ঢাকা, সোমবার, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৮ জুলাই ২০২৫, ০২ সফর ১৪৪৭

শিল্প-সাহিত্য

আয় চলে আয় ধূমকেতু, আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু

আদিত্য আরাফাত, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০:০২, মে ২৫, ২০১২
আয় চলে আয় ধূমকেতু, আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু

ঢাকা: ‘‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু/ আয় চলে আয় রে ধূমকেতু/
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু/ দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন। ’’-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করে।

এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি নজরুলের উদ্দেশ্যে এভাবেই মন্তব্য করেছিলেন।

দ্রোহ, প্রেম, সাম্য ও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, নিপীড়ন, রাষ্ট্রীয় অনাচার, বৈষম্য, শোষণ ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেনে এক সংগ্রামী কবি। জাতীয় সঙ্কটে, স্বপ্নে, সংগ্রামে নজরুল বাঙালি জাতির আপনজন। সামনে এগোনোর পাথেয়। আজ শুক্রবার নজরুলের ১১৩ জন্মবার্ষিকী্। বিনম্র শ্রদ্ধায় বাঙালি জাতি আজ স্মরণ করছে বিদ্রোহী কবি নজরুলকে।

নজরুল এক আশ্চর্য প্রতিভা! একদিকে প্রেমিক, অন্যদিকে বিদ্রোহী; ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য। ’ সুরের নেশায় মত্ত, অসুরের বিরুদ্ধে সদা জাগ্রত ছিলেন বিদ্রোহী কবি। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্ভাসিত কবি মানুষের সংকীর্ণতা, দীনতা, মূঢ়তা, নীচতাকে ঘৃণা করতেন মনে-প্রাণে। নজরুল মানেই সামনে এগোনোর পাথেয়। নজরূলের কবিতা গান আজও বাঙালি জাতিকে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, সাম্য ও মৈত্রীর বন্ধন সৃষ্টির আহ্বান জানিয়ে তিনি লিখে গেছেন কালজয়ী অনেক কবিতা, গান।

১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৮ সালে) এক ঝড়ের রাতে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাবার নাম কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন। দারিদ্র্যই ছিল কবির নিত্যসঙ্গী। শৈশব থেকে অর্থনৈতিক অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে তিনি বেড়ে ওঠেন। তাঁর ডাকনাম ছিল দুখু মিয়া। বাবার অকালমৃত্যুর পর পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তিনি শিশু বয়সেই মক্তবে শিক্ষকতা, মসজিদের মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। জাতির দৈন্য, ক্লেশ তাঁকে তাড়া করত সব সময়। লেটো দলের বাদক, রেল গার্ডের খানসামা, রুটির দোকানের শ্রমিক নজরুল কৈশোর পেরোনোর আগেই উপলব্ধি করেছিলেন জীবনের কঠিন বাস্তবতা। পরবর্তীকালে সৈনিকের জীবন এবং একপর্যায়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন।

বৃটিশ ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খল ছেঁড়ার দৃঢ় অঙ্গীকারের পাশাপাশি তার কাব্যে মূর্ত হয়ে উঠেছিল অসাম্প্রদায়িক, ভেদাভেদহীন এমন এক মানবিক সমতার সমাজ গড়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, যে সমাজে মানুষের পরিচয় হবে ধর্ম-বর্ণ, ধনী-দরিদ্রের সকল ভেদাভেদের ঊর্ধে।

রবীন্দ্রোত্তর সাহিত্যে আধুনিকতার পথিকৃৎ নজরুল। তাঁর কবিতা, গান, উপন্যাসে পরাধীন ভারত, বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলায় সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। ধূমকেতুর মতো আঘাত হেনে তাঁর বিদ্রোহের পঙ্ক্তিমালা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত মানুষকে যুগ যুগ ধরে প্রেরণা জোগাচ্ছে। বিদ্রোহী কবি নজরুলের পক্ষেই লেখা সম্ভব হয়েছিল ‌‌‌‘মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না। ’ তাঁর কবিতা ‘চল্ চল্ চল্’ বাংলাদেশের রণসংগীত। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঐক্যের মহামন্ত্রে অবিভক্ত ভারতবর্ষকে তিনি সাম্প্রদায়িকতামুক্ত করার সাধনায় সমাজ সংস্কারকের ভূমিকাও পালন করেছিলেন।

স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে অসুস্থ কবিকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। বঙ্গবন্ধু কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেন। পরে তাঁকে জাতীয় কবি ঘোষণা করা হয়। বাংলা ১৩৮৩ সনের ১২ ভাদ্র কাজী নজরুল ইসলাম ইন্তেকাল করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয় তাকে।

জাতীয় কবির  ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ৯০ বছর  পূর্তিতে তাঁর ১১৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ আয়োজনে রাষ্ট্রীয়ভাবে আজ থেকে ঢাকায় দু’দিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছে। শুক্রবার সকাল ১০টায় ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দু’দিনের এ অনুষ্ঠানের উদ্ধোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে ‘সম্মানিত অতিথি’ হিসাবে উপস্থিত থাকবেন ভারতের আইন মন্ত্রী সালমান খুরশিদ। এছাড়া উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানের আলোচনায় বাংলাদেশ ও ভারতের নজরুল বিশেষজ্ঞরা অংশ নেবেন। সাংস্কৃতিক পর্বে দু’দেশের শিল্পীরা পরিবেশন করবেন নজরুলের গান। করবেন কবিতা থেকে আবৃত্তি ও নৃত্য। সর্ব সাধারণের জন্য দু’দিনই বিকাল ও সন্ধ্যায় ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। এখানেও দু’দেশের শিল্পীরা সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেবেন। এছাড়া নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলোতে এবং দেশের বিভিন্ন জেলায় জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে জাতীয়ভাবে অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যৌথ আয়োজনের অংশ হিসেবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা ও কবির জন্মভূমি বর্ধমানেও অনুষ্ঠানের আয়োজন রাখা হয়েছে।

জাতীয় কবির জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া আলাদা বাণী দিয়েছেন। দিনটি উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দেশব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

এছাড়া ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমী, নজরুল ইনস্টিটিউট ও জাতীয় জাদুঘরেও বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকছে। বাংলা একাডেমীতে আজ শুক্রবার বিকাল চারটায় একাডেমীর সেমিনার কক্ষে আলোচনা সভা, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করেছে দু’দিনের অনুষ্ঠান।

নজরুলের জন্মদিন উপলক্ষে শুক্রবার ও শনিবার ছায়ানট দু’দিনব্যাপী নজরুল উৎসবের আয়োজন করেছে। ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন মিলনায়তনে হবে এই অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে থাকবে বক্তৃতা, গান, পাঠ, আবৃত্তি ও নৃত্য।  

কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি আয়োজন করছে। জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কবির মাজারে পুস্পস্তবক অর্পণ করবেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের শীর্ষ নেতারা। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি-এনডিপি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-ভাসানী), জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ, বাসদ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ, জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা, বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেছাসেবক লীগ আলাদা কর্মসূচি পালন করবে। এছাড়া বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আলোচনা, আবৃত্তি, নাচ, নাটক প্রদর্শনীর আয়োজন করবে।

নজরুলজয়ন্তী উপলক্ষে সংবাদপত্রগুলো আজ বের করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। সরকারি-বেসরকারি রেডিও, টিভি চ্যানেলে আজ প্রচার হচ্ছে নজরুল স্মারক বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।

 


বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘন্টা, মে ২৫, ২০১২
এডিএ/ সম্পাদনা: জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

শিল্প-সাহিত্য এর সর্বশেষ