ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

এভিয়াট্যুর

সিভিল এভিয়েশন খাতের সংকট ও সম্ভাবনা

মাছুম কামাল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৭, ২০২২
সিভিল এভিয়েশন খাতের সংকট ও সম্ভাবনা

ঢাকা: বুধবার বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘বৈশ্বিক এভিয়েশন উন্নয়নে দরকার অগ্রসরমান উদ্ভাবন’।

তবে, বাংলাদেশে দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা হয় না। ফলে, এ নিয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ও বিমানের কোনো কর্মসূচি নেই।

১৯৪৪ সালে কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন সনদ স্বাক্ষরিত হয়। এই সনদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ১৯৯৪ সাল থেকে দিনটি উদযাপন করে ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইকাও)। এর দুই বছর পর ১৯৯৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৭ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন দিবস হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর আইকাও সিভিল এভিয়েশন দিবসের মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে থাকে। এবারের মূল প্রতিপাদ্য ২০১৯ সালে নির্ধারিত হয়।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এভিয়েশন খাত। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সিভিল এভিয়েশন অধিদফতর ও বাংলাদেশ বিমান করপোরেশন স্থাপন করলেও পরবর্তীতে এ খাতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সারা বিশ্বজুড়েই সিভিল এভিয়েশন অথরিটি এবং বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনা আলাদাভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

কিন্তু, বাংলাদেশে ১৯৮১ সালে সিভিল এভিয়েশন অধিদফতর এবং বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ দুটো আলাদা সংস্থাকে একীভূত করে একটি সংস্থা করা হয়। সময়ের প্রয়োজনে বর্তমানে আবারো সিভিল এভিয়েশন অথরিটি থেকে বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনা পৃথক করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

আশার ব্যাপার হচ্ছে, বর্তমানে দেশের সকল অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরগুলোর সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশের সকল অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরগুলোর সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করা হচ্ছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আঞ্চলিক বিমানবন্দর করে তুলতে নেওয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের করতে চলছে উন্নয়ন কার্যক্রম। এরই অংশ হিসেবে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এর কাজ শেষ হয়েছে ৫১ শতাংশ। আশা করা হচ্ছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর নাগাদ এটি উদ্বোধন করা হবে। একই সাথে বিমানবন্দরে একটি অত্যাধুনিক রাডার নির্মাণ কাজ চলমান আছে, যা সম্পন্ন হলে নিরাপদ বিমান চলাচল নিশ্চিত  করা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে গতি বাড়বে বিমান চলাচলের।

শুধু ঢাকা নয়, সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আঞ্চলিক বিমানবন্দর করে তুলতে নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন উদ্যোগ। কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের করতে চলছে উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম। চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে ঠাকুরগাঁও ও ঈশ্বরদীতে বিমানবন্দর নির্মাণের।

তবে সামগ্রিকভাবে এখন পর্যন্ত সেভাবে আগাতে পারেনি দেশীয় এই খাত। অনেক প্রত্যাশা এবং আশার বাণী শোনানো হলেও বাস্তবতা হচ্ছে এখনো প্রথম শ্রেণির মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। এর ফলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করাও সম্ভব হচ্ছে না।

দেশের এভিয়েশন খাত ও এর সংকটসহ নানা বিষয়ে কথা হয় এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলমের সঙ্গে। কী কারণে এগোচ্ছে না এই খাত—এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, স্বাধীনতার আজকে ৫০ বছর হয়ে গেলেও সিভিল এভিয়েশনে প্রায়োগিক কিছু উন্নতি ছাড়া কোনো অগ্রগতি হয়নি সত্যিকার অর্থে। গত ৫০ বছরে আমরা একটা এয়ারপোর্ট দেশে করতে পারিনি। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যখন উদ্বোধন করা হয়, সে সময় থেকে বর্তমানে যাত্রীসংখ্যা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু, সে তুলনায় যেভাবে সম্প্রসারণ করার কথা তা হয়নি। টাইম টু টাইম টার্মিনাল কিছুটা সম্প্রসারণ করা হয়েছে বা ফ্যাসিলিটি বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে যে নতুন করে চিন্তাভাবনা করা বা ডেভেলপমেন্ট করা সেগুলো কিছুই হয়নি।

কাজী ওয়াহিদুল আলম আরও বলেন, চট্টগ্রাম বিমানবন্দর উদ্বোধন করা হয় ২০০০ সালের দিকে। সেটিও ঠিকভাবে ব্যবহারযোগ্য নয়। সেখানেও কিছু ত্রুটির কারণে, প্যারালাল ট্যাক্সিওয়ে না থাকার কারণে ও অন্যান্য কিছু ত্রুটির কারণে সেখানে গত ২২ বছরে আর কোনো সম্প্রসারণ করা বা অগ্রগতি হয়নি। ওখানে একটা কার্গো ভিলেজ নেই, একটা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা, তা না থাকার কারণে বিদেশি কোনো সংস্থা সেখানে ফ্লাইট পরিচালনা করে না। অল্প কিছু বিদেশি লো-কস্ট ক্যারিয়ার ছোট প্লেন নিয়ে সেখানে অপারেট করে। চট্টগ্রামে একটা বড় বেইজ আছে মিডলইস্ট বা অন্যান্য দেশে যাওয়ার প্যাসেঞ্জার আছে, কিন্তু তারা সেখান থেকে যেতে পারছে না। কারণ সেখানে বিদেশি এয়ারলাইনস অপারেট করে না। এজন্য যেসব ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সেগুলো সরকার বা সিভিল এভিয়েশনের তরফ থেকে নেওয়া হয়নি।

সিলেট এয়ারপোর্ট রানওয়ের কিছুটা সম্প্রসারণের কাজ হয়েছে, ওখানে এখন বিমান ঢাকা থেকে সিলেট হয়ে লন্ডনে যায়। কিন্তু, সেটাও সীমিত আকারে। এছাড়া অন্য কোনো বিদেশি এয়ারলাইনস সেখানে অপারেট করে না। যদিও সরকার বা সিভিল এভিয়েশন দাবি করছে, ওটা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। আমাদের সিলেট এবং চট্টগ্রাম দুটোই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, কিন্তু সেখানে সত্যিকার অর্থে ইন্টারন্যাশনাল অপারেশন শুরু হয়নি বা সীমিত আকারে হচ্ছে, যেটাতে এয়ারপোর্ট বা তার যে পরিচালন ব্যয় সেটা বহন করা কঠিন।

তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি কক্সবাজারে আবার নতুন করে একটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরির কাজ চলছে। সরকার একটা বড় ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে সমুদ্র থেকে ল্যান্ড রি-ক্লিন করে নান্দনিকভাবে রানওয়ে তৈরি করেছে বা কাজের অগ্রগতি হচ্ছে। কিন্তু, আমাদের যেখানে বেসিক প্যাসেঞ্জার আছে, যেমন চট্টগ্রাম বা সিলেটে, তাদেরকেই ঠিকভাবে সার্ভ করতে পারছে না বিমানবন্দরগুলো। কক্সবাজার এয়ারপোর্ট আন্তর্জাতিক মানের হলে শুধু ট্যুরিস্ট নির্ভর যারা তারাই সেখানে যাবে। কিন্তু বিদেশ থেকে আমাদের কক্সবাজারে আসা ট্যুরিস্টের সংখ্যা খুব আহামরি কিছু হবে না, যেটার জন্য একটা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ওখানে করা যুক্তিসঙ্গত হবে।

এভিয়েশন খাতের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, আমরা যদি সৈয়দপুর বিমানবন্দরের কথা যদি বলি, গত ৫-৭ বছর ধরে আমরা শুনছি ভুটান-নেপাল সৈয়দপুরে একটা রিজিওনাল হাব হিসেবে এই বিমানবন্দর ব্যবহার করতে চায়। সরকারও এটা করার একটা নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু, এটা মুখে-মুখেই রয়ে গেছে। কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। এই বিমানবন্দরটাকে কার্যকর করা গেলে নেপাল এবং ভুটানে যেহেতু কোনো বিকল্প বিমানবন্দর নাই, আবহাওয়া বা অন্যান্য কারণে যদি তাদের ইমার্জেন্সি ল্যান্ড করতে হয় তবে তাদের যেতে হয় কলকাতায় বা অন্য গন্ত্যব্যে। এইক্ষেত্রে সৈয়দপুর একটা ক্লোজেস্ট বিমানবন্দর হতে পারতো, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারতো। ল্যান্ডিং-পার্কিং চার্জ পেত, ন্যাভিগেশন চার্জ পেত, ফুয়েল চার্জ পেত এটা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। এই বিমানবন্দরকে ফ্যাসিলেটেড করা খুব কঠিন কিছু হতো না। কিন্তু, এ বিষয়ে কোনো সমন্বিত উদ্যোগ বা কর্মপরিকল্পনা চোখে পড়ছে না।

তিনি বলেন, আরেকদিকে আমাদের এখানে নতুন করে কোনো ডেস্টিনেশন ডেভেলপ করা হয়নি। ডমেস্টিকে আমাদের ৪টি এয়ারলাইনসই (বিমান বাংলাদেশ, ইউএস বাংলা, নভোএয়ার, এয়ার অ্যাস্ট্রা) ভালো সার্ভিস দিচ্ছে, কিন্তু এই নেটওয়ার্ক খুবই ছোট। শুধু এই নেটওয়ার্কে তাদের এয়ারক্রাফটগুলোর প্রপার ইউটিলাইজেশন হচ্ছে না। তারা রেভিনিউ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

কাজী ওয়াহিদুল আলম আরও বলেন, আমাদের এখানে নতুন এয়ারপোর্ট তো দূরে থাক, বিদ্যমান বিমানবন্দরগুলোকেও সচল করার কোনো উদ্যোগ আমরা দেখছি না। শমসেরনগর, কুমিল্লা, ঠাকুরগাঁও, বগুড়া, ঈশ্বরদীতে এয়ারপোর্ট আছে। ২০০০ সালের প্রথম দিকেও ঈশ্বরদী এয়ারপোর্টে বিমান এবং এয়ার পারাবাত নামে একটি প্রাইভেট এয়ারলাইনস ফ্লাইট পরিচালনা করেছে। এখন ঈশ্বরদীর গুরুত্ব কিন্তু অনেক বেড়ে গেছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যেহেতু আছে। প্রতিদিন কয়েকশো রাশিয়ান এবং দেশি-বিদেশি কর্মচারী-কর্মকর্তা রূপপুরে যাতায়াত করেন। তাদের সড়কপথে ৬-৭ ঘণ্টা ব্যয় করতে হয়। যদি সেখানে এয়ারপোর্ট চালু থাকতো, সেটা ওই প্রকল্পের কাজের জন্যও ভালো হতো।

তিনি বলেন, আমরা যদি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে তাকাই, গত ৪ বছরে সেখানে ৩৬টা নতুন এয়ারপোর্ট হয়েছে। নতুন ডেস্টিনেশন। আমাদের যে এয়ারপোর্টগুলো আছে, সব জায়গায় রানওয়ে আছে, টার্মিনাল আছে, শুধু সচল করা বাকি। হয়তো রানওয়ে একটু সম্প্রসারণ করা, মেইনটেন্যান্স সুবিধাটা ঠিক করা, এগুলো করলেই ৫-৭টা এয়ারপোর্ট চালু করা যায় এবং এতে সাধারণ মানুষও উপকৃত হয়। এ ব্যাপারে বিশেষ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।

কাজেই, আমাদের সম্পদ বা সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে সিভিল এভিয়েশন অনেক দূরে এগিয়ে যেতে পারবে। আমাদের চাহিদা আছে, এটা কাজে লাগিয়ে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো প্রচুর রেভিনিউ অর্জন করছে। সুতরাং এভিয়েশন খাতকে এগিয়ে নিতে হলে এভিয়েশনবান্ধব পলিসি তৈরি করতে হবে বলে জানান কাজী ওয়াহিদুল আলম।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০২২
এমকে/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।