ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

এভিয়াট্যুর

কাশ্মীর ভ্রমণ

খিলানমার্গের পর্বত চূড়ায়

তুহিন ডি. খোকন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪১ ঘণ্টা, জুন ৮, ২০১৪
খিলানমার্গের পর্বত চূড়ায় ছবি: লেখক

ভূ-স্বর্গ কাশ্মীর। প্রকৃতির বিচিত্র রঙের অলঙ্করণে সজ্জিত।

তুষারশুভ্র বরফ আর নীল পাহাড়ে ঘেরা এর গ্রামগুলো যেন তেল রঙে আঁকা। এক দিনে কি শেষ হয় এর সৌন্দর্য উপভোগ! প্রিয় পাঠক, কাশ্মীর ভ্রমণ নিয়ে থাকছে তিন পর্বের ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী। আজ থাকছে এর দ্বিতীয় পর্ব...      

পরদিন সকালে যথারীতি ভোর সাড়ে ৫টায় ঘুম ভাঙলো। ভোরবেলার শ্রীনগর দেখার প্রবল ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতেই হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে একা একা বেরিয়ে আসি হোটেল রুম থেকে জগিংয়ের পোশাকে, অন্যসবাই তখনও গভীর ঘুমে। এই ভোরেও হোটেলের মেইন গেইট খোলা।

রহস্যটা উম্মোচিত হলো একটু পর— যখন আমি ডাল লেকে পাশে দিয়ে দৌঁড়তে শুরু করি। শত শত কাশ্মীরি হাঁটছে, দৌঁড়াচ্ছে ডাল-লেকের পাশ ধরে। কিছুক্ষণ দৌঁড়ানোর পর ঠাণ্ডা মোটামুটি সহনীয় হয়ে এলো। ডাল লেকের ঘাটগুলো নাম্বারিং করা। এই ভোরে সেইসব ঘাট স্বাস্থ্য -উদ্ধাররত কাশ্মীরিদের দখলে। উল্লেখযোগ্য, নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিন্দুমাত্রও শিথিল নয় অপুষ্ট এই ভোরেও।

স্বচ্ছতোয়া ডাল লেকের অভ্যন্তরে প্রচুর জলজ উদ্ভিদ, ছোট-ছোট রূপোলি মাছ খেলছে গুল্মলতা ঘিরে। তুলতুলে ছোট ছোট বালিহাঁসের কয়েকটি ছানা জলকেলিরত। জুম লেন্স সঙ্গে না থাকায় মোটামুটি কাছে গিয়ে ছবি তুলবার জন্যে যেই ক্যামেরা তাক করেছি, অমনি তাদের দীর্ঘ ডুব সাতাঁর শুরু হয়ে গেল, এইখানে ডুব দেয় তো দ‍ূরে গিয়ে ভেসে ওঠে। শেষে ব্যর্থ হয়ে হোটেল রুমে ফিরে সবাইকে জাগিয়ে দিই। সবাই ফ্রেশ হয়ে দলবেঁধে মোড়ের ছোট্ট নাস্তার দোকানটিতে ছোলাবাটুয়া ও গরম পুরি সহকারে ব্রেকফাস্ট সেরে নিই। রুমে ফিরে সবাই তৈরি হয়ে নিলাম গুলমার্গ যাওয়ার জন্যে। ততক্ষণে আমাদের ড্রাইভার রিয়াজ ভাই আমাদের জন্যে বরাদ্দ টয়োটা-ইনোভা নিয়ে হাজির। শুরু হলো গুলমার্গ যাত্রা।



যেহেতু কলকাতা থেকে কেনা প্রিপেইড সিম কাশ্মীরে অচল, তাই রিয়াজ ভাই যোগাযোগের সুবিধার্থে তার একটি সিমকার্ড ধার দিয়েছিলেন। রিয়াজ ভাইকে ডানে-বামে ড্রাইভিং ডিরেকশন দিতেই তিনি অবাক বিস্ময়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি আগে কাশ্মীর এসেছি কিনা। আমি তাকে আমার অ্যান্ড্রয়েড ফোনে গুগলের ডিরেকশন দেখালাম। বললাম দিন অনেক পাল্টে গেছে, এখন জায়গা না চিনলেও জিপিএস চিনিয়ে দেবে। অতএব নো চিন্তা।

কাশ্মীরে ভ্রমণার্থীদের জন্যে উদ্রেকের বিষয় হলো, পথে পথে টোল পরিশোধের ঝামেলা, যা গাড়ির যাত্রীকেই বহন করতে হয়। কোথাও একশ, কোথাও পঞ্চাশ, কোথাও বিশ রুপি দিয়ে তবে মুক্তি। এরকম প্রায় তিনটি ব্যারিকেড পেরিয়ে আমাদের ইনোভা পৌঁছালো গুলমার্গ জিপ স্ট্যান্ডে। গাড়ি পার্কিয়েও ১০০ রুপি!

গাড়ি থেকে নামতেই একদল ঘোড়াওয়ালা ঘিরে ধরে, গুলমার্গ ঘুরিয়ে দেখাবে আর যেহেতু গেন্ডোলা (রোপওয়ে-কার) বন্ধ তাই তারাই বরফের কাছে নিয়ে যাবে। আসার আগেই এই ঘোড়াওয়ালাদের প্রতারণার ঘটনা পড়েছিলাম, তাই ওদের কথায় কান দিলাম না। দু’জন কাশ্মীরি পুলিশ এগিয়ে এলে তাদের জিজ্ঞেস করি, সত্যি সত্যি গেন্ডোলা বন্ধ কি-না। ওরাও জানায়, রিপেয়ারিংয়ের জন্যে ফেইজ ওয়ান ও ফেইজ টু অভিমুখী গেন্ডোলাই বন্ধ। ভগ্নচিত্তে আমরা হাঁটতে শুরু করি, আর পেছন পেছন ঘোড়াওয়ালারা।

পরিস্থিতিটা অনেকটা এই রকম, আমরা ঘোড়া নিবো না, আর ওরা আমাদের ঘোড়ায় চড়িয়েই ছাড়বে। আমরা চুপচাপ হাঁটছি আর ওরা পেছন থেকে নানারকম মন্তব্য করছে ...কতটুকু পায়ে হেঁটে যেতে পারো দেখা যাবে, কিছুই দেখতে পারবে না ইত্যাদি।



কিছুক্ষণ পর একজন ঘোড়াওয়ালা এক পুলিশকে নিয়ে এলো আমাদের বোঝাতে যে, হেঁটে হেঁটে গুলমার্গ দেখা যায় না। পুলিশটিও আমাদের ইনিয়ে-বিনিয়ে বোঝাতে লাগলো গুলমার্গ-দর্শনে ঘোড়ার গুরুত্ব। অবশেষে আমি ও নোমান দরদাম করতে শুরু করি, শুরুতে একটি ঘোড়া ৮০০ রুপি বললেও ১০০ রুপি দিতে রাজি হই। অনেক বাগ-বিতণ্ডার পর প্রতি ঘোড়া ২০০ রুপিতে রফা হলো শুধুমাত্র নারী ও শিশুদের জন্যে। আমি ও নোমান পায়ে হেঁটেই রওনা হই ওদের পিছুপিছু।

প্রথমে যাই চিলড্রেন পার্কে। গলফ-কোর্টের মতোই সবুজ ঘাসের বিস্তীর্ণ মাঠ, চারপাশে পাইন ট্রির নন্দিত শোভা, মধ্যখানে কৃত্রিম পাথুরে লেক। মাঠের মাঝে মাঝে বসবার জন্যে কারুকার্যশোভিত মেটাল বেঞ্চ।

বন্ধের দিন হওয়াতে মোটামুটি অনেক কাশ্মীরি পিকনিক পার্টি করতে ভিড় করেছে পরিবার-পরিজনসহ। সবার সঙ্গেই দুপুরের খাবার-দাবার, গ্যাস-স্টোভ ও পুরো গ্যাস-সিলেন্ডার (জীবনে এই প্রথম এমন ব্যবস্থা দেখলাম), পরে অবশ্য এর যথাযথ কারণটা অনুধাবন করি। এখানে এখন গড় তাপমাত্রা ১৫ থেকে ১৭ ডিগ্রি (দিনের বেলায়), তাই ঘর থেকে বানিয়ে আনা খাবার ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। এ কারণেই গ্যাস-স্টোভ ও সিলিন্ডার একমাত্র গরম খাবারের নিশ্চয়তা দিতে পারে। আমাদের পক্ষে তো বাংলাদেশ থেকে গ্যাসের চুলা বা সিলিন্ডার নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই বিস্কিট ও ঠাণ্ডা পানি সহযোগে আমাদের মিনি লাঞ্চ সেরে নিই পার্কে বসে।

কিছুক্ষণ পর দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর জন্যে রওনা দিই গেন্ডোলা স্টেশনের দিকে। চড়তে না পারি অন্তত স্টেশন আর কারগুলো দেখে আসি। গুলমার্গে অবস্থিত আর্মি ক্যাম্প ঘুরে স্টেশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তান-বর্ডার সংলগ্ন পর্বতচূড়ায় অকস্মাৎ কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা গেলো। জলবতী মেঘ, করাৎ-করাৎ শব্দে বাজ পড়ছে থেকে থেকে। আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি। কারণ এই ঠাণ্ডার মধ্যে যদি বৃষ্টিতে ভিজে যাই, তাহলে আমাদের শিশুদের তো বটেই, আমরা বয়স্করাও নিউমোনিয়ার আক্রমণ ঠেকাতে পারবো না। যেহেতু আমাদের সঙ্গে বাড়তি কোনো পোশাক নেই, তাই ঘোড়াওয়ালাদের বললাম তাড়াতাড়ি কোনো ছাউনির নিচে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। তারা আমাদের আশ্বস্ত করলো এই বলে যে বৃষ্টি ঠিক ওই পর্বতমালার ওপরই ঝরবে, খোলা এই উপত্যকায় পড়বার সম্ভাবনা খুব কম। ঘোড়াওয়ালাদের ভবিষ্যতবাণী সত্যি হলো। জোরালো এক পশলা বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি ধোঁয়াশাময় পর্বতগুলোকে মিনিট পাঁচেক ভিজিয়ে দিয়ে উধাও হয়ে গেল। শুকনো অবস্থাতেই আমরা গেন্ডোলা স্টেশনে পৌঁছলাম।



স্টেশনে পৌঁছে দেখি বিশাল লম্বা লাইন। ওরে বাবা! সবাই কি আমাদের মতো দুধের-স্বাদ ঘোলে মেটাতে এসেছে নাকি। স্টেশনের সিকিউরিটি গার্ডদের জিজ্ঞেস করতেই আসল সত্য বেরিয়ে এলো। ফার্স্ট-ফেইজে গেন্ডোলা ঠিকই চলছে, শুধুমাত্র মেন্টেনেন্সের জন্যে সেকেন্ড-ফেইজ বন্ধ।

প্রথমেই ধরলাম ঘোড়াওয়ালাদের আমাদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতারণা করার জন্যে। আমাদের অভিযোগ তাদের কানে গেল কী-না ঠিক বোঝা গেল না। কারণ তখন তারা উদাস ভঙ্গিতে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। কি আর করা, নোমানকে পাঠালাম তাড়াতাড়ি টিকেট কিনতে। প্রতিটি টিকিট ৪০০ রুপি। টিকিট কেটে প্রায় ঘণ্টা-দেড়েক লাইনে দাঁড়ানোর পর আমাদের পালা এলো গেন্ডোলা চড়ে ফাস্ট-ফেইজ তথা খিলানমার্গের পর্বত চূড়ায় পৌঁছানোর। একেবারে খাড়া পর্বতের ঢালে পাইন গাছের ফাঁকে ফাঁকে রোপওয়ের টাওয়ার। ধীরে ধীরে রোপওয়ে উঠছে আমাদের নিয়ে, আর আমরা জীবনে প্রথমবার গেন্ডোলা চড়ার উত্তেজনায় রীতিমত লাফাতে লাগলাম, একটিমাত্র তারের ওপর ভাসমান এই যন্ত্রের পেটের মধ্যে বসে। সঙ্গে সঙ্গে সাটাসাট ছবি, ওর ছবি এ তোলা হচ্ছে, ডিজিটাল ক্যামেরার আদতই তো আলাদা! বিশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেলাম খিলানমার্গে। গেন্ডোলা স্টেশন থেকে বেরুতেই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। এই ভরদুপুরে এখানকার তাপমাত্রা এখন মাত্র পাঁচ থেকে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাতে না জানি কি অবস্থা দাঁড়ায়!

আমাদের লাইট লাঞ্চ অনেক আগেই হজম, খিদেয় সবার পেটে ছুঁচো ডন মারছে। তাই যেমন হোক, কারো জন্যে নুডুলস, কারো জন্যে ফ্রাইড রাইসের অর্ডার দিই এক ভাসমান হোটেলে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা তাই একেবারে চুলো থেকেই সরবরাহ হচ্ছে আমাদের আইটেম।



খাওয়াদাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে খিলান মার্গের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখা এবং সমান তালে চললো ছবি তোলা। এর মাঝেই পরিচয় হলআ কিছু কাশ্মীরি যুবকের সঙ্গে।

কাশ্মীরের আবহাওয়া সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা পাই এসব যুবকের কাছ থেকে। চির শীতের রাজ্যখ্যাত খোদ কাশ্মীরেই নাকি এমন জায়গা আছে যেখানের গড় তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস!

খিলানমার্গ থেকে ফিরতে ফিরতে হঠাৎ নেমে আসা পাহাড়ি সন্ধ্যা আমাদের পেয়ে বসলো। অন্ধকারের সঙ্গে ঠাণ্ডাও চেপে আসছে সমান তালে।

রিয়াজ ভাইকে বললাম তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে আসতে। আপেলের ভরা মৌসুম এখন। গুলমার্গ থেকে ফেরার পথে পার্শ্ববর্তী বাগান থেকে প্রায় পঁচিশ-কেজি ওজনের একপেটি আপেল কিনে নিলাম মাত্র ২০০ রুপিতে।

রাত ৮টার দিকে শ্রীনগর শহরে পৌঁছে প্রথমেই রেস্টুরেন্ট-করিমসে কাশ্মীরি বিরিয়ানি নামে অখাদ্য খেলাম। কেউ যেন ভুলেও এই রেস্টুরেন্টে না ঢোকে!

ইতোমধ্যে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছি। তাই পায়ে হেঁটেই হোটেলে ফিরি। ফিরে সবাই সোজা বিছানায়, পরদিনের গন্তব্য সোনমার্গ।

আগামী পর্বে থাকছে...
গ্রামগুলো যেনো তেল রঙে আঁকা

প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।

আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।

প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- [email protected] এই ঠিকানায়।

বাংলাদেশ সময়: ১২২২ ঘণ্টা, জুন ০৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।