ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

আসছে সাংগ্রাইং, পাহাড় জুড়ে উৎসবের আমেজ

সাইফুল আলম বাবলু, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০১৬
আসছে সাংগ্রাইং, পাহাড় জুড়ে উৎসবের আমেজ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বান্দরবান: আর ক’দিন পরই আসছে মারমা সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব সাংগ্রাই। এরই মধ্যে পাহাড় জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে উৎসবের আমেজ।

 

সাংগ্রাইমা, ঞি ঞি ঞা ঞা, রিক্জে গে পা মে’-এসো মিলি সাংগ্রাই এর মৈত্রী পানি বর্ষণের উৎসবে-ঐতিহ্যবাহী এ মারমা গানের সুর মূর্ছনায় এখন উদ্বেলিত পাহাড়ি জনপদ বান্দরবান।

বর্ষবরণকে ঘিরে আদিবাসী পল্লীগুলোতে শুরু হয়েছে উৎসবের ধুম। নতুন জামা-কাপড় কেনা, পিঠা তৈরি, ঘর সাজানো, বৌদ্ধ বিহারে ধর্মীয় গুরুদের জন্যে খাবার নিয়ে যাওয়া সর্বোপরি মৈত্রী পানিবর্ষণের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস-সব মিলিয়ে পুরো জেলার সবক’টি সম্প্রদায়ের মানুষ এখন একাট্টা হয়েছে নতুন বছরকে বরণ করে নিতে।


পুরনো দিনের সমস্ত গ্লানি ধুয়ে মুছে নতুনের আয়োজনে এখন ব্যস্ত সবাই। আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোর এসব আয়োজনের সঙ্গে বাঙালিদের পহেলা বৈশাখ উদযাপনের প্রস্তুতি মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে পাহাড়ি জেলা বান্দরবানে।

সাংগ্রাই উৎসব উদযাপন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) থেকে পুরাতন রাজবাড়ি মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে সাংগ্রাই পোয়ে উৎসবের সূচনা হবে। বান্দরবান জেলা প্রশাসন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, সাংগ্রাই উৎসব উৎযাপন পরিষদ, বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা, ম্রোচেটের সহায়তায় সাংগ্রাই উৎসব পালনে পাঁচ দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শোভাযাত্রা, শিশু চিত্রাঙ্কণ প্রতিযোগিতা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে।

বুধবার (১৩ এপ্রিল) বিকেলে স্থানীয় খ্যংওয়া ক্যং (বিহার) ও খ্যংফিয়া ক্যং থেকে বুদ্ধমূর্তি স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হবে উজানী পাড়ার সাঙ্গু নদীর ঘাটে। এরপর রাতে পাম্প হাউজ, উজানী পাড়া ও এলাকার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে পিঠা তৈরির আয়োজন।


বৃহস্পতিবার (১৪ এপ্রিল) বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনের আয়োজনে ঐতিহ্যবাহী রাজার মাঠ থেকে বর্ণাঢ্য আনন্দ শোভাযাত্রা, যেমন খুশি তেমন সাজ, পান্তা ইলিশ উৎসব ও লোকজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিকেলে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সম্প্রীতির মঞ্চে বৈশাখী পিঠা উৎসব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।

শুক্রবার (১৫ এপ্রিল) থাকছে বান্দরবানে সাংগ্রাই উৎসবের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য আয়োজন। এদিন অনুষ্ঠিত হবে উৎসবের মূল আকর্ষণ মৈত্রী পানিবর্ষণ। একই দিন সন্ধ্যায় উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে রাজবাড়ি মাঠে অনুষ্ঠিত হবে আদিবাসী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

শনিবার (১৬ এপ্রিল) রয়েছে একই ধরনের অনুষ্ঠানমালা। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে থাকবে বৌদ্ধ মন্দিরে যাত্রা, ধর্ম দেশনা শ্রবণ, শীল গ্রহণ ও উৎসর্গের মাধ্যমে ৫ দিনব্যাপী সাংগ্রাই উৎসব শেষ হবে রোববার (১৭ এপ্রিল)।

এছাড়াও জেলা সদরের রেইছা, সুয়ালক, রাজবিলা, কুহালং এবং রোয়াংছড়ি, থানচি ও রুমা উপজেলায় আদিবাসী মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যারা বৈসাবি উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে।

এসব অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর ঊশৈসিং এমপি প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।

এছাড়াও বিশেষ অতিথি হিসেবে পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা, জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক, পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান ও বান্দরবান পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ ইসলাম বেবী বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।


এদিকে সাংগ্রাইং উৎসব উপলক্ষে পর্যটন শহর বান্দরবানে নেমেছে পর্যটকের ঢল। জেলার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে মারমা অধ্যুষিত এলাকাগুলোসহ বিভিন্ন স্থানে অতিরিক্ত নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে বলে জানান পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান।

যেভাবে বৈসাবি হয়
ত্রিপুরাদের বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই, চাকমাদের বিজু আর তঞ্চঙ্গ্যাদের বিষু উৎসবের সম্মিলিত নামই বৈসাবি। পুরনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার জন্য বৈসাবি শুরুর দিনে বুনো ফুলের সমারোহে ঘরদোর সাজানো, পুরনো সমস্ত কালিমা ধুয়ে ফেলার জন্য বাড়িঘর নতুন আঙ্গিকে পরিচ্ছন্ন করে তোলা, পিঠা উৎসবে মেতে ওঠা আর প্রবীণদের কাছে নতুন বছরের শুভ কামনায় আশীর্বাদ নেওয়া হয়।
 
চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরারা বছরের শেষ দুই দিন অর্থাৎ চৈত্র মাসের ২৯ ও ৩০ তারিখ এবং নতুন বছরের প্রথম দিন-এ তিন দিন বৈসাবি উৎসব উদযাপন করে। চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যারা চৈত্র মাসের ২৯ তারিখকে ফুল বিজু, ৩০ তারিখকে মূল বিজু ও বছরের প্রথম দিনকে গজ্যাপজ্যা দিন বলে। আর ত্রিপুরারা চৈত্র মাসের ২৯ তারিখকে হারি বৈসু, ৩০ তারিখকে বৈসুকমা ও বছরের প্রথম দিনকে বৈসুভিমঃ বলে থাকেন।

বৈসাবিকে মার্মারা সাংগ্রাইং, ম্রোরা চাংক্রান, খেয়াংরা সাংগ্রান, খুমীরা সাংগ্রায় বলে থাকেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে একই ভাষাগোষ্ঠীর বম, লুসাই ও পাংখোয়ারা বৈসাবি উৎসব উদযাপন করেননা। তারা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হওয়ায় খ্রিস্টান ধর্মীয় উৎসবই উদযাপন করে থাকেন। মার্মারা চারদিন ধরে সাংগ্রাই পোয়ে উৎসব উদযাপন করে থাকেন। প্রথম দিনকে সাংগ্রাইং আক্রো বা সাংগ্রাই এর আবাহন, দ্বিতীয় দিনকে সাংগ্রাই আক্যোয়া, তৃতীয় ও চতুর্থ দিনকে সাংগ্রাইং অ্যাথা বলা হয়।

উৎসবের দ্বিতীয় দিন থেকে মূলতঃ মার্মাদের ঐতিহ্যবাহী মৈত্রী পানিবর্ষণ উৎসব শুরু হয়। তৃতীয় ও চতুর্থ দিন পর্যন্ত এ পানিবর্ষণ উৎসব চলে। পাড়ায় পাড়ায় ছেলে-বুড়ো, যুবক-যুবতী সবাই মৈত্রী জলধারায় সিক্ত করে একে অন্যকে। মারমা নারী-পুরুষ পৃথক দলে বিভক্ত হয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পানি বর্ষণ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন।

সাধারণত নারী দলের জন্য একটি নৌকা ভর্তি করে পানি রাখা হয়। আর পুরুষ দলের জন্য পানি রাখা হয় বড় ড্রামে। কোনো দলের সদস্যের হাত থেকে পানির পাত্র পড়ে গেলে, কেউ হাত দিয়ে মুখের পানি মুছলে বিচারের রায় ক্রমশ তাদের বিপক্ষে চলে যায়। এভাবে মারমা গানের সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট সময় পরে বিচারকরা প্রতিযোগিতার রায় ঘোষণা করেন।

আগে এ উৎসব শুধু মারমা যুবক যুবতীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও গত কয়েক বছর ধরে বয়স্করাও দল বেঁধে এ উৎসবে যোগ দিতে শুরু করেছেন।
 
এ পানিবর্ষণ উৎসবের মধ্য দিয়েই মার্মা আদিবাসীরা বিদায়ী বছরের সমস্ত দুঃখ বেদনা, পারষ্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েন ধুয়ে মুছে ফেলে নতুন বছরের জন্য একে অপরের বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করে নেয়। এছাড়া ঐতিহ্যবাহী পিঠা উৎসবসহ সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে মার্মা জনপদগুলো মুখরিত হয়ে ওঠে।

সাংগ্রাই উদযাপন কমিটির সভাপতি মংচিংনু মারমা জানান, প্রতি বছরের মতো এবারও মারমা সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব সাংগ্রাই জাকজমকপূর্ণভাবে উদযাপন করা হবে। এটি মারমা সম্প্রদায়ের উৎসব হলেও জেলার বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের অংশগ্রহণে তা সার্বজনিন উৎসবে পরিণত হয়। এ উৎসবের মাধ্যমে বান্দরবানের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন আরও সুদৃঢ় হবে এটাই আমাদের কাম্য।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০১৬
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ