ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

বাংলানিউজ স্পেশাল

সুন্দরবনের ডাকাতেরা-৬

জিম্মিদের বোবা কান্নায় ভারি নোনা পরিবেশ

রহমান মাসুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০০ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১৪
জিম্মিদের বোবা কান্নায় ভারি নোনা পরিবেশ ছবি:বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

১০ হাজার বর্গকিলোমিটারের বিশ্বের প্রধান ‘ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট’ সুন্দরবনের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটারেরই মালিকানা বাংলাদেশের। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৭ লাখ পরিবার এ বনের ওপর নির্ভরশীল।

কিন্তু গুটিকয় জলদস্যু ও বনদস্যুর হাতে জিম্মি এই মানুষগুলো। গোটা তিরিশেক ছোট-বড় দস্যু বাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের ভয়ে সন্ত্রস্ত বনজীবীরা। দস্যু বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না এ বনের প্রধান আর্কষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ এমন কি কুমিরও। দুই সপ্তাহের অনুসন্ধানে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ ঘুরে সাত পর্বের ধারাবহিক রিপোর্ট করেছেন বাংলানিউজের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট রহমান মাসুদ। আজ পড়ুন তার ধারাবহিক প্রতিবেদনের ষষ্ঠ পর্ব।

সুন্দরবন থেকে ফিরে: বাড়িতে মেয়ের বিয়ে ঠিক। বিয়ের টাকা জোগাড়ের জন্য আব্দুল লতিফ গাজী প্রতিবেশি অন্য ছয়জনের সঙ্গে সুন্দরবনে আসেন মৌয়ালের কাজে। আসার সময় পুঁজি হিসেবে মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার নেন ৪০ হাজার টাকা। শর্ত ছিল, মধু নিয়ে বাড়ি ফিরে টাকার সঙ্গে আরো ৪০ কেজি মধু লাভ হিসেবে দেবেন মহাজনকে।

কিন্তু ২৭ দিন পর বাড়ি যাওয়ার পথে রাজু বাহিনীর হাতে বন্দি হয় তার নৌকা। ২৭ দিনের অর্জিত সব মধুই রেখে দিল ডাকাত দলটি। পূঁজিসহ ২৭ দিনের সকল অর্জন হারিয়ে জঙ্গলেই আর্তনাদ করছেন লতিফ গাজী। কিন্তু ভয়ে সেই আর্তনাদ রূপ নেয় বোবা কান্নায়।

জিম্মিদের এ বোবা কান্নায় মাঝে মাঝেই ভারি হয়ে ওঠে সুন্দরবনের নোনা পরিবেশ।
 
রাজু বাহিনীর হাতে জিম্মি আব্দুল লতিফদের সঙ্গে কথা হয় রাজু বাহিনীর জিম্মিখানায়। তিনি জানান তাদের অপরিসীম কষ্টের কথা।

২৭ দিন আগে খুলনার কয়রা উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে মধু কাটতে বনে আসেন আব্দুল লতিফ গাজী। তার সঙ্গে ছিলেন একই গ্রামের ইসহাক, মান্দার মোল্যাসহ আরো তিনজন।

বনে প্রবেশের পাস জোগাড় করতেই তাদের পড়তে হয় দালালের খপ্পরে। সাধারণ ফি’র সঙ্গে অতিরিক্ত যোগ করে জনপ্রতি মৌয়ালদের খরচ হয় এক হাজার টাকা করে।

বন বিভাগের পাস জোগাড়ের পরই তারা নির্বিঘ্নে মধু কাটতে যোগাযোগ করেন রাজু বাহিনীর দুই সদস্য পাশের দাশবাড়িয়া গ্রামের আসাদ ও ভোলা নূর ইসলামের সঙ্গে। মাথাপিছু দুই হাজার টাকায় ডাকাতদের সঙ্গে দফা-রফাও হয় তাদের। কিন্তু বনে প্রবেশের সময় ভোলার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করতে ব্যার্থ হন লতিফ গাজীরা।

এ অবস্থায় বাড়িতে ১৫ কেজি করে চাল কিনে দিয়েই বাকি টাকার বাজার সদাই নিয়ে বদর বদর করে বনবিবি-গাজী কালুর বন্দনা আর নোয়াপাড়ার পীর সাহেবের পড়া লাল রুমালটি আড়াই হাজার টাকার ভাড়ার নৌকার ছৈয়ে গুঁজে দিয়ে নৌকা ভাসান তারা।

চলতি পথে বড় কুকুমারী খালের কাছে আসতেই রাজু বাহিনীর মুখে পড়ে দলটি। মৌয়াল দলটিকে ধরে নিয়ে যায় ডাকাতরা। পরে নগদ সাড়ে ছয় হাজার টাকা রেখে দলটিকে ছেড়ে দিলেও দলের সদস্য ইসহাক মোল্যাকে দুই দিন আটকে রাখেন ডাকাতরা।

দুই দিন পর ভোলা নূর ইসলাম বাকি সাত হাজার টাকার জামিনদার হলে ইসহাককেও ছেড়ে দেন তারা। বাকি ২৫ দিনে শিপসা নদীর পূর্ব পাশের বনে ১৩ ড্রাম মধু সংগ্রহ করেন আব্দুল লতিফ গাজীরা। প্রতিটি ড্রামে ৪৪ কেজি করে মোট ৫৭২ কেজি মধু আয় হয় তাদের। মণপ্রতি ৯ হাজার ৮০০ টাকা হিসেবে মোট মধুর দাম দাঁড়ায় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকার বেশি। মহাজনের দেনা শোধ করে বাড়তি টাকায় মেয়ের বিয়ের খরচসহ সংসারের স্বচ্ছলতার স্বপ্ন দেখেন লতিফ গাজী ও তার সঙ্গীরা।

এ স্বপ্নে বিভোর হয়েই একটি ছোট ভুল করে বসেন তারা। দিনের আলোয় রওনা না দিয়ে শিগগিরই বাড়ি যাওয়ার তাড়ায় শিপশা নদীর তীর ধরে রাতের জোয়ারেই বাড়ির পথে নৌকা ভাসান মৌয়ালরা। যন্ত্রের যুগে দাড় বাওয়া নৌকাটি এক সময় রাজু বাহিনীর সামনে এসেই পড়ে। এরপরই নৌকাটি ধরে এক ছোট খালের মধ্যে নিয়ে যান ডাকাতরা।

এক দিন পর সব মধু রেখে দিয়ে লতিফ গাজীদের ছেড়ে দেয় রাজু বাহিনী। এভাবেই শেষ হয় একটি মর্মান্তিক গল্পের।

লতিফ গাজীর সঙ্গে কথা হয় ‍বাংলানিউজের। অন্য ৩৫ জন জিম্মির সঙ্গে ছিলেন তারা সাতজনও। ডাকাত বাহিনীর কড়া নজরদারির ফাঁকে তিনি জানালেন তার আর্তনাদের কথা।

বাড়িতে তার ৪ ছেলে ও ১ মেয়েসহ ৭ জনের সংসার। বনে মধু ভাঙ্গা, কাঁকড়া ও পোনা ধরে চলে সংসার। বনের আয়ে কোনো রকমে সংসার চললেও মেয়ের বিয়ে ঠিক হওয়ায় অথৈ সাগরে পড়েন তিনি। বিয়ের টাকা যোগাড় করতেই এবার মধু সংগ্রহ করতে ৬ প্রতিবেশিকে নিয়ে বাঁদায় আসা। কিন্তু সব হারিয়ে মহাজনের দেনা ঘাড়ে নিয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হবে ভেবেই চোখ ভাসাচ্ছেন তিনি।

একই অবস্থা এই দলের বাকি সব সদস্যের। গফুর গাজীর ও বাড়িতে আছে দুই মেয়ে এক ছেলে। মেয়ে দুইটি এখনই বিয়ের উপযুক্ত। ইসহাক মোল্যার এক মেয়ের বিয়ে হলেও আর একটির বিয়ের কথা হচ্ছে পাশের গ্রামের এক ছেলের সঙ্গে। ছেলেটি বড় হলেও কোনো কাজই করেন না তিনি। মান্দার মোল্যার তিন ছেলে দিনমজুরির কাজ করলেও বাবা-মায়ের দেখাশোনা করেন না তারা। তাই বাধ্য হয়েই পেটের দায়ে বাঁদায় এসেছে ৭০ বছরের এই বৃদ্ধ।        
                       
বাড়ি ফিরেই এ মৌয়াল দলটিকে মুখোমুখি হতে হবে মহাজনের। ৪০ হাজার টাকার সঙ্গে আরো ১০ হাজার টাকা দিতে হবে সুদ। এ টাকার সংস্থানই এখন তাদের কাছে মরণ যন্ত্রনা হয়ে দেখা দিয়েছে।

সুন্দরবনে আসা বনজীবীরা এভাবেই প্রতিনিয়ত সর্বস্ব হারাচ্ছেন। তাদের দেখভালের দায় যে বন বিভাগ এবং কোস্টগার্ডের হাতে তাদের সঙ্গে ডাকাতদের সখ্যতার অভিযোগ রয়েছে সব জায়গায়।

** ডাকাত বাহিনী নয়, ফার্ম!
** দস্যু বাহিনীর সন্ধানে
** ডাকাত আর মহাজন- দু’য়ে বন্দি বনজীবী
** প্রশাসনের সহায়তায় দস্যুতা!
** বনজীবী জিম্মি করে মারে, নিজেরাও মরে

বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বাংলানিউজ স্পেশাল এর সর্বশেষ