ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ১১ রবিউস সানি ১৪৪৬

ব্যাংকিং

প্রভাবমুক্ত কমিশন করে ব্যাংক খাতকে উদ্ধারের আহ্বান

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০২৪
প্রভাবমুক্ত কমিশন করে ব্যাংক খাতকে উদ্ধারের আহ্বান

ঢাকা: প্রভাব মুক্ত ব্যাংক কমিশন গঠন করে ব্যাংকের সঠিক চিত্র তুলে আনার মাধ্যমে অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া ও এ খাতের দুর্বলতা সারিয়ে তুলতে পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও ব্যবসায়ী নেতারা।

তাদের ভাষ্য, বিগত সরকারের সময় কয়েকটি পরিবারের হাতে ব্যাংক খাত তুলে দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে।

সোমবার (২৬ আগস্ট) সচেতন ব্যাংকার সমাজ আয়োজিত ‘ব্যাংক খাত সংস্কার: আমাদের করণীয়’ সেমিনারে এ কথা বলেন সংশ্লিষ্টরা।

অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ইসলামী মূল্যবোধ ধারণ এমন লোককে ইসলামী ব্যাংকের প্রধান করতে হবে। এর বাইরে কোনো চেয়ারম্যান নিয়োগ হলে মেনে নেওয়া হবে না।

তিনি বলেন, পদের দরকার নেই। কথা বলার সময় এসেছে, যে যেখানে আছে সেখান থেকেই কথা বলতে হবে। রাস্তায় থেকে আওয়াজ তুললেও জায়গা মতো পৌঁছে যাবে, ফলাফল পাওয়া যাবে। যারা টাকা পাচার করেছে তাদের আর দরকার নেই। ঘুষখোর, সুদখোর, টাকার পাচারকারীকে আমাদের আর দরকার নেই। যদি আইনের শাসন ব্যবস্থা কার্যকর করা যায়, গণতান্ত্রিক মুক্ত পরিবেশ কার্যকর করা যায় বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। দেশের মানুষও বিনিয়োগ করবে।

বিগত সরকারের সময়ে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা ফিরিয়ে আনা সহজ হবে না উল্লেখ করে অধ্যাপক আবু আরও বলেন, শ্রীলংকা পারেনি, পাকিস্তান পারেনি, ঘানা পারেনি। আমরাও পারবো বলে আশা করতে পারি না। কারণ, যে সব দেশে টাকা চলে যায়, সেসব দেশ টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে কথা বলতে চায় না। ১৫ বছরে মানুষের মাঝে বিভক্তি তৈরি করা হয়েছে। মানুষের মাঝে ভীতির পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। স্বৈরাচাররা এটাই করে। ভারত শেখ হাসিনাকে অন্ধের মতো সমর্থন করেছে, এখন তারা ষড়যন্ত্র খুঁজছে।

অনুষ্ঠানের সভাপতি ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, সরকারের কাছে দাবি করার জন্য রাস্তায় চিৎকার না করে লিখিত আকারে বা গণমাধ্যমের মাধ্যমে দাবি জানাতে হবে। আজকের মুক্ত অবস্থার জন্য যারা জীবন দিল। আমরা কি পেলাম বা না পেলাম, এই নিয়ে যেন আক্ষেপ না করি। আমরা কথা বলার মতো একটি মুক্ত পরিবেশ পেয়েছি।

সাবেক অর্থসচিব ইউনুসুর রহমান বলেন, সরকার ব্যাংকিং কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংকিং কমিশন করার সময় মামলা মোকদ্দমা হবে। এ জন্য যেন আইন করে উচ্চ আদালতে একটি ভিন্ন বেঞ্চ হয়। তা না হলে সরকারের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। ২০১৭ সালের ব্যাংক কমিশন করার জন্য একটি খসড়া প্রস্তাব করা হয়েছিল। বিষয়টি তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে দেওয়া হলে তিনি বলেন, নির্বাচনের পরে এটা করা হবে। সে সময় যদি কমিশন করা হতো তাহলে আওয়ামী শাসনের শেষ পাঁচ বছর যে লুটপাট হয়েছিল, তা হতো না।

বিগত সরকারের সময়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না উল্লেখ করে অর্থসচিব এম. আসলাম আলম বলেন, বেসিক ব্যাংকের অবস্থা নিরূপণের জন্য নিরপেক্ষ অডিট প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে অডিট করিয়েছিলাম। অডিটে যে চিত্র উঠে এসেছিল তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে বলেছিলাম, কিন্তু অনুমতি পাওয়া যায়নি। বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠাতে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সেদিন বেসিক ব্যাংক লুটপাটের ব্যবস্থা নিলে পরে আর এ ধরণের লুটের ঘটনা ঘটতো না।

ব্যাংক কমিশন অনেক বড় কাজ। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ছেড়ে দেওয়া যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বাধীন নিরীক্ষার মাধ্যমে ব্যাংকের চিত্র নিরূপণের করে ব্যাংক কমিশনের পথে এগুতে হবে। ব্যাংকে যে লুটপাট হয়, সেখানে যারা বোর্ডে থাকে, বা ফোনে হুমকি দেয়, যে নির্দেশ দিয়ে লুটপাট সম্পন্ন করে প্রচলিত আইন তাদের ধরা যায় না। কিন্তু জেল খাটে ম্যানেজার, ডিএমডি যারা দায়িত্ব পালন করেন। ব্যাংক খাতের দুর্নীতি লুটপাট বন্ধ করতে হলে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকা প্রকৃত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে।

ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সহ-সভাপতি আব্দুল হক বলেন, ইসলামী ব্যাংককে বন্ধ করার জন্য বিদেশি লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছিল। এমন ধরণের কাজ সঠিক হবে না, অর্থনীতির ক্ষতি হবে। ইসলামী ব্যাংক বন্ধ করার মতো আত্মঘাতী উদ্যোগ যেন না নেওয়া হয়, বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন গর্ভনর ড. আতিউর রহমানকে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি সেটা বুঝেছিলেন। গভর্নরের নিজের কিছু করার ছিল না। তিনি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সাথে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রীকে বিষয়টিকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম। সে ধাক্কায় ইসলামী  ব্যাংকটি ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নকীব নসরুল্লাহ বলেন, এখনকার ব্যাংক খাত অবস্থার জন্য দায়ি রাষ্ট্রযন্ত্র। রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের হাত থেকে একটি পরিবারের হাতে চলে গিয়েছিল। তার নির্দেশে সব কিছু হতো। ইসলামী ব্যাংক এখন চলছে একটি সার্কুলার দিয়ে। ব্যাংকিং খাতের ৩০ থেকে ৩৩ ভাগ আবর্তিত হয় ইসলামী ব্যাংগুলো মাধ্যম। এখন ইসলামী ব্যাংকের মতো বিশেষ ব্যাংকের জন্য আইন তৈরির প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। যাতে যে কোনো সময় যে কেউ ইসলামী ব্যক্তি না হয়েও ইসলামী ব্যাংকের শীর্ষ ব্যক্তি না হতে পারে।

মূল প্রবন্ধে মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, শরীয়া ভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার সুযোগ নিতে সুদ খোর, ঘুষ খোররা ইসলামী ব্যাংকিং চালু করেছে। তারা নিজে ইসলামী জীবন যাপন করেন না, ইসলাম বোঝেন না। মানুষের টাকা লুট ও ব্যাংকিং সুবিধা নেওয়ার সুবিধা নেওয়ার জন্য ইসলামী  ব্যাংক খুলে বসে।

তিনি প্রচলিত ব্যাংকিংয়ে পরিচালক নিয়োগ, সুশাসন ও পরিচালনা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ব্র্যাক ব্যাংকের নীতি অনুসরণ করার পরামর্শ দেন। দেশের অর্থনীতি ৬১টি ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। বিশেষ ধরণের ব্যাংকগুলোকে একীভূত করতে হবে। ২০১৬ সালের পর বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকের কোনো সফলতা নেই। এর পর থেকে ইসলামী ব্যাংকের নামে লুটপাট হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংক খাত খাদের কিনারে আছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু ব্যাংক খাত গভীর খাদে পতিত হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের সঞ্চালনায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সেমিনারে বক্তব্য দেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০২৪
জেডএ/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।