ঢাকা, রবিবার, ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৮ জুন ২০২৫, ১১ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

কে জিতল: এপ্রিলে ক্ষুব্ধ বিএনপি, খুশি জামায়াত-এনসিপি

সিফাত বিনতে ওয়াহিদ, স্পেশাল করেসপনডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:৪৩, জুন ৭, ২০২৫
কে জিতল: এপ্রিলে ক্ষুব্ধ বিএনপি, খুশি জামায়াত-এনসিপি

ঢাকা: ৬ জুন, শুক্রবার জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথম দিকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই ঘোষণার পর দেশের রাজনীতিতে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।

বিএনপি সঙ্গে সঙ্গে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, ‘এপ্রিল মাসে নির্বাচনের কথা বলে আসলে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার পথ তৈরি করা হয়েছে। ’

বিএনপির এই প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে জামায়াতে ইসলামী ও নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। যদিও গত কয়েক মাস ধরে নির্বাচন কবে হবে— তা নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব চলছিল, এবার প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পর সেই বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এখন দুটি ভিন্ন পক্ষ পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান।

মোট কথা, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় বিএনপি ক্ষুব্ধ। দলটির শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে সেটি স্পষ্ট। অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে জামায়াত ও এনসিপি খুশি প্রকাশ করেছে— এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিএনপি শুরু থেকেই দাবি করে আসছে, জাতীয় নির্বাচন চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হতে হবে। অন্যদিকে, এনসিপি শুরু থেকেই বলছে— আগে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সংস্কার করতে হবে, এরপরই নির্বাচন সম্ভব। জামায়াতও প্রায় একই ধরনের অবস্থান নিয়েছে। তারা আগেই মত দিয়েছে, নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলেই হওয়া উচিত।

আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় বর্তমানে রাজনৈতিক ময়দানে বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামী। গত কয়েক মাস ধরে এই দুই দলের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে বাকযুদ্ধ প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টার এপ্রিলে নির্বাচনের ঘোষণা অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের কাছে প্রতিভাত হয়েছে ‘চাপের মুখে বিএনপির দাবি প্রত্যাখ্যান’ হিসেবে। তাদের মতে, প্রধান উপদেষ্টা বিএনপি ও সেনাপ্রধানের সময়সূচির প্রস্তাব না মেনে জামায়াতের পরামর্শ গ্রহণ করে এটা দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন, তিনি কোনো পক্ষের চাপের কাছে মাথা নত করবেন না। তবে, একাংশ বিশ্লেষক মনে করছেন, এপ্রিল মাসে নির্বাচন নির্ধারণের পেছনে প্রধান উপদেষ্টা তেমন কোনো স্পষ্ট বা গ্রহণযোগ্য যুক্তি এখনো তুলে ধরতে পারেননি।

সরকারের পূর্ব নির্ধারিত ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের সময়সীমাকে শুরু থেকেই সমর্থন দিয়ে এসেছে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি। বিশেষ করে এনসিপি শুরু থেকেই বলে আসছে, নির্বাচন আয়োজনের আগে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সংস্কার ও ‘জুলাই গণহত্যা’র বিচার কার্যক্রম শুরু করতে হবে। এখন প্রধান উপদেষ্টা এপ্রিল মাসে নির্বাচনের যে সময় ঘোষণা দিয়েছেন, সেটিকে গুরুত্ব দিয়ে ‘বিশেষভাবে মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নের’ ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে দলটি।

বিএনপিসহ ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দল যেখানে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়ে আসছে, সেখানে জামায়াতের দেওয়া এপ্রিলে নির্বাচনের প্রস্তাবের সঙ্গেই প্রধান উপদেষ্টার সময় ঘোষণা মিলে গেছে। এছাড়া, এনসিপির দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী আগামী মাসেই ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার পরিকল্পনা রয়েছে। এই পটভূমিতে এপ্রিল নির্বাচনকে বিএনপি সহজভাবে নেয়নি।

বিএনপি ও তাদের মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, সেনাপ্রধানের পরামর্শ এবং অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের দাবিকে উপেক্ষা করে সরকার মূলত জামায়াত ও এনসিপির পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই বিষয়টিকে ইঙ্গিত করেই বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বলছেন, সরকার এখন বিশেষ একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রভাবাধীন হয়ে পড়েছে।

তবে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পর সরকারের একজন উপদেষ্টা তার ব্যাখ্যায় বলেছেন— বিচার ও সংস্কারের কার্যক্রমকে একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছানো, প্রবাসী ও তরুণ ভোটারদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্যই এপ্রিলকে নির্বাচনকাল হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও জানান, আগামী বছর রোজার ঈদের পর নির্বাচনের সময় দেওয়ায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ভোটারকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা সম্ভব হবে, সেই বিবেচনাতেই এপ্রিল মাস নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর শুক্রবার রাতেই বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভার্চুয়ালি ওই বৈঠকে অংশ নেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের তীব্র সমালোচনা করে বিএনপি নেতারা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ঐকমত্যের কথা বললেও দেশের সিংহভাগ রাজনৈতিক দলের মতামত উপেক্ষা করেছে। তারা অভিযোগ করেন, সরকার বিশেষ একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেদের নিরপেক্ষ অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

সভায় আরও বলা হয়, এই বিশেষ গোষ্ঠীর প্রভাব যদি সরকারে থেকে যায়, তাহলে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব কি না— সে বিষয়ে দেশের জনগণ স্বাভাবিকভাবেই শঙ্কিত হয়ে পড়তে পারে।

বিএনপির প্রতি সরকারের এ আচরণ বিমাতাসুলভ মন্তব্য করে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই এই সরকারকে সহযোগিতা করে আসছি। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করেই ডিসেম্বরের কথা বলেছিল। আমরা এখনো বলছি, ডিসেম্বরই নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময়। বিএনপির প্রতি কেন যেন সরকার বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। নতুন সৃষ্ট দল এবং অন্য আরেকটি দলের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। ’

প্রায় একই কথা বলেছেন জনপ্রিয় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আব্দুন নূর তুষার। নিজের ফেসবুকে তিনি বলেছেন, ‘তাদের (অন্তর্বর্তী সরকারের) ধারণা জানুয়ারির এক তারিখে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করে তারা প্রায় পঞ্চাশ লাখ নতুন ভোটার ভোটে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন। এটাই হলো এই ইন্টেরিমের চেষ্টা। এনসিপি নামক দলটি তাদের পক্ষপাত পেয়েই চলেছে। তবে ভোট অত সোজা না। এই ইন্টেরিমের প্রত‍্যেককে ভোটে দাঁড়িয়ে দেখতে বলেন। সকলের জামানত বাজেয়াপ্ত হবে। এজন‍্যই এরা উচ্চকক্ষ চায়। বাজেয়াপ্তদের সমিতি গড়ার জন‍্য। ওখানে আবার নারীদের পক্ষ কোটাও চায়। ওই কক্ষে সব ডেট এক্সপায়ার্ড পঁচাত্তরের বেশি বয়সি স্মৃতিভ্রষ্টদের থাকার সম্ভাবনা আছে। এদের ধারণা এভাবে এনসিপি কোয়ালিশন করবে অন‍্য দলের সাথে আর বৃদ্ধরা সবাই উচ্চকক্ষে গিয়ে বসবে। ’

তবে কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকেই ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলে আসছিল। তাই এখন এপ্রিলকে নির্বাচনকাল হিসেবে ঘোষণা দেওয়া আসলে সেই পূর্বঘোষিত সময়সীমার মধ্যেই পড়ে। তাদের মতে, এটি নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নয়, বরং পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনারই বাস্তবায়ন।

এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বাংলানিউজ কে বলেন, ‘সরকার তো আগেই বলেছিল ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে যেকোনো সময় নির্বাচন হবে। সুতরাং তাদের জায়গায় ঠিক আছে। বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছিল। ফলে তারা এটা মেনে নেবে না, নানা কথাবার্তা বলবে, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশে রাজনীতির মাঠে কোনোকিছুই তো স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া হয় না। চার মাস আগে-পরে নির্বাচন দেওয়ায় তেমন কোনো সমস্যা তো দেখি না। বিএনপি আবহাওয়ার কথা বলছে, এটা একটা খোঁড়া যুক্তি। ১৯৯৬ সালের জুনে নির্বাচন হয়েছে। শতভাগ ভোটার উপস্থিতি এ দেশে আকাশ পরিষ্কার থাকলেও হয় না। এর আগে রোজা আছে, প্রচার চালানো যাবে না বলে তারা যেটা প্রচার করছে, সেটাও আমি যুক্তিযুক্ত মনে করি না। ’

রোজার মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে সমস্যা হবে, বিএনপির এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘তারা রোজার সময় হরতাল-অবরোধ দিয়েছে না? এখনো ঘরে ঘরে লিফলেট নিয়ে যেতে হবে কেন? মান্ধাতার আমলের এই প্রচারণা থেকে এখন সরে আসা উচিত। এখন সোশ্যাল মিডিয়া আছে। গণমাধ্যমেও সব দল ভালো প্রচার পাচ্ছে। সেখানেও তারা তাদের বক্তব্য দিতে পারে। রোজার মধ্যে বাড়ি বাড়ি যেতে না পারলে প্রতি সন্ধ্যায় ইফতার পার্টি দিতে পারবে। প্রচার এভাবেও করা যায়। কিন্তু যেহেতু তারা ডিসেম্বরে নির্বাচন দিতে ইনসিস্ট করছিল, তাই তাদের এ কথাগুলো বলতে হবে, তারা বলছেনও। ’

এপ্রিলে নির্বাচন দেওয়ায় কোনো রাজনৈতিক দল বিশেষ সুবিধা পাবে বলে মনে করেন না এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি বলেন, ‘চার মাস আগে-পরে নির্বাচন দেওয়ায় আমি মনে করি না কোনো দল বিশেষ সুবিধা পাবে। ভোটের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, (১) দলগুলো সব জায়গায় প্রার্থী দিতে পারছে কিনা, (২) পোলিং এজেন্ট ও কর্মীবাহিনী নিয়োগ দিতে পারছে কিনা। সব দলের তো এমনিতেও সেই ক্ষমতা নেই। এ মুহূর্তে শুধু বিএনপি আর জামায়াতের আছে। চার মাসে আগে-পরে দিলে যে অন্যদের সক্ষমতা খুব বেড়ে যাবে বা কমে যাবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। ’

অতীতে যেভাবে নির্বাচনকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, সে একই পদ্ধতি এখনো জারি থাকলে নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করেন করেন মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘আগে যেভাবে নির্বাচন ম্যানিপুলেশন করা হয়েছে, সেই পদ্ধতি এবারও যদি চলে তবে জুনে হোক, এপ্রিলে হোক, বা ডিসেম্বরে— ব্যাপক গোলমাল হবে। তবে রাজনৈতিক দলগুলো যদি সিদ্ধান্ত নেয় তারা কোনো রকমের পেশীশক্তি প্রদর্শন করবে না, ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত রায় মেনে নেবে, তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। ’

বিশ্লেষকরা সরকারের সময় ও কৌশলগত চিন্তাধারায় বিএনপিকে নিয়ে পার্থক্য দেখতে পাচ্ছেন। তবে তারা বেশি উদ্বিগ্ন সরকারের নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে, যেটাই এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখন মূল প্রশ্ন হচ্ছে—নির্বাচনের সময়কাল নির্ধারণে কারা সুবিধা পেয়েছে আর কাদের পিছিয়ে রাখা হচ্ছে? এবং এই সিদ্ধান্ত দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

এসবিডব্লিউ/এম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।