ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

বাংলানিউজ স্পেশাল

সুন্দরবনের ডাকাতেরা-৫

ডাকাত বাহিনী নয়, ফার্ম!

রহমান মাসুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১২ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৪
ডাকাত বাহিনী নয়, ফার্ম! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

১০ হাজার বর্গকিলোমিটারের বিশ্বের প্রধান ‘ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট’ সুন্দরবনের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটারেরই মালিকানা বাংলাদেশের। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৭ লাখ পরিবার এ বনের ওপর নির্ভরশীল।

কিন্তু গুটিকয় জলদস্যু ও বনদস্যুর হাতে জিম্মি এই মানুষগুলো। গোটা তিরিশেক ছোট-বড় দস্যু বাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের ভয়ে সন্ত্রস্ত বনজীবীরা। দস্যু বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না এ বনের প্রধান আর্কষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ এমন কি কুমিরও। দুই সপ্তাহের অনুসন্ধানে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ ঘুরে সাত পর্বের ধারাবহিক রিপোর্ট করেছেন বাংলানিউজের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট রহমান মাসুদ। আজ পড়ুন তার ধারাবহিক প্রতিবেদনের পঞ্চম পর্ব

সুন্দরবন থেকে ফিরে: ডাকাতি নয়, আমরা সুন্দরবনে ব্যবসা করি। আমাদের মতো এতোবড় ‘ফার্মকে’ (!)টাকা না দিয়ে জঙ্গলে কেউ ব্যবসা করতে পারবেন না। আমরা ৫০ জন মানুষ। সকলের আধুনিক অস্ত্রপাতি। সবাই প্রতি মাসে বেতন পান। সবার খাবার, কাপড়, বৌ-বাচ্চার ভরণ-পোষন সবই এ ‘ফার্মের’ আয়ের ওপর নির্ভরশীল। এর সঙ্গে আছে নিত্য-নতুন অস্ত্র ও গোলা-বারুদ সংগ্রহের খরচ। সব মিলিয়ে খরচ অনেক। প্রতি মাসে ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা আয় না হলে এতো বড় বাহিনী চালানো সম্ভব নয়।

কথাগুলো বলছিলেন রাজু বাহিনীর ব্যবস্থাপক মারুফ। রামপালের বাসিন্দা এই মারুফ এ বাহিনীতে আছেন প্রায় ৫ বছর। এরই মধ্যে তিনি রাজু বাহিনীর সকল আয়-ব্যয়ের হিসেব দেখার দায়িত্ব পেয়েছেন।

তিনি বলেন, সুন্দরবন সংলগ্ন তিন জেলার সকল মাছ-কাঁকড়ার ব্যবসায়ী, দাদনদার, মহাজন, মধু ব্যবসায়ী, চোরাই কাঠ ব্যবসায়ী, হরিণ, বাঘ ও কুমির শিকারিকেই আমাদের টাকা দিয়ে ব্যবসা করতে হয়।

মারুফ বলেন, সাধারণত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমাদের একটি চুক্তি হয়। ৪/৫ মাসের একটি সিজনে মাছ, কাঁকড়া ও পোনার নৌকা প্রতি চাঁদা নির্ধারণ করা আছে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। যারা টাকা দেন না তাদের নৌকা ধরে আনা হয় অথবা নৌকার যেকোনো একজনকে ধরে এনে জিম্মি করা হয়। মুক্তিপণ হিসেবে তখন ওই ধরে আনা ব্যক্তির মহাজন বা পরিবারের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা আদায় করা হয়।

তিনি বলেন, আমাদের দলনেতা রাজু (ছোট মিয়া) বর্তমানে ভারতে আছেন। আমরা সবাই তাকে সম্মান করি। তার নির্দেশনায় দল চলে। ছোট মিয়ার নির্দেশনা মতো এক একজন এক এক দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছি। ইলিয়াস পুরো বাহিনীর দেখ-ভাল করেন। জাহাঙ্গীরের কাজ পূর্ব বাঁদার অংশের ব্যবসা দেখা। রফিক দায়িত্বে আছেন পশ্চিম বাঁদার। ইলিয়াস বনের অন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন পরিচালনা করেন। আমি আছি সব হিসেব পত্তর, আয়-ব্যয় দেখভালে।

দলের ব্যবস্থাপক আরো জানান, মোবাইলেই টাকা পাঠান ব্যবসায়ীরা। টাকা পেলে আমরা ধরে আনা লোকজনকে নিরাপদে ডাঙ্গায় পাঠানোর ব্যবস্থা করি।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা সম্পর্কে তিনি বলেন, তারা আমাদের কিছু করতে পারে না। আমাদের ধরার মতো কোনো ইচ্ছা বা শক্তিও তাদের নেই। কোস্টগার্ডের ক্যাম্পগুলোতে যে কয়জন লোক থাকেন, তাদের দিয়েতো আমাদের কিছু করা সম্ভব না। তাই আমরাও তাদের ঘাটাতে যাই না, তারাও আমাদের ঘাটাতে আসেন না।

মারুফ বলেন, আমাদের টাকায় ৠাব-কোস্টগার্ডের পোষাক থেকে শুরু করে সিগারেট সবই চলে! তাই তারা অভিযানে বের হওয়ার আগেই আমরা খবর পেয়ে যাই। এমনও হয়েছে, আমরা যখন যে খালে থাকি সেই খালে ঢুকে পড়লে আমরা টেলিফোনে আমাদের অবস্থান জানালে কোস্টগার্ড বোট ঘুরিয়ে চলে যায়।

তিনি আরো বলেন, আমরা কেবল ভয় পাই কেবিন ক্রুজারগুলোকে। তাই বড় নদীতে আমরা দিনের বেলায় থাকি না। ছোট খালের মধ্যে থাকি। সরকারি বাহিনীগুলো আবার ছোট খালগুলোকে ভয় পায়। প্রতিটি খালের মুখেই আমাদের পাহারা চৌকি থাকে। তাই খালে ঢুকলে তারা জীবন নিয়ে ফিরতে পারবে না। আর বিকালের পর বনে কোনো বাহিনীর কোনো তৎপরতা থাকে না। বিকেল থেকেই পুরো বন কেবল আমাদেরই। সরকারি বাহিনীর ক্ষমতা নাই বনের মধ্যে কাঁদা আর শুলোয় আমাদের সঙ্গে দৌঁড়ায়।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ও অভিযান সম্পর্কে মারুফ বলেন, এর সবই লোক দেখানো। অভিযানের নামে বাহিনীগুলো কেবলই সরকারি টাকার শ্রাদ্ধ করে। ১০০ লিটার তেল পুড়িয়ে এক হাজার লিটারের বিল আদায় করে। সুন্দরবনে চাকরি করে যাওয়া বন বিভাগ ও কোস্টগার্ডের অফিসাররা আমাদের টাকায় বিপুল সম্পত্তির মালিক বনে যান। তাই বদলি হয়ে গেলেও তারা আবার বনে আসার জন্য উঠে-পড়ে লাগেন।

সুন্দরবনে ৠাব-পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ সম্পর্কে তিনি জানান, কেবলমাত্র ‌একটি প্রকৃত যুদ্ধ বনে হয়েছিল। বাকিগুলো ডাঙ্গা থেকে ধরে এনে নাটক সাজায় তারা।

এতো অস্ত্র-গুলি আসে কোথা থেকে? এ প্রশ্নের জবাবে মারুফ জানান, সবই আসে খুলনা থেকে। এগুলো সরবরাহের লোক আছেন। একটি এইট শ্যূটার গানের বাজার মূল্য সাড়ে চার লাখ টাকা হলেও আমরা দেই সাড়ে সাত লাখ টাকা। একটি গুলির দাম ৫শ’ টাকা হলেও আমরা দেই ১১শ’ টাকা। তাই ‘জিনিস’ পেতে কোনো কষ্ট হয় না।

তিনি বলেন, গুলির মূল সরবরাহ আসে প্রশাসনের কাছ থেকেই। টাকা দিলে কি না হয়রে ভাই!

জিম্মিদের সঙ্গে আপনারা কি ধরনের আচরণ করেন- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের দলের অনেক সদস্যই এক সময় আমাদের হাতে বন্দি হয়ে এসেছিলেন। কিন্তু আমাদের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তারা আর ফেরত যাননি। এখন তারা আমাদের দলেরই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। বর্তমান ভারপ্রাপ্ত দলনেতা ইলিয়াসকেও এক সময় ধরে এনেছিলেন ছোট মিয়া (রাজু)। এখন তিনি এ দলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান।

মারুফ বলেন, আমরা সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করি। আমাদের খাবার, পানি, ওষুধ সবাই সমানভাবে ভাগ করে নিচ্ছেন।

এ সময় নৌকায় রান্নার কাজে সহযোগিতা করা শ্যামনগরের নোয়াবেকির হাফিজুর, রামপালের পেড়িখালির মিলনকে দেখিয়ে মারুফ জানান, তারা সপ্তাহখানেক হলো আমাদের কাছে এসেছেন। এখন আমাদের লোকের মতোই আমাদের সঙ্গে মিশে গেছেন। জামিন হয়ে গেলে তারা চলে যাবেন।

তিনি বলেন, ছোট ছোট কিছু বাহিনী গড়ে উঠেছে। তারা জেলেদের অত্যাচার করে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে অপারেশন চালাচ্ছি। কিন্তু আমাদের দেখলেই তারা নৌকা ফেলে জঙ্গলে ঢুকে পড়ে।

জঙ্গলের আয় সম্পর্কে তিনি বলেন, গোলপাতায় ভালো আয় হয়েছে। গরানের পারমিট দিলে বছরে আরো কয়েক কোটি টাকা আয় হবে। এছাড়া ইলিশ মৌসুমে সাগরের আয় হয় কোটি কোটি টাকা। চট্টগ্রামের একটি ফিসিং বোট ধরলেই কয়েক লাখ টাকা আদায় হয়। এছাড়া নিয়মিত আয়তো আছেই।

টাকার ভাগ-বাটোয়ারা সম্পর্কে তিনি বলেন, অস্ত্রের ভাড়া বাবদ মোট আয়ের ৪০ শতাংশ চলে যায়। এরপর সিনিয়র-জুনিয়র হিসেবে বাকি টাকার হিসেব হয়। ভাগের টাকা সদস্যদের স্বজনদের কাছে চলে যায় মোবাইলের মাধ্যমে।

দলের জন্য বাজার আসে সাতক্ষীরা, মংলা ও খুলনা থেকে বলেও জানান তিনি।

এর কিছুক্ষণ পরই একটি বড় ট্রলার ঢুকলো খালে। নৌকা ভরা ফ্রেস পানির বোতল, টাইগার এনার্জি ড্রিংকস, ড্রাম ভরা রান্নার পানি আর বস্তা বস্তা বাজার। মৌসুমী ফল- আম, জামরুল, লিচু আর তরমুজ।

বনের হরিণ শিকার সম্পর্কে মারুফ বলেন, আমরা হরিণ মারি নিজেদের খাওয়ার জন্য। তবে মাস দুয়েক আগে দুটি বাঘ মেরেছিলাম। এরা আমাদের থাকার জায়গায় খুব ঝামেলা শুরু করেছিল। তবে বাঘের চামড়ার ভালো দাম পাইনি। মাত্র চার লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছিল চামড়া দু’টি। ঢাকা বা চট্টগ্রামে নিলেই এ দুটোর জন্য ২৪ লাখ টাকা পাওয়া যেতো। কুমির আমরা মারি বিপদে পড়লে। কিন্তু তা আমাদের কোনো কাজে আসে না।

** দস্যু বাহিনীর সন্ধানে
** ডাকাত আর মহাজন- দু’য়ে বন্দি বনজীবী
** প্রশাসনের সহায়তায় দস্যুতা!
** বনজীবী জিম্মি করে মারে, নিজেরাও মরে

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৫ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বাংলানিউজ স্পেশাল এর সর্বশেষ