ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

বাংলানিউজ স্পেশাল

সুন্দরবনের ডাকাতেরা-৩

ডাকাত আর মহাজন- দু’য়ে বন্দি বনজীবী

রহমান মাসুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১২ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৪
ডাকাত আর মহাজন- দু’য়ে বন্দি বনজীবী ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দশ হাজার বর্গ কিলোমিটারের ‘ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট’ সুন্দরবনের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটারেরই মালিকানা বাংলাদেশের। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৭ লাখ পরিবারের জীবন ও জীবীকা এই বনকে ঘিরে।

জলদস্যু ও বনদস্যুর হাতে জিম্মি এই মানুষগুলো। গোটা তিরিশেক ছোট-বড় দস্যুবাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের ভয়ে সন্ত্রস্ত বনজীবীরা। র‌্যাব পুলিশের সঙ্গে ক্রসফায়ারে পরে কোনো কোনো বাহিনীর প্রধান মারা পড়ে। ভেঙ্গে যায় সে বাহিনী কিন্তু শেষ হয়ে যায় না। আবার গড়ে ওঠে নতুন বাহিনী। নতুন সন্ত্রাস শুরু হয়। নতুন নতুন নামে। দস্যু বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না এই বনের প্রধান আর্কষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ এমন কি কুমিরও। দুই সপ্তাহের অভিযানে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ ঘুরে এসে রিপোর্ট করছেন বাংলানিউজের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট রহমান মাসুদ। আজ তৃতীয় পর্ব

সুন্দরবন থেকে ফিরে: জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করাই সুন্দরবনের ডাকাতদের একমাত্র আয়ের উৎস। ছোট-বড় দলভেদে এক একটি ডাকাত বাহিনী মাসে ৫০ লাখ টাকা থেকে ৫ কোটি টাকা বনের ওপর নির্ভরশীল সাত লাখ পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ হিসেবে আদায় করে।

দালাল ও মহাজনদের মাধ্যমে এ টাকা পরিশোধ করা হয় মোবাইল ব্যাংকিং ও বিকাশের মাধ্যমে। আবার এসব ডাকাতের সঙ্গে সমঝোতায় গরিব জেলেদের টাকায় ‘সাহেব’ হয়ে যান মহাজনেরা।

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের এক কাঁকড়া ব্যবসায়ীর জঙ্গলে দেড়শ’টি কাঁকড়ার নৌকা আছে। নৌকাপ্রতি ওই ব্যবসায়ী প্রতি সিজনে রাজু বাহিনীর নামে ৬ হাজার টাকা জেলেদের কাছ থেকে আদায় করেন। কিন্তু রাজু বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড জাহাঙ্গীরের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি রাজু বাহিনীকে কোনো টাকাই দেন না। তার ভাষ্যমতে, এসব ব্যবসায়ীরাই জঙ্গলের ‘আসল ডাকাত’। তাদের হাতেই আসলে বন্দি বনের জেলেরা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিদিন সুন্দরবনে গড়ে ৪ থেকে ৫শ’ বনজীবী ডাকাতের হাতে জিম্মি হন এবং মুক্তিপণের মাধ্যমে ছাড়াও পান। কিন্তু এ খবর লোকালয়ে আসে কমই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মহাজন এবং পরিবারের লোক ছাড়া কেউই বিষয়টি বুঝতে পারেন না। এ বিষয়ে প্রশাসনেও খবর দেন না জিম্মিদের স্বজনেরা। জীবনের ভয়ে মামলার চিন্তাও করেন না তারা।

তবে যারা মুক্তিপণ দিতে পারেন না, তাদের বছরের পর বছর বন্দি থাকতে হয়। এভাবে এক সময় জিম্মিরাও হয়ে যান ডাকাত দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আবার কাউকে ভারতে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। ধরিয়ে দেওয়া হয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে।

সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার নোযাবেকি ইউনিয়নের হাউয়াল ভাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা হাফিজুর রহমান (৩২) পোনা ধরতে এসেছিলেন সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের শিপসা নদীর মোহনা এলাকায়। সেখান থেকে তাকে জিম্মি করেছে রাজু বাহিনী। জনৈক আয়ুব মাস্টার হাফিজুরের মহাজন। বন্দি অবস্থায় হাফিজুরকে দিয়ে বাবুর্চির সহকারীর কাজ করানো হচ্ছে।

হাফিজুর জানান, বাড়িতে তার ২টি সন্তান রয়েছে। সঙ্গে বাবা-মা ও স্ত্রী। সাধারণত তিনি মৌসুমী ফলের ব্যবসা করেন। কিন্তু এবার বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে মহজানের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পোনা ধরতে এসেছিলেন। আর জঙ্গলে নামবেন না তিনি। প্রয়োজনে ভারতে গিয়ে হকারের কাজ করবেন।

হাফিজুর জানান, ডাকাতদের সঙ্গে তার মহাজনের কথা হয়েছে। অনেক দেন-দরবারের পর ৩০ হাজার টাকায় তাকে মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে রাজু বাহিনী। মহাজনের কাছে তার পরিবার ২/১ দিনের মধ্যে টাকা দিলেই মুক্তি মিলবে তার।

খুলনার দাকোপ উপজেলার ডাংমারি গ্রামের পরিমল মংলার মওলা মহাজনের হয়ে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন চাঁদপাই রেঞ্জের ঝাপসি নদীতে। এখান থেকে তাকে জিম্মি করে নিয়ে যায় মোসারফ বাহিনী (মসা বাহিনী)। ৭০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে মারধোর শুরু করেন মসা। পরে মোসারফের দেওয়া ৫টি নম্বরে মোট ৭০ হাজার টাকা বিকাশ করার পর মুক্তি মেলে পরিমলের।



পরিমল জিম্মি থাকা অবস্থায় গিয়েছিলাম সুন্দরবনের পাড়ঘেঁষা ঢাংমারি গ্রামে। পরিমলদের বাড়ির সামনেই একটি খাল বসতি আর বনকে আলাদা করেছে। পাড়ে দাঁড়ালেই খালের ওপারের বনের মধ্যে বনজীবীদের বানানো বনবিবির মন্দির চোখে পড়ে। এ গ্রামের জেলেরা বনে যাওয়ার সময় আপদ-বিপদ থেকে মুক্তির জন্য বনবিবির পূজা দিয়ে যান। মুসলমানরা গাজী-কালুর দোহাই দিয়ে নোয়াপাড়ার পীর সাহেবের পড়া লাল রুমাল নৌকায় গুঁজে বের হয়ে পড়েন। বনের বাঘ আর নৌকার কুমিরের হাত থেকে তারা রেহাই পেলেও রেহাই পান না ডাকাতের হাত থেকে।

তিন দিন আগে ছেলে অপহৃত হলেও কিছুই জানতেন না পরিমলের ৯০ বছর বয়সী বাবা সত্যরঞ্জন। ছেলেকে অপহরণের কথা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।

ডাকাতদের বিরুদ্ধে মামলা করেন না অপহৃতদের পরিবার ও মহাজন। অপহরণ ও মুক্তিপণের বিষয়টি কেউ জানুক- এটাও চান না তারা।

পরিমলের মহাজন মওলা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা বনে কাজ করি। এদের ঘাটিয়ে তো আমরা টিকতে পারবো না। আমাদের বনে না গিয়েতো উপায় নেই। মামলা করার পর বন থেকে তো আমাদের লাশটাও ডাঙ্গায় আসবে না।

তবে মহাজনরাও যে ‘ধোয়া তুলসি পাতা’- এটা ভাবার কারণ নেই বলে দাবি করলেন রাজু বাহিনীর একজন শীর্ষ নেতা।



তিনি বলেন, সুন্দরবনে কাজ করা জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালরা কেউই নিজেরা কাজ করেন না। তারা সবাই কোনো না কোনো ব্যবসায়ী ও মহাজনের হয়ে কাজ করেন। মহাজন-ব্যবসায়ীরা বন বিভাগ ও ডাকাতদের সঙ্গে সমঝোতা করে বনে মাছ ধরেন। এক্ষেত্রে বেশির ভাগই আমাদের কাছ থেকে টোকেন নিয়ে মাছ ধরেন। কেউ কেউ আমাদের টাকা না দিয়েই বনে লোক পাঠান। কিন্তু তিনি ঠিকই আমাদের কথা বলে জেলে-মৌয়ালদের কাছ থেকে টাকা কেটে নেন। আমরা ওই নৌকাগুলোকেই আটক করি।

এই ডাকাত সদস্য আরো জানান, জেলে-মৌয়ালরা মহাজনের কাছে ২/৩ বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ থাকেন। যখন চুক্তির সময় শেষ হয়ে আসে এবং ওই জেলে বা মহাজন বেশি লাভে অন্য মহাজনের কাছে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে, তখন পুরোনো মহাজন আমাদের দিয়ে অপহরণ করিয়ে মুক্তিপণ দেন।



এতে মহাজনের ২টি লাভ হয়। একদিকে তিনি তার কর্মীকে টাকার বিনিময়ে মুক্ত করে আবার চুক্তিতে আবদ্ধ করলেন, অন্যদিকে আমাদের ৫০ হাজার টাকা দিয়ে হয়তো কর্মীদের ২/৩ গুণ বলে নগদ লাভবান হলেন বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, মহাজনরা এমনিতেই চতুর প্রকৃতির হন। তারা আমাদের ২০ হাজার টাকা দিলে বন্দির পরিবারের কাছে ৭০ হাজার টাকার গল্প করেন।

** প্রশাসনের সহায়তায় দস্যুতা!

** বনজীবী জিম্মি করে মারে, নিজেরাও মরে

বাংলাদেশ সময়: ১৩০৮ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বাংলানিউজ স্পেশাল এর সর্বশেষ