দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরে চলমান মতপার্থক্য, অবিশ্বাস এবং সংঘাতের আবহকে একটি কার্যকর সমঝোতার রূপ দিতে চলতি বছর ১২ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’।
নির্বাচন পদ্ধতি ও সংবিধান সংস্কার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবনার সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কিছু বিষয়ে একমত হলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এখনো মতভেদ রয়ে গেছে।
আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ছয়টি খাতে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ পর্যন্ত কমিশন ৩৪টি রাজনৈতিক দলের কাছে ১৬৬টি সুপারিশের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। এর মধ্যে ৭০টি সুপারিশ এসেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন থেকে, ২৭টি নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, ২৩টি বিচার বিভাগ সংক্রান্ত, ২৬টি জনপ্রশাসন বিষয়ে এবং ২০টি সুপারিশ দুর্নীতি দমন সংক্রান্ত।
কমিশন এখন পর্যন্ত ১৮টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছে। আলোচনার পর সব দলেরই একটি যৌথ ‘জুলাই সনদ’ এ সই করার কথা রয়েছে, যার ওপর নির্ভর করছে পরবর্তী নির্বাচন। জাতীয় সনদ তৈরি করতে সবার মিলিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি। এই সনদের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরের স্থায়ী প্রক্রিয়া চালু হবে। যার মাধ্যমে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে।
এ বিষয়ে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ ২৮ এপ্রিল (সোমবার) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে গণ অধিকার পরিষদের বৈঠকে বলেন, ‘গত ৫৩ বছরে মানুষের মধ্যে যে গণতান্ত্রিক আশা জন্মেছে, এখন সময় এসেছে সেই আশা বাস্তবে পরিণত করার। এই উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা সবাই মিলে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি করতে পারবো। ’
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কার ইস্যুতে থাকা মতভেদ দূর করা বা ন্যূনতম একটি সমঝোতায় পৌঁছানো কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। তবে সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারলে নির্বাচন অনুষ্ঠান বিলম্বিত হতে পারে, যা গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ফেলবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। পৃথিবীর বহু দেশে এই নজির আছে। জাতীয় স্বার্থে সবাই মৌলিক বিষয়গুলোতে একমত হলে দেশের কল্যাণ হবে। ’
সব দল সব বিষয়ে একমত না হওয়াটাই স্বাভাবিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই নিজস্ব মতাদর্শ থাকবে। একটি দলের সঙ্গে অন্য দলের মত মিলবে না, এটাও স্বাভাবিক। তবে যতটা একমত হওয়া যায়, ততটাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথকে সুদৃঢ় করে তুলবে। ’
সব বিষয়ে সবাইকে একমত হতে হবে না, এমনটা মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও। ২৭ এপ্রিল (রবিবার) গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে তো আমরা বাকশাল করতে যাচ্ছি না। সবাইকে যে একমত হতে হবে- এটা যারা চিন্তা করে, এটা বাকশালী চিন্তা, যেটা শেখ হাসিনার পিতা করেছিলেন। কারণ বিভিন্ন দলের বিভিন্ন দর্শন, বিভিন্ন চিন্তা থাকবে, ভিন্নমত থাকবে। যেখানে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলোর বাইরে সংস্কার করার সুযোগ নেই। এর বাইরে যেটা করতে যাবে, সেটা আপনার ডেমোক্র্যাটিক প্রসেসের মাধ্যমে আসতে হবে, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসতে হবে, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আসতে হবে। ’
কেউ মনে করছেন, প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে ফের স্বৈরতন্ত্র ফিরে আসার আশঙ্কা থাকবে। অন্যদিকে কেউ কেউ সতর্ক করছেন, সংস্কার ইস্যুতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হলে নির্বাচনই অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। সমঝোতার ক্ষেত্রে আলোচনার বিকল্প নেই জানিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে ১৯ এপ্রিল (শনিবার) সাংবাদিকদের বলেন, ‘শুধু ঐকমত্য কমিশন নয়, দলীয় উদ্যোগে আলোচনার পথটি খোলা রাখতে চাই। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরাসরি বসবো। নিজেদের মধ্যেও আলোচনা করবো। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় আসতে পারলে সেটি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হবে। ’
বিচার বিভাগ সংস্কারের প্রস্তাবিত ২৩টি সুপারিশের মধ্যে ২০টির সঙ্গেই দেশের অন্যতম বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপি একমত। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংশ্লিষ্ট ২০টি সুপারিশের মধ্যে ১৯টির বিষয়ে দলটির একমত বা আংশিক একমত হয়েছে। জনপ্রশাসন সংস্কারের ২৬টি প্রস্তাবের মধ্যে অর্ধেকের বেশি বিষয়ে তারা সম্মত হয়েছে, বাকি সুপারিশগুলোর ব্যাপারে তাদের মন্তব্য আছে। অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে ১১৩টির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
যেসব বিষয়ে ভিন্নমত
গণ পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তাবে একমত নয় বিএনপি। তারা এর বিরোধিতা করেছে স্পষ্টভাবে। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী চায় সংখ্যানুপাতিক ভিত্তিতে ভোট আয়োজন হোক। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দাবি, সংবিধান পুনর্লিখনের লক্ষ্যে একটি গণ পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।
সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছে, একই ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। অন্যদিকে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি বলছে- কেউ একটানা দুবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, তবে বিরতি দিয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী মত, এক ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ দুবার এবং ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী হিসবে তারা দেখতে চায় না।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) চাইছে, একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুটি মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন এবং প্রধানমন্ত্রী আর পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারের মেয়াদ হতে হবে চার বছর।
জামায়াতে ইসলামী সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং জাতীয় সরকার নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আগ্রহী হলেও, বিএনপি এবং তাদের রাজনৈতিক মিত্র দলগুলো এই প্রস্তাবের বিপক্ষে। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীর এই দাবির সাথে একমত রয়েছে এনসিপি এবং চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ আরও কিছু ইসলামী রাজনৈতিক দলের।
২৬ এপ্রিল (শনিবার) কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচনের পক্ষে জামায়াতের অবস্থান তুলে ধরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিশ্বের অন্তত ৬০টি দেশে এই পদ্ধতি সফলভাবে চলমান। কাজেই আমরা মনে করি, যে দল যতগুলো ভোট পাবে, তার ভিত্তিতে সংসদে তারা প্রতিনিধিত্ব করবে। ’
প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য যতদিন সময় প্রয়োজন হবে, সে সময় জামায়াত সরকারকে দেবে বলে জানানো হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে। একই মত এনসিপিরও। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এনসিপির মতের মিল পাওয়া গেলেও, বিএনপির সঙ্গে মতের অমিল ঐকমত্য কমিশনের ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
এদিকে ১৯ এপ্রিল (শনিবার), জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আইনসভার ক্ষেত্রে আমরা দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাকে সমর্থন করেছি। উচ্চ কক্ষ হতে হবে ভোটের আনুপাতিক, আসনের আনুপাতিক নয় এবং নির্বাচনের আগেই উচ্চকক্ষ প্রার্থী ঘোষণা দিতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। ’
সংবিধান সংস্কার কমিশন রাষ্ট্রপরিচালনায় প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতার অবসানের প্রস্তাব করেছে। তাদের ধারণা, বর্তমান ব্যবস্থায় সবকিছুই প্রধানমন্ত্রী নিয়ন্ত্রণ করেন এবং তার পরামর্শেই রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাচন করেন, যার ফলে রাষ্ট্রপতির কোনো কার্যকর ভূমিকা থাকে না। এই প্রস্তাবে সায় দেয়নি বিএনপি।
জাতীয় সাংবিধানিক ও নির্বাচনী সংস্কারের আরো কয়েকটি বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে একমত হয়নি বিএনপি। তবে জুলাই বিপ্লবে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া ছাত্রদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং জামায়াতে ইসলামী বেশিরভাগ বিষয়ে কমিশনের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে, গণতন্ত্র মঞ্চ ও ১২ দলীয় জোট বিএনপি’র প্রস্তাবের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছে। বিএনপির ৩১ দফা কর্মসূচির সঙ্গেও এই দলগুলোর সায় ছিল।
সরকার ও দলের নেতৃত্ব একই ব্যক্তির হাতে না রাখার প্রস্তাবেও ভিন্নমত পোষণ করেছে বিএনপি। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র রাজনীতি অনেক দিন ধরে চলে আসছে। এখানে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই কোনো একটি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকে। এই ধরনের রাজনীতি শুধু ক্ষমতার লড়াই নয়, পরিবারের ব্যক্তিগত সম্পর্কের মাধ্যমেও দল পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই প্রবণতা খুব স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এই পরিবারগুলোর বাইরে যদি দলের নেতৃত্ব চলে যায়, তবে সেই দলগুলো বিভক্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অতীতে যারা এসব দল থেকে বের হয়ে পৃথক দল করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, রাজনৈতিক অঙ্গনে তারা বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি।
ঐকমত্যের কমিশনের প্রস্তাবে ১৯৭১ এবং ২০২৪ সালকে সমানভাবে মূল্যায়ন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বিএনপি এতে সমর্থন জানায়নি। রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তন নিয়েও তাদের দ্বিমত রয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ কমিশনের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে এই প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, ‘একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে সমমর্যাদায় কোনো কিছু আসতে পারে না। এ দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদাই আলাদা। ২০২৪-কে তার সঙ্গে একই কাতারে টেনে আনা ঠিক নয়। ফলে সংবিধানের প্রস্তাবানায় যেভাবে পরিবর্তন আনার কথা বলা হচ্ছে, তার সাথে আমরা একমত নই। ’
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীর মত- সংবিধানের মূলনীতিতে ‘আল্লাহর প্রতি অবিচল ঈমান-আস্থা’ পুনঃস্থাপন করা। তারা সংবিধানে সাম্য, গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচারের নীতিগুলো বজায় রাখার পক্ষে। আর বিএনপি পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার পক্ষেই রয়েছে, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে এনসিপির কোনো স্পষ্ট বক্তব্য নেই।
কমিশন প্রস্তাব করেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কেউ অভিযুক্ত হলে তাকে নির্বাচনের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হোক। এই প্রস্তাবের সঙ্গেও একমত হয়নি বিএনপি। তাদের মতে, কাউকে অভিযুক্ত করলেই তাকে দোষী বলা যায় না, আর শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে কাউকে অযোগ্য ঘোষণা করা যুক্তিসংগত নয় বলেও দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। বিএনপি বলছে, শুধুমাত্র আদালতের রায়ে প্রাথমিকভাবে দোষী সাব্যস্ত হলে তবেই তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা উচিত।
দেশে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার জন্য নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা এবং বিচার বিভাগ- এই তিনটি বিভাগের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ (এনসিসি) গঠন করারও সুপারিশ আছে কমিশনের। তবে, এই প্রস্তাবও বিএনপি গ্রহণ করেনি। সংবিধান, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন প্রক্রিয়া ও দুর্নীতি দমন কমিশনের বিষয়ে কিছু দ্বিমত জামাতেরও রয়েছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে নিয়োগের প্রস্তাব করলেও, বিএনপি কিছুটা পরিবর্তন চায়। ২২ এপ্রিল (মঙ্গলবার) কমিশনের সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, বিচারব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়ার যে সুপারিশ করেছে, বিএনপি তাতে দ্বিমত পোষণ করেছে।
বিতর্কিত নিয়োগ যাতে না হয়, সে লক্ষ্যে আপিল বিভাগের দুই থেকে তিনজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতির মধ্য থেকে একজনকে বাছাই করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। বিএনপির একমত না হওয়া আরো প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে- সংসদ ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ চার বছর করা। সংবিধান সংশোধনে দুই কক্ষের অনুমোদনের পর গণভোট করা। জরুরি অবস্থা জারির প্রস্তাবিত বিধান। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি। মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা নামে আলাদা অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা। নিম্নকক্ষে তরুণদের জন্য ১০ শতাংশ আসনে মনোনয়ন দেওয়া এবং সংসদ নির্বাচনের জন্য ন্যূনতম বয়স ২১ বছর করা।
অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে সংবিধান সংস্কার কমিশনের বেশিরভাগ প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। কিছু নতুন প্রস্তাবও উপস্থাপন করেছে তারা। তাদের মূল প্রস্তাবগুলো হলো- একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুটি মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন এবং প্রধানমন্ত্রী আর পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারের মেয়াদ হবে চার বছর। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের মাধ্যমে এবং উচ্চকক্ষের পরামর্শে সাংবিধানিক পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। সংসদ হবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট এবং উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতিক হারে।
এছাড়াও এনসিপির অন্যান্য প্রস্তাবের মধ্যে আছে- ১০০টি আসনে সরাসরি ভোটে নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হবে ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতিতে, যেখানে নিম্নকক্ষ, উচ্চকক্ষ, জেলা সমন্বয় কাউন্সিল এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত করবেন। ’৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতি এবং পরবর্তী সংশোধনীর মাধ্যমে গৃহীত দলীয় মূলনীতিগুলোকে সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া হবে।
এনসিপির প্রস্তাবনাগুলো মধ্যে আরও আছে- বাংলাদেশের অধিবাসী প্রতিটি জাতি ও নৃ-গোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে। প্রার্থীদের ন্যূনতম বয়স ২৩ এবং ভোটাধিকারের ন্যূনতম বয়স ১৬ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী এবং দলের প্রধান একই ব্যক্তি হতে পারবেন না। সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা এবং সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধন করতে হবে।
যেসব বিষয়ে একমত
সংসদের উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের সদস্য সংখ্যা নিয়ে একমত বিএনপি। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় তারা নির্বাচিত হবেন, তা নিয়ে আলোচনা চলমান আছে। পাশাপাশি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থীরা দলীয় প্রতীক ব্যবহার করতে পারবেন না, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই প্রস্তাবে বিএনপি সমর্থন জানিয়েছে। সংবিধানে বহুত্ববাদ নিয়ে সংশোধনীতেও কমিশনের সঙ্গে একমত বিএনপি।
এছাড়াও বিএনপি একমত হয়েছে, বিদ্যমান সংবিধানের ৭ (ক) ও ৭ (খ) ধারা বিলুপ্ত করা, সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করা, উভয় কক্ষে ডেপুটি স্পিকারের একটি পদ বিরোধী দল থেকে দেওয়া, রাষ্ট্রপতির অভিশংসন প্রক্রিয়া, ‘অধস্তন আদালত’ শব্দের পরিবর্তে ‘স্থানীয় আদালত’ ব্যবহার করা, অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য সংখ্যা ১৪ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার বিষয়গুলোতে। তবে এনসিপি সব সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদ বিরোধী দলকে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে, আর বিএনপি কিছু কমিটির পদ বিরোধী দলকে দেওয়া যেতে পারে বলে জানিয়েছে।
ভিন্নমত থাকাটা রাজনৈতিক বাস্তবতার অংশ, বিশেষ করে যখন সংবিধান বা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মতো মৌলিক বিষয়ে আলোচনা চলে। তবে বিএনপি, এনসিপি এবং জামায়াতসহ অন্যান্য দলের মতামত বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, মতানৈক্য থাকলেও তা অপরিবর্তনীয় নয়। যথাযথ রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এবং পরস্পরের প্রস্তাবগুলো খোলামনে বিশ্লেষণ করলে ভিন্নমতের অবসান ঘটিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব।
ঐকমত্য কমিশনের উদ্দেশ্যই এমন একটি সহনশীল ও আলোচনাভিত্তিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা, যা এই মুহূর্তে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজন। সব দল মৌলিক সংস্কারের বিষয়গুলোতে ঐকমত্যে না পৌঁছালে যেমন নির্বাচন পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, তেমনই থেকে যায় ফ্যাসিবাদের ফিরে আসার আশঙ্কাও।
এসবিডব্লিউ/এজে