ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

আওয়ামী লীগ

গৌরীপুরে ফকির রাজত্বের অবসান

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৬ ঘণ্টা, মে ৩, ২০১৬
 গৌরীপুরে ফকির রাজত্বের অবসান ছবি: অনিক-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) থেকে ফিরে: পান থেকে চুন খসলেই মাথা ন্যাড়া করতেন। বিকৃত মানসিকতায় হেনস্থা করতেন প্রতিপক্ষকে।

দিগম্বর করতেন প্রকাশ্যে। চাঁদাবাজি, ক্যাডার পালনের মধ্যে দিয়ে বনে যান গডফাদার। তার ক্যাডার বাহিনীর দাপটে অস্থির ছিল রাজা-জমিদারদের তীর্থ ভূমি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলা।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারী সর্বত্রই ছিল তার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ। এতে অসহায় হয়ে পড়েছিল পুলিশ প্রশাসনসহ সরকারি কর্মকর্তারাও। খোদ দলীয় নেতা-কর্মীদেরও রেহাই মেলেনি এমপি’র শাসন ও বিশেষ বাহিনীর তাণ্ডব থেকে। গোটা উপজেলাজুড়ে ছিল তার একক রামরাজত্ব।

তিনি ক্যাপ্টেন (অব.) মুজিবুর রহমান ফকির। ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য। সোমবার (২ মে) সকালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এমপি ফকির। আর এরই মাধ্যমে গৌরীপুরে অবসান ঘটে এমপি ফকিরের একচ্ছত্র রাজত্বের।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান ফকির চাকরি থেকে অবসরের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দেন। জীবনে প্রথমবার ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পেয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

প্রথম মেয়াদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও তার বিরুদ্ধে দখল, চাঁদাবাজি, অনিয়ম, দুর্নীতি কিংবা নিজ দলীয় প্রতিপক্ষকে নানা কূটকৌশলে হয়রানি-নির্যাতনের কোন অভিযোগ ছিল না। কিন্তু ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন তার জীবনের মোড় পাল্টে দেয়। এমপি হয়ে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।

এরপর আমূল বদলে যেতে শুরু করেন এক সময়কার পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির এ রাজনীতিক। ওই সময়েই নিজের চিরাচরিত রাজনীতির ধাঁচ বদলে আবির্ভূত হন মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে। শুরু করেন একের পর এক অপকীর্তি। ক্যাডারবেষ্টিত হয়ে চলাফেরা শুরু করেন। যখন তখন যে কারো উপর নেমে আসতো তার শাস্তির খড়্গ।

প্রতিমন্ত্রিত্ব পেয়ে বেশ দাপটের সঙ্গেই তিনি মন্ত্রণালয় চালান। এরপর আর নিজ এলাকার দলীয় নেতা-কর্মীদের পাত্তা দেননি। চ্যালা-চামুন্ডা বেষ্টিত হয়ে উল্টো ক্ষমতার ৫ বছরে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের তৃণমূল প্রতিনিধি তার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেন, গৌরীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিধূভূষণ দাস।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অপেক্ষাকৃত দুর্বল স্বতন্ত্র প্রার্থী নাজনীন আলমের সঙ্গে মাত্র ২৮ হাজার ৫’শ ১৭ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। এরপর উপজেলার কলতাপাড়ায় তার বিশ্রামের জন্য নির্মিত সেবালয়কে রূপ দেন টর্চার সেলে।

ওই সেবালয়েই স্থানীয় বাসিন্দাদের ধরে নিয়ে করা হতো অমানুষিক নির্যাতন। স্থানীয় সংসদ সদস্যের গুণধর ভাতিজা ফারুক আহমেদ ছিলেন এ টর্চার সেলের নিয়ন্ত্রক। এসব কর্মকাণ্ডে নির্বাচনের আগেই তার অপকীর্তি ও ত্রাসের রাজত্বের খবর ছড়িয়ে পড়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মুখে মুখে।

সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের আগে তার প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী নাজনীন আলমের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর কারণে মাথা ন্যাড়া ফর্মুলা নিয়ে হাজির হন স্থানীয় সংসদ সদস্য ক্যাপ্টেন (অব:) মুজিবুর রহমান ফকির। সেই সময় স্থানীয় কলতাপাড়া এলাকায় ভাঙনামারি ইউনিয়নের যুবলীগ নেতা ছোটনের মাথা ন্যাড়া করেন এমপি।

এরপর ওই বছরের ১৪ মে স্থানীয় ডৌহাখলা ইউনিয়নের বিএনপি কর্মী মোকসেদুলের (২৩) মাথা ন্যাড়া করেন। পরে তাকে তুলে দেয়া হয় পুলিশের হাতে। শেষ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় তিনটি মামলা। এসব মামলায় তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। এমপি ফকিরের এ মাথা ন্যাড়া থেরাপির মুখে পড়েছেন এমন আরো কয়েকজন।

স্থানীয়রা জানান, সব সময় বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দিতেন ক্যাপ্টেন (অব:) মুজিবুর রহমান ফকির। নিজেও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অশ্লীল-আপত্তিকর মন্তব্য করতেন। উপজেলা ও দলে নিজের একক আধিপত্য ধরে রাখতে তিনি এমন গডফাদারের মতো আচরণ করতেন।

সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার নামে উপজেলা পরিষদের সামনে ভাস্কর্য নির্মাণে রীতিমতো চাঁদাবাজি শুরু করেন এমপি মুজিব। তালিকা তৈরি করে উপজেলার বিশিষ্টজনদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হতো। যারা চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানাতেন তাদের উপরই নেমে আসতো এমপি’র বিশেষ বাহিনীর সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবলীলা।

গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের গতিবিধি ও কার্যক্রম মনিটরিং করতে উপজেলায় মোট ৮টি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বসান এমপি। পরবর্তীতে এ নিয়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হলে সব সিসি ক্যামেরা খুলে ফেলা হয়। সপ্তাহখানেক আগে ম্যুরালের আশেপাশে ৬টি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়।

গোটা গৌরীপুর নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত বছরের ৫ জুন এইটটি বাহিনী নামে একটি বাহিনী গঠন করেন এমপি মুজিব। দলবেঁধে মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া, অ্যাকশন, প্রতিপক্ষের লোকজনকে ধরে এনে বেদম মারপিট, লাঞ্ছিত করা, টাকা আদায় সবই ছিল এ বাহিনীর কাজ।

এ বাহিনীর প্রধান ছিলেন এমপি’র গুণধর শিষ্য ভিপি শহীদ। স্থানীয় প্রশাসনেও এ বাহিনীর দাপট ছিল।

মোটরসাইকেল নিয়ে এমপি’র নির্দেশে এরা বিভিন্ন অভিযানে যেতো। গত বছরের ৫ জুন স্থানীয় মইলাকান্দা এলাকায় এক আওয়ামী লীগ নেতার দোকানে হামলা চালায় এইটটি বাহিনী। এর মাত্র চারদিন পর ৯ জুন স্থানীয় রামগোপালপুরে ইউনিয়ন বিএনপি নেতা জালাল আহম্মেদকে ধরতে এসে গণধোলাইয়ের মুখে পড়ে এমপি ফকিরের এ বাহিনী।

সূত্র জানায়, গৌরীপুর উপজেলার ধুরুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এ কে এম মাজহারুল আনোয়ার এমপির অনুমতি ছাড়াই বদলি হয়ে যান। এই অপরাধে ওই বছরের ৫ জুন বিকেলে শ্যামগঞ্জ বাজার এলাকা থেকে তাকে ধরে নিয়ে আসে এ বাহিনীর লোকজন।

পরে সেবালয়ের বাথরুমে তাকে আটকে রেখে মোটরসাইকেল ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। সন্ধ্যার পর এমপি নিজে শিক্ষক সমিতির কার্যালয়ে তাকে ডেকে নিয়ে প্রকাশ্যে মারপিট করেন। এতেই থেমে থাকেনি এমপি’র শাস্তির খড়্গ।

সংসদ সদস্য ফকিরের নির্দেশেই তার একমাত্র পুত্র রাফিদকে গৌরীপুর পৌর মডেল স্কুল থেকে টিসি দেয়া হয়। পরবর্তীতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে আবারো বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান রাফিদ।

সোমবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে গোটা গৌরপুরের চিত্র যেন বদলে গেছে। এমপি ফকিরের রাজত্বের অবসান হওয়ায় স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলছেন বেশিরভাগ বাসিন্দা। স্থানীয় গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ড, কলেজ রোড, কালিপুর, কালিখলাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেলো এমন চিত্র।

স্থানীয় বুকাইনগরের ইউপি সদস্য হায়দার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সবাই এখন ভয়মুক্ত। এখন আর শাসন করার কেউ নেই। বিকৃত মানসিকতার এ এমপি’র জন্য কারো চোখে পানি নেই। একজন জালেম শাসকের হাত থেকে মুক্তি মিলেছে সবার।

স্থানীয় মোহাম্মদ নগর এলাকার ফজলুল হকও একই রকম মন্তব্য করেন। স্থানীয় কালিপুর এলাকায় বিকেলে আলাপ হচ্ছিল তাদের সঙ্গে।

একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একজন এমপি মারা গেলে গোটা উপজেলায় শোকাবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। আর এখানে এ ধরনের কোন পরিবেশ নেই।

নীরব নিথর সেই ‘টর্চার সেল’
এমপি ফকিরের হাতে নির্যাতিতরা
‘দিগম্বর হবার পর আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না’

বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, মে ৩, ২০১৬
এমএএএম/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।