ঢাকা : চারদিন পর নিজ বাড়িতে ফিরলেন সাবেক সাংসদ ও আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত সামছুদোহা খান মজলিসের স্ত্রী সেলিমা খান মজলিস (৬৩)। প্রিয় স্বজনদের কাছ থেকে শেষ বিদায় নিতেই নিজ বাড়িতে তার এই ফিরে আসা।
শনিবার বিকেলের দৃশ্য এটি। সাভার মডেল থানা সংলগ্ন সাভার পৌর এলাকার দক্ষিণপাড়ায় অবস্থিত সাবেক সাংসদ ও আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত সামছুদোহা খান মজলিসের খান মজলিস ভিলা ঘিরে শত শত মানুষের ঢল। টানা চারদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে শনিবার দিবাগত রাত ১২ টা ২৫ মিনিটে মারা যান তিনি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়না তদন্ত শেষে একটি এ্যাম্বুলেন্স যোগে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে তার মরদেহ পৌঁছে সাভারের নিজ বাড়িতে। সেই দেহ ঘিরেই চলে স্বজনদের আহাজারী। সেখানে অবতারণা হয় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের।
মঙ্গলবার ভোরে থানা সংলগ্ন সাভার পৌর এলাকার দক্ষিণপাড়ার নিজ বাসভবনে জবাই করে তাকে হত্যার চেষ্টা চালায় দুর্বৃত্তরা। বিষয়টি নজরে আসার পর তার চিকিৎসার সকল দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ ঘটনায় গভীর শোক ও দু:খ প্রকাশ করে জড়িতদের দ্রত গ্রেপ্তার দাবি করেছেন স্থানীয় সাংসদ তালুকদার মোহাম্মদ তৌহিদ জং মুরাদ ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বেনজীর আহমেদ এমপি। মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে সাভারে নেমে আসে শোকের ছায়া।
ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও নিহতের ভাগ্নে মাসুদ চৌধুরী জানান,এতদিন তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিলো। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের পরও এখন পর্যন্ত এ ঘটনার ক্লু উদঘাটন ও জড়িতরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় দল ও পরিবার সর্বত্রই ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে বলেও জানান তিনি।
তিনি জানান, বাদ আসর প্রথমে সাভার অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ ও পৌর সভার গেন্ডায় নিজ গ্রামে দ্বিতীয় জানাজা শেষে দাফন করা হবে সেলিমা খান মজলিসকে। তবে আবহাওয়া প্রতিকূল থাকলে প্রথম নামাজে জানাযা সাভার মডেল থানা মসজিদে সম্পন্ন হতে পারে বলে-ও জানান তিনি।
এদিকে এই ঘটনার তদন্তে ঘটনাস্থল ও আশেপাশের এলাকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একটি দল। ওই দলের প্রধান পরিদর্শক মাহবুবুর রহমান জানান, আঙ্গুলের ছাপ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত দলের সদস্যরা ওই বাড়ির রক্তমাখা বিছানা,দরজার কাছে পাওয়া হাতের ছাপসহ পরিবারের সদস্যদের আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করার পাশাপাশি বেশ কিছু আলোচিত্র সংগ্রহ করেছে।
মঙ্গলবার সকালে নিজ বাড়ির দোতলার একটি কক্ষে অর্ধেক গলাকাটা অবস্থায় রক্তাক্ত সেলিমা খান মজলিসকে উদ্ধার করে নেয়া হয় সাভারে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পেটে উপর্যুপুরি ও গলায় ধারালো ছুরি চালিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা করে দুর্বত্তরা। সেখানে দীর্ঘসময় ধরে অস্ত্রপচার করা তাঁর দেহে। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে এলে তিনি সেলিমা খান মজলিসের চিকিৎসার সকল দায়িত্ব গ্রহণের ঘোষণা দেন। ওইদিন বিকেলেই তাকে সাভার থেকে স্থানান্তর করা হয় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)।
পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে রক্তমাখা একটি ছোরাসহ জব্দ করে কিছু আলামত ।
পরদিন বুধবার বিকেলে এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয় সাভার মডেল থানায়। মামলার বাদী হন সেলিমা খান মজলিসের ছোটভাই শফিউর রহমান খান।
তবে মামলায় সুনির্দিষ্টভাবে আসামী করা হয়নি কাউকে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে পুলিশ আটক করে সেলিমা খান মজলিসের নাতনি তিলোত্তমা খান মজলিসের স্বামী আবুল কালাম আজাদ (৩২), তার খালাতো ভাই সেলিম (২৬),কাজের বুয়া সরজিৎ সরকার (৩২) ও তার স্বামী হরিপদ সরকার (৪০)কে। এদের মধ্যে বৃহস্পতিবার আবুল কালাম আজাদ ও হরিপদ সরকারকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পাঁচ দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করে আদালতে প্রেরণ করে। আদালত দুইদিনের রিম্যান্ড মঞ্জুর করেন । গ্রেপ্তারকৃত দুইজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ও ঘটনা কারণ উৎঘাটন ও জড়িত অন্যরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেনসেলিমা খান মজলিসের ভাগ্নে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুদ চৌধুরী।
সাভার মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাহবুবুর রহমান জানান,হত্যা প্রচেষ্টার মামলাটি এখন হত্যা মামলায় রূপ নেবে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাভার মডেল থানার উপ-পরিদর্শক শেখ ফরিদ আহমেদ বলেছেন,তদন্ত চলছে। রিমান্ডে আনা দুজনকে শনিবার রিমান্ড শেষে আদালতে উপস্থাপন করা হবে। তিনি বলেন,ওই বাড়ির বাসিন্দাদের কল লিষ্টও পরীক্ষা করা হচ্ছে। বাইরে থেকে দুর্বৃত্তরা ওই বাসায় ঢুকেছে এখন পর্যন্ত এমন কোন আলামত ও পাওয়া যায়নি। প্রাথমিক ভাবে ধারণা করা হচ্ছে,এ হত্যাকান্ডের সাথে নিহতের স্বজনরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। কিছু দিনের মধ্যেই এ মামলার সকল জট খোলা সম্ভব বলেও জানান তিনি।
সাভারে আওয়ামী রাজনীতিতে কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এক সময়ের প্রভাবশালী এই পরিবারটি দীর্ঘদিন ছিলো আলোচনার বাইরে। দুই মেয়ে শামীমা তাহের পপি, সেলিনা খান মজলিস শিল্পী ও এক প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়েই তিনি থাকতেন দোতলা বাড়িটিতে। অন্য মেয়ে ইলোরা খান মজলিস যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।
প্রতিদিনের মতো ওই দিন ভোরে সেলিমা খান মজলিসের যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ছোট মেয়ে ইলোরা মায়ের সঙ্গে কথা বলতে ফোন করেও কোন উত্তর না পেয়ে তিনি ফোন করেন নিচতলায় থাকা বড় বোন শামীমা তাহের পপিকে। জানান,দীর্ঘ সময় ধরে রিং বাজলেও মা ফোন ধরছেন না। পপি পাশের ফ্লাটে থাকা আরেক বোন সেলিনা খান মজলিস শিল্পীকে সাথে নিয়ে ছুটে যান দোতলায়। সেখানে দেখা যায় খাবার ঘরের মেঝেতে রক্ত। পাশে আরেকটি কক্ষের খাটের ওপর অর্ধেক গলাকাটা অবস্থায় রক্তাক্ত মাকে পড়ে থাকতে দেখে তারা চিৎকার দেন। পরে এলাকাবাসী ছুটে গিয়ে গুরুতর আহত সেলিমা খান মজলিসকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৮ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১১