ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

জন্মশতবর্ষ স্মরণ

বেগম আখতার: বেদনার সঙ্গীতময় সৌরভ

মাহফুজ পারভেজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৫
বেগম আখতার: বেদনার সঙ্গীতময় সৌরভ

১.
সমুদ্র-সমান-বেদনার-জীবনে আত্মমগ্ন-গানের ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকার অর্থ ও আনন্দ খুঁজে পেতেন বিবি অথবা আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি; সবার কাছে চেনা বেগম আখতার; যার অন্যতম উপাধি ‘মালেকা-ই-গজল’। ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে গুজরাতের আহমেদাবাদে একটি অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু অনুষ্ঠানের মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। মাত্র ৬০ বছর বয়সে, সেখানেই প্রয়াত হন। দিনটি ছিল ৩০ অক্টোবর। এখন থেকে ঠিক ৪০ বছর আগের একটি দিন।

তাঁর মৃত্যুর পর লখনউয়ের ‘পসন্দাবাগ’-এ সমাধিটার উপর জমেছে শুকনো ঝরা পাতাদল;  জ্বলেছে হাজার মোমবাতি। কখনো কোনো ভক্ত এক গোছা রক্তিম গোলাপ রাখতে গিয়ে মাটিতে আলগোছে ছড়িয়ে দিয়েছে কয়েকটা পাপড়ি। প্রকৃতির নান্দনিক ছন্দে সেখানে মাঝে মাঝে  ভেঙে গেছে  অনন্ত নীরবতা। যাঁর কণ্ঠের  এক প্রান্তে ‘রুহি-গুলাবের’ গন্ধমাখা ঠুমরি, দাদরা কিংবা গজলের স্মৃতিসুধা। তারই  অন্য প্রান্তে, জমে থাকা বিরহ, বিষণ্নতা আর যন্ত্রণা। আর এ দুয়ের মাঝে লুকিয়ে রয়েছে বিবি, আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি থেকে বেগম আখতার হয়ে ওঠার নস্টালজিক ও ট্র্যাজিক কাহিনি। এবং ঔপনিবেশিক যুগে তথাকথিত অভিজাত মুসলমান পরিবারের কুসংস্কারাচ্ছন্নতার বিরুদ্ধে নারীসত্তার লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে আত্মপ্রতিষ্ঠার সত্য-গল্পও তাঁর জীবনের নিবিড় অথচ করুণ অংশ।

মৃত্যুর ৪০ বছর পর এবং জন্মের শতবর্ষে (১৯১৪-২০১৪) ভারতীয় ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের অন্যতম সম্রাজ্ঞীর জীবন ও কর্মের অনেক অজানা-অদেখা অঙ্গনে আলো ফেলে তাঁকে অধিষ্ঠিত দেখতে পাওয়া যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক-স্মৃতির হিরন্ময় নায়িকার আসনে। প্রাচ্য নারীর ব্যক্তিসত্তার স্বাতন্ত্র্য ও বিকাশের শিল্পিত সংগ্রামের তিনি একজন আইকন; এই তথাকথিত-আধুনিক বিংশ শতকেও তাঁকে জীবনের দামে শোধ করতে হয়েছে শিল্পের প্রতি দায় ও দায়বদ্ধতা। পরিবার ও সমাজের হিংস্রতাকে আড়াল করতে হয়েছে বেদনার অদৃশ্য কাফনে। বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানব্যাপী দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দুই প্রধান সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষা-বাংলা আর উর্দুর প্রায়-প্রতিটি সঙ্গীতবোদ্ধা-শ্রোতাই বেগম আখতারের গানের মধ্যে সঞ্চারিত বেদনা-বিধূর সুর ও সিম্ফনিতে অনুভব করেন তাঁর যন্ত্রণাদগ্ধ বাস্তব-জীবনের করুণ ছায়াপাত। হেমন্তের বিষণ্নতায় প্রতিটি অক্টোবরের শুরু ও উপান্তে তিনি বিশেষভাবে আসেন মায়াবী কুয়াশার রহস্যময়তাকে সঙ্গে নিয়ে: তারপর জন্ম ও মৃত্যুর যৌথস্মৃতিবন্ধনের অশ্রুমালায় ভেসে চলেন দক্ষিণ এশীয়ার প্রাচীন, ঘটনাবহুল, আলো-আঁধারীতে-ভরা ধ্রুপদী সাংস্কৃতিক আকাশের এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্তে।             

২.
ব্রিটিশ-ভারতের উর্দুভাষি অঞ্চল উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদে ১৯১৪ সালে (৭ অক্টোবর) জন্ম আখতারির। তাঁর বাবা ছিলেন অভিজাত সৈয়দ পরিবারের মানুষ। সেই ভদ্রলোকের তৃতীয় স্ত্রী মুশতারি বেগমের যমজ দুই মেয়ে। জোহরা এবং বিবি। পরবর্তী কালে সম্পত্তিজনিত কারণে মুস্তারির স্বামী তাঁর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। ইতিমধ্যে মারা যায় এক মেয়ে, জোহরা। জীবন সংগ্রামে একা মুস্তারি নানা বাধা-বিপর্যয় পেরিয়ে তাঁর আদরের বিবিকে বড় করে তুলছিলেন। এই বিবি-ই পরবর্তী কালে হয়ে উঠবেন ‘মালিকা-এ-গজল’ বেগম আখতার।


কটি মিশনারি স্কুলে ভর্তি করা হয় বিবিকে। সেই স্কুলে এক দিন অর্থ সাহায্য করতে এলেন গহরজান। সেই গহরজান, যাকে বলা হয় ‘ফার্স্ট ডান্সিং গার্ল’। তাঁর কবরের উপর শেষ গোলাপটা কে রেখেছিল সে কথা আজ কেই বা জানে। স্মৃতির অতলে কবেই বিলীন হয়েছে হিন্দুস্থানের সেই সঙ্গীত সম্রাজ্ঞীর কবর। অথচ সেখানে কোনও দিন বসেনি একটা স্মৃতি ফলকও। জীবদ্দশাতেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন একটা ‘মিথ’। তাঁর রেকর্ডে লেখা থাকত ‘ফার্স্ট ডান্সিং গার্ল’। মৃত্যুর চুরাশি বছর পরেও তিনি কিংবদন্তী। তাঁকে নিয়ে চলে নিত্য নতুন গবেষণা। আর তাঁর গাওয়া গানের পুরনো রেকর্ডগুলি আজও কালেক্টর্স আইটেম। তিনি মিস গহরজান, কলকাত্তাওয়ালি। যদিও ১৮৭৩ সালের ২৬ জুন উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ে জন্ম অ্যাঞ্জেলিনা ইয়োয়ার্ডের। পরবর্তী কালে তাঁরই নাম হয় গহরজান। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন ইহুদি। মায়ের নাম ভিক্টোরিয়া হেমিংস, আর বাবা রবার্ট উইলিয়াম ইয়োয়ার্ড। ভিক্টোরিয়ার মা রুক্মিণী ছিলেন জন্মসূত্রে ভারতীয়। ভিক্টোরিয়া ও রবার্টের  সুখের সংসার বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। পরে এক মুসলিম যুবক খুরশিদের সাহায্যে ভিক্টোরিয়া ও অ্যাঞ্জেলিনার ঠিকানা হয় বারাণসী শহরে। এখানেই মা ও মেয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর ভিক্টোরিয়ার নাম হয় মালকাজান এবং ছোট্ট অ্যাঞ্জেলিনা হল গহরজান।

শোনা যায়, স্কুলের প্রবীণ শিক্ষিকা যখন গহরজানকে স্কুল ঘুরে দেখাচ্ছিলেন, হঠাৎই তাঁর ওড়নায় টান পড়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি দেখেন, ছোট্ট একটি মেয়ে অবাক হয়ে দেখছে তাঁর বহুমূল্য ওড়নাটি। গহর সস্নেহে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী নাম?’ উত্তর দেওয়ার সময় তার কণ্ঠস্বরই গহরজানকে বুঝিয়ে দেয় যে, সে গান গায়। তাঁর কথাতেই বিবি গেয়ে উঠেছিল, একটি কলি। অথচ এর আগে বিবি কোনও দিন গান গায়নি। সেই এক কলি গান শুনেই গহর নিশ্চিত হয়েছিলেন, এই মেয়ে এক দিন বড় শিল্পী হবে।

ইতিমধ্যে মুস্তারি মেয়ে বিবিকে নিয়ে গয়াতে তাঁর দূর সম্পর্কের এক ভাইয়ের কাছে আশ্রয় নেন। বিখ্যাত উস্তাদ জামির খাঁ-র কাছে সেখানে বিবি তালিম নেওয়া শুরু করে। এমনই এক সময় পটনায় বন্যা দুর্গতদের সাহায্যার্থে একটি বড় সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়। সেই অনুষ্ঠানে মুস্তারি অনেক কাকুতিমিনতি করে বিবির গান গাওয়ার ব্যবস্থা করেন। অনুষ্ঠানে বছর দশেকের বিবির গান শুনে একটি রেকর্ড কোম্পানি তার গান রেকর্ড করার সিদ্ধান্ত নেয়। রেকর্ড হল। কিন্তু, আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি-র সেই প্রথম রেকর্ড বাজারে তা চলল না।

হতাশ মুস্তারি এর পর মেয়েকে নিয়ে গেলেন এক পীরের কাছে। সব দেখেশুনে সেই পীর নাকি বলেছিলেন, ‘এক দিন এই মেয়ের সামনে সারা পৃথিবী মাথা নত করবে। ’ তিনি বিবিকে গানের খাতাটা খুলতে বলেন। তার পর চোখ বন্ধ করে হাত রাখেন খাতার একটি পাতায়। সে পাতাতেই ছিল ‘দিওয়ানা বানানা হ্যায় তো’ গানটি। আশ্চর্যের কথা, সেই গান যখন রেকর্ড হয়ে বেরোল, বিবিকে আর  পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মাত্র তেরো বছর বয়সে সেই গান তাকে এনে দিয়েছিল ভারত জোড়া খ্যাতি। এর পর বিবি অর্থাৎ আখতারি এলেন তৎকালীন ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতায়। পাতিয়ালার উস্তাদ আতা মুহম্মদ খানের কাছে শুরু হল তালিম। প্রথম দিকে আখতারির গান রেকর্ড করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন এক বাঙালি সঙ্গীতপ্রেমী, মেগাফোন কোম্পানির কর্ণধার জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ। জিতেনবাবুর জহুরির চোখ আখতারিকে চিনতে ভুল করেনি।

৩.
চোদ্দ বছর বয়সে আখতারি যোগ দিলেন থিয়েটারে। সেখানেও নিজের অভিনয় দক্ষতার পরিচয় দেন। এর পরেই সিনেমায় অভিনয় করার জন্য বম্বে থেকে ডাক আসে। পাশাপাশি আসতে থাকে বিভিন্ন রাজপরিবারে সঙ্গীতের মেহফিলে গান গাইবার অনুরোধ। ‘নলদময়ন্তী’ ছবিতে অভিনয়ের পরে ‘রোটি’তে তিনি অভিনয় করেন। ছবিতে অভিনয়ের আমন্ত্রণের সংখ্যা এর পর যায় বেড়ে। কিন্তু বম্বের জীবনযাত্রা আখতারির না-পসন্দ। তাই তিনি ফিরে এলেন লখনউতে। সেখানেই বাড়িতে প্রতি সন্ধ্যায় বসত গানের মেহফিল।

এরই মাঝে হঠাৎই আখতারির ডাক পড়ল উত্তরপ্রদেশেরই রামপুরের নবাব-দরবারে। নিমন্ত্রণ রাখলেন আখতারি। কিছু দিন সেখানে থাকার পর, নবাব আখতারিকে নিকাহ্ করার প্রস্তাব দেন। তবে, আখতারি শুধু তা নাকচই করেননি, রামপুর ছেড়ে চলে গেলেন। সঙ্গে নিয়ে এলেন নারীত্বের চরম অপমান আর মাতৃত্বের স্মৃতি, যে কথা প্রবন্ধের পরবর্তী পর্যায়ে বিস্তারিত আলোচিত হবে।

এভাবেই নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে কেটে যাচ্ছিল আখতারির জীবন। আচমকাই তাঁর সঙ্গে দেখা হল পেশায় ব্যারিস্টার কাবুলির নবাব ইশতিয়াক আহমেদ আব্বাসির। ঘটনাচক্রে পরে তাঁর সঙ্গেই বিবাহ হয় আখতারির। বিয়ের পর তিনি পেলেন শিক্ষিত-সুপুরুষ স্বামীর ভালবাসা, অর্থ, প্রতিপত্তি, হিরে-জহরত সব কিছুই। শুধু জীবন থেকে বিদায় নিল গান! কেননা, বিবাহে আব্বাসি সাহেবের শর্তই ছিল, আখতারিকে গান ছাড়তে হবে। কাজেই জীবনের মানেটা বদলে গেল আখতারির কাছে। সব আছে, অথচ কিছুই নেই! সংসার জীবনে একাধিক বার গর্ভবতী হয়েও জন্ম দিয়েছেন মৃত সন্তান। জীবনে বেঁচে থাকার প্রয়োজনটাই হারিয়ে ফেললেন আখতারি। চিকিৎসক এলেন। পরামর্শ দিলেন, এমন কিছু করার প্রয়োজন হল যাতে আখতারি ভাল থাকেন।

‘শূন্য জীবনে’ নতুন করে আবার শুরু হল গান। গান গাওয়ার পাশাপাশি আখতারি এ বার গান শেখাতেও শুরু করেন। আকাশবাণীর লখনউ-র স্টেশন ডিরেক্টর, আরেকজন বাঙালি সঙ্গীত-সমঝদার সুনীল বসু ইতিমধ্যেই আব্বাসি সাহেবের বাড়ি গিয়ে অনেক কাকুতিমিনতি করে বেগমের গান রেকর্ড করতে তাঁকে রাজি করান। আখতারি গান গাইবেন শুনে গ্রামোফোন কোম্পানি তাঁকে রেকর্ড করার প্রস্তাব দিল। তবে আর আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি নয়! জন্ম হল এক নতুন শিল্পীর বেগম আখতার। সেই নামেই প্রকাশিত হল দু’টি বিখ্যাত গান। ‘কোয়েলিয়া মত কর পুকার’ এবং ‘সঁইয়া ছোড় দে’। শুরু হল বেগমের নতুন জীবন। যেখানে শুধু গান আর গান। একের পর এক প্রকাশিত হচ্ছিল রেকর্ড। পাশাপাশি দেশ জোড়া খ্যাতি আর অসংখ্য অনুষ্ঠান। আখতারি যেন নতুন করে বেঁচে থাকার আনন্দ খুঁজে পেলেন। গজল গায়কির আজকের ধারার প্রবর্তন করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, বঙ্গদেশ, কলকাতা ও বাঙালি সমাজের সঙ্গে আখতারির অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বহু দিনের। জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ  ও সুনীল বসু ছাড়াও আরেকটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। সেটি বাস্তবের নয়, পর্দার। জমিদার বিশ্বম্বর রায়ের ছেলের উপনয়নের সেই সন্ধে। জলসাঘরে গানের আসরে দুর্গাবাঈ ধরলের পিলু ঠুমরি। ‘ভরি ভরি আয়ি মোরি আঁখিয়া’। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকে আশ্রয় করে সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’-এর সেই গানের মায়াবি মাদকতায় আজও আচ্ছন্ন সঙ্গীত রসিকেরা। সেই সঙ্গেই চিরস্মরণীয় দুর্গাবাঈর চরিত্রে বেগম আখতার। তাঁকে দিয়ে বাংলা গান গাওয়ানোর সেই সব ঘটনা আজ ইতিহাস। কিংবা ডিক্সন লেনে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বাড়ির সেই আড্ডা, বা রাত একটার সময় প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি গান শুনতে যাওয়ার সেই ঘটনার কথা আজ হয়ত কারোই মনে নেই। তবুও বাঙালির হৃদয়ে ‘জোছনা করেছে আড়ি’, ‘পিয়া ভোলো অভিমান’, ‘কোয়েলিয়া গান থামা’ ইত্যাদি গান আজও নবীন। ‘আই মোহাব্বত’,‘উয়ো যো হাম মে তুম মে’ কিংবা মির্জা গালিবের রচিত ‘ইয়ে না থি হামারি কিসমৎ’ বাঙালির কাছেও কোনোদিনই পুরনো হবে না।

ঠুমরি গায়িকাদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গায়িকা ছিলেন বেগম আখতার। বেগম আখতার, ঠুমরি গেয়ে ভূয়সী সুনাম অর্জন করেন। দেখতে সুন্দরী, পোশাকে-আশাকে শালীন, কানে বড় বড় পান্না-হীরে বসানো টব, গলায় সরু সোনার হার এবং তাতে একটা বড় হীরে বসানো, তার পাশে রকমারী পাথর। হাতেও দামি পান্না বসানো হীরের আংটি। মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখলেই বোঝা যেত আভিজাত্য। একই রকম দক্ষ ছিলেন তিনি  গজল গানে। তাঁর গানের সুর শ্রোতাদের মাতিয়ে রাখতে পারতো। বেগম আখতারের গান মানুষ কেমন ভালোবাসতো সে সম্পর্কে একটা চমকপ্রদ গল্প প্রচলিত আছে: লক্ষ্ণৌর এক গান-পাগল ভদ্রলোক বেগম আখতারের গান শুনে তাঁকে ভালোবেসে ফেলেন। কিন্তু বেগম আখতার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। উপায়ান্তর না দেখে সেই ভদ্রলোক বেগম আখতারের বাসার কাছে রাস্তায় খড়িমাটি দিয়ে নাম লিখে রাখতেন। বেগম আখতার যখন তাঁর নামের ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে চলে যেতেন তাতেই তিনি তাঁর ভালোবাসার প্রতিদান পেয়েছেন বলে মনে করতেন। ওই ভদ্রলোকের নাম বাহ্জাদ লখন ভী। এই কাহিনী থেকেই বেগম আখতারের গানের আবেদন কত সুদূর-প্রসারী তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আজকেও প্রকৃত সঙ্গীতপ্রেমী আর সমঝদাররা অম্লান করে রেখেছেন বেগম আখতারকে। মৃত্যুর এতো এতো বছর পরেও বেগম সাহেবার সঙ্গীতিক জন্ম-জন্মান্তর ঘটছে বিশ্বের লক্ষ লক্ষ শ্রোতার আবেগে-ভালবাসায়-শ্রদ্ধায় ও স্মরণে।

৪.
‘এক জন্মে কত বার জন্মাতে পারে কেউ?’ জিজ্ঞেস করা হলে ফৈজাবাদের ভাদ্রাসা গ্রামে আইনজীবি আসগর হোসেন-এর অন্যতম স্ত্রী মুশতারীর গর্ভে ১৯১৪ সালের ৭ অক্টোবর জমজ  বোন জোহরার সঙ্গে জন্ম নেয়া বিবি জানাতেন, ‘তার তিন জন্ম’। ।   সেটাও এক করুণ ইতিহাসেরই অংশ বটে। কারণ, বিবি’র মা মুশতারিকে কখনও স্বীকারই করেননি তাঁর স্বামী সৈয়দ আসগর হুসেন। স্বীকার করেননি, কারণ আসগর ব্রিফলেস ব্যারিস্টার হলেও সৈয়দ বংশের সন্তান; আর অসামান্য সুন্দরী হলেও মুশতারি সামান্য এক বণিকের মেয়ে, অতএব জাত (!) নেই। ফলে, যমজ কন্যার জন্ম দিয়ে একা থাকতে হত মুশতারিকে। এক দিন তাঁর আড়ালে চার বছর বয়সী মেয়েদের হাতে বিষ মাখানো মিষ্টি দিয়ে গেল তাদের পিতৃকুলের লোক, মারা গেল এক মেয়ে, জোহরা। বেঁচে থাকল বিবি। তাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল সৈয়দ বংশের ভাড়া করা গুণ্ডারা, তবু বেঁচে রইল মা-বেটি। হয়তো এই জন্মেই আরও দু’বার জন্মাতে হবে বলেই। কিংবা সঙ্গীতের অপার্থিব ধারাস্রোতে বার বার জন্মের জলে স্নাত হবেন বলে।

বেগম আখতারকে নিয়ে আলোচনা কখনোই সম্ভব নয়, তাঁর সংগ্রামশীল মাতা, উত্তর ভারতের উর্দুভাষি সমাজের অবক্ষয় আর তৎকালীন কলকাতাকেন্দ্রিক ব্রিটিশ-ভারতীয় সাংস্কৃতিক আবহকে বাদ দিয়ে। ফলে তাঁর জীবনের গল্প শুধু বিবির নয়, আখতারি বাই ফৈজাবাদীরও; কাকোরির বেগম ইশতিয়াক আহমদ আব্বাসি, বেগম আখতারেরও। কিন্তু, সে সবই পরের, পরের জন্মের কথা। সেই গল্পে পৌঁছতে হলে নানা পথ, জীবনের অন্ধি-সন্ধি পাড়ি দিয়ে যে পথে মা আর মেয়ের পদরেখা আঁকা, সে পথচিহ্ণ দেখে দেখে যেতে হবে। শুরু করতে হবে, জীবন নামক আশ্চর্য ও জটিল গল্পের বাস্তব দৃশ্যপট থেকেই, যখন, স্বামী-পরিত্যাক্তা মুশতারি তাঁর বেঁচে থাকা মেয়ে বিবির হাত ছেড়ে গয়া স্টেশনে ট্রেন থেকে নামলেন। ফৈজাবাদ থেকে না পালিয়ে আর উপায় ছিল না তাঁর। নিজে বাঁচতেন না, মেয়েটাকেও বাঁচাতে পারতেন না।

মুশতারি গয়ায় তাঁর এক দূর সম্পর্কের ভাইয়ের বাড়িতে উঠলেন। কড়ার হল, মা-মেয়ের থাকা খাওয়ার বিনিময়ে মুশতারি তাঁর ভাইয়ের গৃহস্থালীর যাবতীয় কাজ করে দেবেন। আর, মেয়ের ভবিষ্যৎ? মায়ের ইচ্ছে, মেয়ে স্কুলে যাক, লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াক। মেয়ে কিছুতেই স্কুলে যাবে না। সে পড়বে না, গান শিখবে। মুশতারির প্রবল আপত্তি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আপত্তি টিকল না। মেয়ের জন্য ওস্তাদ এলেন। তালিম চলল। এক দিন বৃদ্ধ ওস্তাদ মীড় শেখাচ্ছিলেন, আর বিবিও বুঝতে পারছিল না, কী ভাবে এক সুর থেকে গলা গড়িয়ে যায় অন্য সুরে। বিরক্ত ওস্তাদ ইমদাত খান শেষ পর্যন্ত সরিয়ে রাখলেন সারেঙ্গির ছড়, তার পর নিজের হাতের পাতা বুলিয়ে দিলেন বিবির উরুর ওপর। বললেন, এই ভাবে সুর গড়িয়ে যায়। গা ঘিনঘিন করে উঠল বিবির। ছোট্ট মেয়ে, কিন্তু লোলচর্ম বৃদ্ধের হাতের মধ্যে যে লোভী পুরুষের স্পর্শ ছিল, তাকে চিনতে, ঘেন্না পেতে, ভুল হয়নি তার। তক্ষুনি উঠে পড়ল মেয়ে, জানিয়ে দিল, যে ওস্তাদ তার শরীরে হাত দেয়, তার কাছে কিছুতেই গান শিখবে না সে। শেষ পর্যন্ত বিদায় হলেন ওস্তাদ। নতুন ওস্তাদের কাছে গান শেখা চলল। তিনি কিছু দিনের জন্য বম্বে গেলেন, বিবির রেওয়াজের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন ওস্তাদ জামিরুদ্দিনের ওপর। এই ওস্তাদের হাত ধরেই এক দিন কলকাতায় এলেন মুশতারি আর বিবি। গান শুনতে। কলকাতায় চ্যারিটি শো-তে। কে নেই সেই অনুষ্ঠানের শিল্পীদের তালিকায়? ১৪টা ভাষা জানা গওহর জান, মালকা জান, ছপ্পন ছুরি; খান সাহেবদের মধ্যে আগ্রা ঘরানার শ্রেষ্ঠ গায়ক আফতাব-এ-মৌসিকী ওস্তাদ ফৈয়জ খান, রজব আলি খান, কিরানার প্রাণপুরুষ আবদুল করিম খান, মাইহারের আলাউদ্দিন খান। সবাই চ্যারিটি শো-তে বিনে পয়সায় গাইবেন। আসরের দিন অবশ্য দেখা গেল, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শিল্পী বেনারসের সানাইবাদক আমন আলি বক্শ খান ছাড়া উপস্থিত নেই কেউই। এই আসরেই প্রথম শ্রোতাদের সামনে সানাই বাজাল আলি বক্শের কিশোর ভাইপো। তার নাম বিসমিল্লাহ খান। বিবির ঠিকে ওস্তাদ জামিরুদ্দিন লোক চৌকশ ছিলেন। আসরে ওস্তাদদের অনুপস্থিতিতে শ্রোতারা গরম হতে আরম্ভ করেছে দেখেই বুঝলেন, আয়োজকরা বেকায়দায় পড়বে এ বার। জামিরুদ্দিন তখন মুশতারি আর বিবিকে নিজ নিজ আসনে বসিয়ে রেখে হাজির হলেন ব্যাক স্টেজে। এক উদ্যোক্তাকে পাকড়াও করে বললেন, ‘বলেন তো আমার ছাত্রীকে বসিয়ে দিই আসরে। ’ বিস্মিত উদ্যোক্তা পাল্টা প্রশ্ন করেন,  ‘পারবে, এত বড় আসর সামলাতে?’ দ্বিধায় সেই উদ্যোক্তা। জামিরুদ্দিনের দিলে অসীম সাহস ও আস্থা নিজের ছাত্রী সম্পর্কে। নির্ভয়ে উত্তর জানালেন, ‘পারবে না মানে! কোন ঘরের, কোন তালিমের মেয়ে, তা তো দেখবেন, জনাব!’ রাজি হয়ে গেলেন সেই উদ্যোক্তা। মা-মেয়ের কাছে  দৌড়ে এলেন জামিরুদ্দিন। মা সানন্দে রাজি, যে মেয়ে গানের জন্য পাগল, সে মেয়ের মতামতের নামে সময় খরচের কোনো প্রশ্নই নেই। জলদি মেয়েকে নিয়ে স্টেজের দিকে হাঁটা দিয়েছেন জামিরুদ্দিন, এমন সময় কি ভেবে মুশতারির দিকে পিছন ফিরে বললেন, ‘কিন্তু, বিবি নাম তো চলবে না। ’ মুশতারি এক মুহূর্ত চুপ কওে থেকে বললেন, ‘বলুন, ওর নাম আখতার। সৈয়দ আখতার। ’ মুশতারি জানতেন, আসগর হুসেনের ছেলের নাম আখতার। জামিরুদ্দিন বললেন, ‘না, ওর নাম আখতারি। আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি। ’ দ্বিতীয় জন্য হল বিবির, আখতারী নামে।
৫.
কৈশোরেই বিবির দ্বিতীয় জন্ম খুবই স্বার্থক হল। কেননা, সেইদিন কলকাতার সম্ভ্রান্ত সঙ্গীত-আসর মাত করে দিল সেই এগারো বছরের মেয়ে। তখন কলকাতার রইসদের তারিফ পাওয়া ছিল হিন্দুস্থানের গাইয়ে বাজিয়েদের চূড়ান্ত শিলমোহর। খবরের কাগজওয়ালারা উচ্ছ্বসিত, ঘোষিত হল এক নতুন তারার জন্ম। মেগাফোন সংস্থার বড়কর্তা জে এন ঘোষ চুক্তি করলেন আখতারির সঙ্গে। রিপন ষ্ট্রিটে ফ্ল্যাট হল, গাড়ি হল, নতুন ডিস্ক বেরোল, কিন্তু আখতারির গান আর তেমন হিট করল না। ঘোষবাবুর কপালে ভাঁজ। মেয়ের মাকে সোজা জানিয়ে দিলেন, আর একটা রেকর্ড বের করবেন তিনি, সেটা চললে ভাল, নচেৎ চুক্তি বাতিল। মুশতারির মাথায় বজ্রাঘাত। তার সারা জীবন বিপদ আর দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে কেটেছে। এই প্রথম মেয়ের কল্যাণে সুখের মুখ  দেখেছেন তিনি। কোনো ভাবেই সে সুখকে হাত ফসকে হারিয়ে যেতে দেবেন না। ঘোষবাবুর কাছে কয়েকটা দিন সময় চেয়ে নিলেন মুশতারি, তার পর মেয়েকে নিয়ে সোজা উত্তর ভারতের বেরিলি। সেখানে তাঁর গুরু, পীর আজিজ মিয়া থাকেন। এই পীরের ঘর নাকি বাকসিদ্ধ, চারশো বছরেরও বেশি সময় ধরে। পীর সব শুনলেন, তার পর আখতারিকে বললেন, ‘কলকাতায় গিয়ে যে গানটা গাইবি, সেই পাতাটা আমার সামনে খুলে ধর তো বেটি। ’ আখতারি খাতা খুলল, সেই পাতায় হাত রাখলেন আজিজ মিয়া। বললেন, ‘শোহরত তুমহারি কদম চুমেগি, দৌলত তুমহারি বান্দি হো কর ঘুমেগি’। উদ্বিগ মুশতারি আর দেরি করলেন না। ট্রেন ধরে সোজা কলকাতা, স্টেশন থেকে সরাসরি ঘোষবাবুর অফিসে, বললেন তখনই রেকর্ডিং-এর আয়োজন করাতে। আখতারি গাইল: ‘দিওয়ানা বানানা হ্যায় তো দিওয়ানা বানা দে’। বাকিটা সাফল্যের ইতিহাস।

কতটা ঝলমলে ইতিহাস, সেই রেকর্ডিংয়ের প্রায় চল্লিশ বছর পরে তার প্রমাণ দিয়েছিলেন আমির খান সাহেব। আমির খানের তখন ভারতজোড়া নাম। কটকের এক জলসায় বেগম আখতার আর আমির খান সাহেব দু’জনেই হাজির। আয়োজকদের ইচ্ছে, খান সাহেবের আগে বেগম গেয়ে নিন। কিন্তু বেগম বিলকুল নারাজ, জেনেশুনে খান সাহেবের আগে গাওয়ার মতো গুনাহ তিনি কী ভাবে করবেন। শেষে আমির খান যা বললেন, সেটা এক কথায় ‘অবিস্মরণীয়’। বললেন, ‘যখন আখতারি বাঈয়ের সারা ভারত জুড়ে নাম, তখন তো এই গওয়াইয়া আমির খান পয়দাই হননি। আমাকে তখন কে চিনত! আমি তো তোমার রোটিতে অভিনয় আর ‘দিওয়ানা বানানা হ্যায়’ শুনেই দিওয়ানা হয়ে গিয়েছিলাম আর পাঁচ জনের মতো। ‘তুম তো গানেমে হামারি সিনিয়র হো। গাও ভাই দিল খোলকে। ’

কিন্তু, সে ইজ্জতদারির গল্প  তো অনেক পরের। তখন তিনি বেগম সাহিবা। আখতারি থেকে বেগম সাহিবা হওয়ার পথে আরো অনেক ত্যাগ আর কোরবানি তাঁর তখনো বাকি। নিজের সঙ্গীত জীবনের রূপান্তরের এমনই এক সন্ধিক্ষণে, হঠাৎ এক দিন কলকাতার আলো ঝলমল কমলালয় থেকে হারিয়ে গেল সে। লাপাত্তা। একেবারে উধাও। কোথায় গেল আখতারি? কেউ জানে না। যেন বাতাসে মিলিয়ে জনস্মৃতির দরবার থেকে বিস্মৃতির ঘন কুয়াশায় ঢেকে গেল একটি নাম; যৌবন শুরুর প্রান্তের চির-সবুজ একজন তরুণী- সৈয়দ আখতারি বাঈ।

কিন্তু হায়! হারিয়ে যাওয়াই শেষ কথা ছিল না তাঁর জীবনের সেই পর্যায়টি। এই অব্যক্ত-অন্তর্ধানের নেপথ্যে রয়েছে গোপন আঘাতের ক্ষত। কিন্তু যে পালিয়েও বাঁচতে পারল না সঙ্গীতের মাতোয়ারা মেয়েটি। সঙ্গীত নয়, তার শরীর, সৌন্দর্য ও যৌবন নিয়ে মেতে থাকতে চাইল ঔপনিবেশিক নস্টামিতে নিমজ্জিত লোলুপ-সমাজের ভ্রষ্ট-হর্তা-কর্তারা। আত্মরক্ষার জন্য কলকাতা ছাড়লেও বেদনা-লম্বিত জীবন তার পিছু ছাড়ল না। সদ্য-প্রস্ফুটিত শিল্পমনস্ক একটি নব্য-নারীসত্তার কঠিনতম পরীক্ষার নির্মম আঘাত তাকে সইতে হল।  

৬.
এক রাজার দরবারে গান শোনাতে গেল সে। রামপুরের সেই রাজা কুদর্শন, কিন্তু সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে তাঁর প্রচুর খ্যাতি। তাঁর দরবারে গান হল আখতারির। তখন তার বয়েস ১৩। গানের শেষে নিজের তাবুতে ফিরে এসেছে আখতারি, এমন সময় রাজবাড়ি থেকে ফের ডাক পড়ল তার। সারা রাত ফিরতে পারল না সে। ভোররাতে দারোয়ান এসে পৌঁছে দিয়ে গেল আখতারির সংজ্ঞাহীন, রক্তাক্ত দেহ। সঙ্গীতপ্রিয় রাজা ধর্ষণ করেছেন তাকে। ছ’দিন জ্ঞান ফিরল না আখতারির। তত দিনে মুশতারি তাকে নিয়ে লখনউ চলে এসেছেন। সেখানেই ন’মাস পরে মেয়ের জন্ম দিল আখতারি। তখন তার ১৪ বছর বয়স। মেয়ের নাম রাখা হল শামিমা। আখতারির সৌন্দর্যের এক ফোঁটাও পায়নি সেই মেয়ে। তার ধর্ষক বাপের মতোই কালো, কুৎসিত। মেয়েকে কলঙ্ক থেকে বাঁচাতে এক অসম্ভব কাজ করলেন মুশতারি। ১৫ বছর ধরে স্বামীসঙ্গহীন মুশতারি সবাইকে বললেন, শামিমা তার মেয়ে। আখতারির এই ‘ছোট বোন’, আখতারির একমাত্র সন্তান শামিমা সারা জীবন আখতারির সঙ্গে ছিল। জীবনের একেবারে গোড়ার অসহ্য আঘাতের জ্যান্ত প্রমাণ হিসেবে। একজন নিঃসহায়, স্বামী পরিত্যাক্তা রমণীর প্রতি সমাজের সীমাহীন নিপীড়ণের দগদগে দাগ হিসেবে।

এই লখনউয়েই তবায়েফের জীবন শুরু করে আখতারি। তখন তার অনেক টাকা। তার বাবা, আইনজীবী থেকে ইতিমধ্যে বিচারকে উন্নীত, জাস্টিস আসগর হুসেনের বাড়িও এই লখনউতেই। আখতারি বাড়ি হাঁকালেন একেবারে তার বাড়ির উল্টো দিকে, নাম দিলেন আখতারি মঞ্জিল। নিয়মিত আসর বসত আখতারি মঞ্জিলে, লখনউ-র সব রহিসরা আসতেন। লাল পার্শিয়ান কার্পেটে মোড়া আসর, মহার্ঘ্য ঝাড়বাতির দ্যুতি ঠিকরে পড়ে বেলজিয়ামে তৈরি আয়নার কাচে। এক দিন সন্ধেবেলা ঢুকলেন এক সুদর্শন যুবক। তাঁকে দেখেই লাফিয়ে উঠলেন মুশতারি। মজলিসের ঘরে ঢুকতে না দিয়ে তাঁকে নিয়ে বসালেন একেবারে শোওয়ার ঘরে। তার পর ডেকে পাঠালেন আখতারিকে। বললেন, এই ভদ্রলোককে চিনিস? এ তোর ভাই, সৈয়দ আখতার হুসেন। আসগর হুসেন সাহেবের ছেলে। তোর গান শুনতে এসেছেন! জীবনের রহস্য আর নাটকীয়তা কতভাবেই না চমকে দিয়েছে আখতারিকে।

আখতারির জীবনে আবারো এল চমক। সে-ও এক জলসায়। বারাবহাঁকির নবাবপুত্র ইনায়াত হাবিবুল্লার বিয়ের রিসেপশন উপলক্ষে আখতারির মুজরা। জারদৌসির কাজ করা লাল শিফন শাড়ি, সঙ্গে চোখ ঝলসানো গয়নায় আসরে বসলেন তিনি, গৃহকর্তা তখন এক অভ্যাগতর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন অন্যদের। একেবারে শেষে সবচেয়ে সম্মাননীয় অতিথি, লখনউ আদালতের বিচারপতি, জাস্টিস আসগর হুসেন। নিজের পরিবার পরিবৃত বিচারক বসে আখতারি বাঈয়ের গান শুনলেন। বাড়ির মেয়েরা সব ঝরোখার পিছনে, আসরে শুধু পুরুষরা, আর আখতারি। কী আশ্চর্য, নিজের জন্মদাতাকে প্রথম বার দেখেও আখতারির এক বারও ইচ্ছে করল না, নিজের পরিচয় দেয়। সে তবায়েফ, নিজের গানটুকু করল বুকের সব রক্ত দিয়ে। আসরের শ্রোতারা বহু দিন পর্যন্ত আখতারির এই গানের তারিফ করতেন। সাধে কি ফৈয়জ খান সাহেব বলেছিলেন, ‘দিলে চোট না লাগলে গজল গাওয়া যায় না!’ আখতারির মতো এত চোট আর কয়জন পেয়েছে?

আর এক রাজদরবারে গাইতে গিয়ে আলাপ হল রাজার কনিষ্ঠ সন্তান বালির সঙ্গে। অসম্ভব সুপুরুষ, ভদ্র এক জন মানুষ। আর তার চোখের কোণে কোথাও যেন লগ্ন হয়ে থাকে বিষাদ। ঘনিষ্ঠতা ক্রমে বাড়তে থাকে দু’জনের। আখতারি জানতে পারেন, সৎ মা আর ভাইদের ষড়যন্ত্রে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতে পারেন বালি। এক চাঁদনি রাতে, সরোবরের জলে চাঁদের সাঁতার দেখতে দেখতে দু’জনে বিয়ে করার সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন। তার আগে বালি আখতারির জন্য বানিয়ে দিয়েছেন হারমোনিয়াম। বিয়ে হল। এক দিন আখতারি সোহাগ করে বালিকে বললেন, ‘আমায় হারমোনিয়াম বাজানো শেখাও, আমি পরের আসরে এই যন্ত্র বাজিয়ে গাইব। ’ বিরক্ত মুখে বালি বললেন, ‘আসর? তুমি কি ভাবছ, তুমি আগের মতো মুজরা করে বেড়াবে?’ আখতারি অবাক। ‘বিয়ের আগে যে কথা হল, আমি আগের মতোই গান গাইতে পারব? গান না গাইলে সারা দিন কী করব আমি?’ বালি জবাব দেন, ‘কেন, ভাল শাড়ি পরো, গয়না পরো, খাও, অভিজাত পরিবারের বউরা যেমন ভাবে থাকে, তেমন থাকো। ’ বলেই বাড়ি থেকে চলে যান বালি। ফেরেন তিন দিন পর। এই তিন দিন নিজেকে বোঝান আখতারি, না হয় প্রেমাস্পদের জন্য গান ছেড়েই দেবেন তিনি। বালি ফিরলে বলেন, ‘ঠিক আছে, গান গাইব না, কিন্তু তুমি তা হলে আমার কাছে থাকো। এ ভাবে আমায় ছেড়ে এত দিনের জন্য চলে যেও না। ’ রেগে যান বালি। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলেন, ‘বিয়ে করার মানে কি বউয়ের আঁচল ধরে বসে থাকা? আমার নিজের জীবন নেই?’ আবার অনেক দিনের জন্য বেরিয়ে যান বালি। আখতারিও তাঁর গয়নাগাটি নিয়ে ফিরে আসেন লখনউ-এ। বুকের ভিতর রক্তপাত হতে থাকে, কিন্তু ফেরেন না আর বালির কাছে। এক দিন এক মুজরা আরম্ভ হল নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় দু’ঘণ্টা পরে। আখতারি শুনলেন, উপস্থিত অভিজাত পুরুষরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন, বালি নামে এক নবাবজাদা খুন হয়েছেন কাল রাতে, তার শেষকৃত্যে যোগ দিতেই দেরি হয়ে গেল। সব কিছু শোনেও, স্থির থেকেও, সেই আসরেও আখতারি বাঈয়ের গান হল।

প্রতারক প্রেমিকের মৃত্যুর ছায়ার থেকেও আখতারি দেখলেন, জীবনের কুৎসিত দিক তখনো পিছু ছাড়ে নি তাঁর। যে রামপুরের নবাব তাঁর সর্বনাশ করেছে, সেই রেজা আলির বিয়ের প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিয়েছিরেন আখতারি। অপমানে অপদস্ত হয়ে রিক্ত, বেদনার্ত ও রক্তাক্ত হয়ে ফিরেও এসেছিলেন। কিন্তু ক্ষুব্ধ-কামার্ত নবাব আখতারির নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেন। অভিযোগ, আখতারি রামপুর থেকে বহুমূল্য গয়না নিয়ে পালিয়েছেন। লখনউ-র রাস্তায় রামপুরের নবাবের পুলিশ যখন আখতারিকে প্রায় গ্রেফতার করে ফেলেছে, বাঁচাতে এগিয়ে এলেন এক ব্যারিস্টার। ইশতিয়াক আহমদ আব্বাসি। কাকোরির নবাব। বহু দিন ধরেই তিনি আখতারির প্রেমে হাবুডুবু। প্রথমটায় বিয়ে করতে রাজি ছিলেন না আখতারি। শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। ১৯৪৪ সাল। বিয়ের পর গান ছেড়ে দিলেন তিনি। মুজরার প্রশ্নই নেই। প্রাণপণে অভিজাত পরিবারের বউ হয়ে ওঠার চেষ্টা আরম্ভ করলেন তিনি। তবু, আব্বাসির পরিবার তাঁকে মানল না। আব্বাসি সাহেব আখতারিকে নিয়ে আলাদা সংসার পাতলেন।
|
সন্তান ধারণ করলেন আখতারি। গর্ভপাত হল। এক বার নয়, সাত বার। কৈশোরের যৌন নিপীড়নের শোধ তাঁকে এভাবেই দিতে হল।   ডাক্তার জানিয়ে দিলেন, আখতারির পক্ষে আর মা হওয়া সম্ভব নয়। মানসিক অবসাদ গ্রাস করল তাঁকে। ডাক্তার বললেন, একমাত্র গানই বাঁচিয়ে রাখতে পারে তাঁকে। আব্বাসি সাহেব অমত করলেন না, কিন্তু শর্ত, বাইরে গাওয়া চলবে না। সেই শর্ত অবশ্য রাখলেন না আখতারি। এক দিন আব্বাসি সাহেবের সঙ্গে ঝগড়া হল। তিনি কোর্টে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই রেডিয়ো স্টেশনে ফোন করলেন আখতারি। সেখানে ছিলেন তাঁর বহুপরিচিত এল কে মালহোত্রা। আখতারি বললেন, ‘আব্বাসি সাহেবের বাড়ি ফেরার আগে যে কয়েক ঘণ্টা সময়, তার মধ্যে কি রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা করা সম্ভব?’ বিস্মিত এল কে মালহোত্রা সানন্দে সম্মতি জানালেন। পোশাক বদলে স্টুডিয়োয় রেকর্ডিং সেরে বাড়ি ফিরলেন আখতারি। আব্বাসি সাহেবের ফেরার আগেই।

বাড়ি ফিরেই নতুন দুশ্চিন্তা। রেডিয়োয় তাঁর নাম ঘোষণা মানেই আব্বাসি সাহেবের নামটাও জড়িয়ে যাওয়া। সেই অভিজাত পুরুষের অসম্মান। স্বামীর প্রতি গভীর প্রেম ছিল আখতারির, আর ছিল কৃতজ্ঞতাবোধ। একটা অসম্মান ও অনিশ্চিতায় ঘেরা আক্রান্ত ও মর্যাদাহীন জীবন থেকে বেগমের মর্যাদা দেওয়ার কৃতজ্ঞতা। তড়িঘড়ি এল কে মালহোত্রাকে ফোন করলেন আখতারি। বললেন, কোনও ভাবেই যেন তাঁর প্রকৃত নাম ঘোষণা না-করা হয়। এল কে হাসলেন, বললেন, ‘আমি জানি। আপনি বলার আগেই আমি নির্দেশ দিয়েছি, এই গান যেন বেগম আখতার নামে প্রচারিত হয়। ’
৭.
বিবির তৃতীয় জন্ম হল। কিংবা বলা যায়, তীব্র ও লাগাতার আঘাতের শত ঘাত সয়েস সয়ে তাঁর মানবজন্ম সার্থক হল শিল্পীসত্তার পূর্ণ বিকাশের যবনিকায়। যতই তিনি নিজে গাইলেন: "কোয়েলিয়া গান থামা এবার/ তোর ঐ কুহুতান ভালো লাগেনা আর"; ততই মানুষ হৃদয়ের-কান পেতে থাকে তাঁর গীতে, কথায়, গায়কীর বেদনা ও বিষাদে। তাঁর কণ্ঠ থেকে গান হয়ে যেন ঝরে পড়ে স্বরচিত জীবন-বেদনার-সঙ্গী  শত-নদীর বিরহী স্রোত। বেগম আখতারের মৃত্যুর ৪০ বছর পরে এবং জন্মশতবর্ষে উত্তর ভারতের ঊষর পসন্দাবাগে তাঁর নিঃসঙ্গ সমাধির উপর জ্বলতে থাকা বাতিগুলি ধীরে ধীরে নিভে এলেও, ফুরাচ্ছে না ‘মালিকা-ই-গজল’ বেগম আখতারের ‘রুহি-গুলাব’  সৌরভমাখা অনিঃশেষ-ধ্বনিপুঞ্জ,  অলৌকিক-সুর লহরী এবং বেদনার্ত-সঙ্গীত।

ড. মাহফুজ পারভেজ: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ২২৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ