-১৬২)।
 
সূত্র : ধর্মীয় ওয়েবসাইট
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২২৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ