ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ফরিদ কবিরের ১৩ কবিতা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১২
ফরিদ কবিরের ১৩ কবিতা

আশির দশকের কবি ফরিদ কবির। ১৯৮৫ সালে ‘হৃদপিণ্ডে রক্তপাত’ কাব্যগ্রন্থ দিয়ে সাহিত্যাঙ্গনে তার যাত্রা।

এরপর একে একে তিনি প্রকাশ করেন কাব্যগ্রন্থ-- ওড়ে ঘুম ওড়ে গাঙচিল, অনন্ত দরোজাগুচ্ছ, মন্ত্র,  ওঁ প্রকৃতি ওঁ প্রেম।

এবারের মেলায় বের হয়েছে ফরিদ কবিরের এ পর্যন্ত প্রকাশিত সমস্ত কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সংকলন ‘ আমার কবিতা’।

বইটি প্রসঙ্গে ফরিদ কবির ভূমিকাতে লিখেছেন ‘আমার গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলো নিয়েই এই বই। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, আমার ৫টি গ্রন্থে ছাপা হয়েছে সাকুল্যে ২০০ টি কবিতা! আমার প্রকাশিত গ্রন্থগুলিতে জায়গা পায়নি যেসব কবিতা, সেগুলোকে আর নিজের কবিতা বলতে চাই না। ’

বইটি প্রকাশ করেছে অনন্যা প্রকাশনী। বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য ‘আমার কবিতা’  থেকে তুলে ধরা হলো ১৩ টি কবিতা।

মেঘ-অরণ্যের মধ্যে

ঘরসুদ্ধ শূন্যে উঠে গেছি
নিচে মেঘ, চারপাশে মেঘের পাতাল
সবুজ মেঘের চুলে হাত আর পা জড়িয়ে যাচ্ছিলো
আমার শকট এসে মেঘ বনে থামে।

বাতি নেই, এতো অন্ধকারে
পাশের ঘরটি কোনদিকে চলে গেলো?
মাত্র কিছুক্ষণ আগে তুমি
রূপালী চন্দ্রকে নিয়ে ভেতরে ঢুকেছো
আর আমি, তোমাদের ফেলে দেখো কোথায় এসেছি!

দু`চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে
বহুদূর থেকে উঁকি দিচ্ছে বিচ্ছেদের ছুরি, আর
একটানা ঘেউ-ঘেউ শব্দে ডেকে যাচ্ছে অন্ধকার!

কিছুতেই আমার আপত্তি নেই, শুধু তাকে ডেকে
এই মেঘ-অরণ্যের মধ্যে নিয়ে এসো
তাহলে শূন্যেও আমি কখনো ঘুমুতে চাইবো না
 

সূর্যকে রেখেছি

পয়শা ছিলো না ভেবে দু’পকেটে রেখেছি সূর্যকে
সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার সমস্ত পৃথিবী
সূর্যাস্তের লোভে যারা জমা
    হয়েছিলো শহরের ছাদে
মুহূর্তে অসুস্থ হয়ে গেলো তাদের কয়েকজন
দু’পকেটে হাত রেখে আমি এগুলাম।

হঠাৎ পাখির মতো দেখতে একটি কালো পাখি
অন্ধকারে ধাক্কা খেলো বাড়ির কার্নিশে
কাজেই সমস্ত লোক পাখি হয়ে গেলো
তাদের পয়শা আছে, এখন দরকার শুধু সূর্য।

কিন্তু, সূর্য আমার পকেটে

যে-মুহূর্তে লোকজন আকাশ খুঁড়তে শুরু করলো
আমার তখনই খিদে পেলো।

পয়শা ছিলো না বলে দু’পকেটে রেখেছি সূর্যকে।


বাড়ি

একটি বাড়ির দিকে উঁকি দিলো আরেকটি বাড়ি
ভেতরে মানুষ নেই, সিগারেট ঠোঁটে
বসে আছে জানালার কাচ
বুক-শেলফ হেঁটে গেলো পয়মন্ত চেয়ারের দিকে
দুলছে চেয়ার

বিছানায় শুয়ে আছে বালিশের প্রেত
জানালার পাট চোখ তুলে
দেখে নিলো চন্দ্রের আলোকে
মৌমাছির মতো টেবিলের ওপর উড়ছে ঘুম
ডায়েরির পাতা

কার্নিশে কার্নিশ ছুঁয়ে শাদা বাড়িটিকে
চুমু খেলো দোতলা বাড়িটা

বাড়িতে কেউ কি আছে? সারারাত জেগে
খুব ভোরে ঘুমিয়ে পড়লো আলনায় ঝুলে থাকা
মুণ্ডুহীন শার্ট
পা কোথায়? হাতের আঙুল?
বাতাসে ডানার গন্ধ, আর
বাড়ির ভেতরে ফিসফিস
হাত পা আঙুল খুলে আলনায় ঝোলে মুণ্ডহীন শার্ট
একবার শুধু বুক-শেলফ
হেঁটে গেলো পয়মন্ত চেয়ারের দিকে
দুলছে চেয়ার
মৌমাছির মতো
টেবিলের ওপর উড়ছে ঘুম, ডায়েরির পাতা

একটি বাড়ির দিকে হেঁটে এলো আরেকটি বাড়ি।



কোত্থেকে ভয়ের পাতা

কোত্থেকে ভয়ের পাতা ছিঁড়ে নিয়ে বাড়িতে ঢুকেছি

আশেপাশে নেকড়ে ছিলো না
    ডাকেনি শৃগাল
    তবে কেন মুঠোভর্তি চলে এলো ভয়ের সবুজ?

পাথর ঠুকছে নাকি কেউ?
এতো শব্দ কোত্থেকে আসছে?
কেউ এসে কান পাতো, এইমাত্র হুঁইসিল বাজিয়ে
    ছুটে গেলো ট্রেন
    কোন ট্রেন? কোনদিকে গেলো?
মুঠো খুলতেই দেখি লতাপাতাসহ
ভয়ের শিকড়
হাতের চামড়া ছিঁড়ে মাংশের ভেতরে

এখন বাড়ির দেয়ালেও উসখুস
    ঘরভর্তি পাতার নিঃশ্বাস
    পলেস্তারা খুলে উঁকি দিচ্ছে চন্দ্র-ভ্রুণ
চন্দ্র-ভ্রুণ নয়
শিকড়ের সরীসৃপ দেয়ালের পর্দা ছিঁড়ে চাটলো আমাকে!


ময়ূরের কথা, পাথরের কথা

ময়ূরের কথা, পাথরের কথা ছাড়ো
বুকের শোকেসে জমা রাখো কিছু ফুল
তুমিও জানো না, আমিও জানি না ভালো
ময়ূর কীভাবে হয়ে যায় নীল ঢেউ!

বৃষ্টির রাতে স্বপ্নের কথা ভেবে
পাবে না কখনো ঝলমলে প্রিয় ভোর
নির্জন রাত তোমাকে দেবে না তুলে
ক্রন্দন ছাড়া আর কোনো চেনা সুর।

যে মাছের খোঁজে গোপনে সাজাও নদী
সাজাও বিশটি গোলাপের সঞ্চয়
জানো না তোমারই চোখের স্বচ্ছ জলে
কাটছে সাঁতার স্বপ্নের এ্যাঞ্জেল

ময়ূরের কথা, পাথরের কথা ছাড়ো
তোমার বুকেই পাথর রয়েছে জমা
সে পাথর যদি খুলে আনো এক টানে
ময়ূর তাহলে পাথর হবে না, জেনো!


সময়

কাবাবের মতো ঝুলে আছো লাল শিকে
শরীর পোড়ার গন্ধ বোঝো না তবু
অলক্ষ্যে যেন ধারালো কাঁচিতে কেউ
কাগজের মতো কেটে নেয় পোড়া ঘ্রাণ!

তবু তুমি বাঁচো, ভাসো অগ্নির জলে
সময়ের গাঢ় উত্তাপে হও নীল
জানো না তবুও ক্ষত চিহ্নের দাগে
পাপের ধূসর রঙ মেখে দেয় কেউ!

অথচ তোমার ধারালো দাঁতের ফাঁকে
চুরমার হলো দুপুরের কালো ক্রোধ
তবে কেন আর জীর্ণ দেয়াল খুঁড়ে
খোঁজ করো তুমি স্বপ্নের আস্বাদ!

কাবারের মতো ঝুলে আছো লাল শিকে
অথচ বোঝে না শরীর পোড়ার ঘ্রাণ
পাথর দিনের চুল্লিতে পুড়ে আজো
ভাঙলো না, তবু ভাঙলো না কালঘুম!


লোকটা

বিশতলা থেকে লাফিয়ে পড়েছে ক্রোধ
দশতলা থেকে থুতু
নিচতলা থেকে ঘৃণা
পাঁচদিক থেকে গলগল করে ঢুকছে সাহস
নামছে দেয়াল বেয়ে রক্ত, রক্ত-ঘাম

দু’টি মেয়ে দুই যুবকের ঠোঁটে চুমু খেয়ে বললো-
ওই যে লোকটা, পোশাকের নিচে তার
ধারালো তরবারি
এক হাতে কীট-দষ্ট ফুল
অন্য হাত ঝুলছে চেয়ারে
ওকে ফেলে এসো দূর গহীন জঙ্গলে
ওর মাংস ছিঁড়ে খাক কুকুর-শেয়াল

একটি যুবক শার্ট খুলে তুলে নিলো রৌদ্রজল
গায়ে রোদ না মেখে সে মিছিলে যাবে না
অন্যজন মিশে গেলো শ্লোগান-প্লাবনে

নিচতলা থেকে ঘৃণা
দশতলা থেকে থুতু
বিশতলা থেকে লাফিয়ে পড়েছে ক্রোধ

আর,-
লোকটা দেয়ালে পিঠ দিয়ে
সামরিক কায়দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে!


বস্ত্রশিল্প

শঙ্কিত পাথরখণ্ড ভেদ করে চলে যায় মেঘ
পোশাক রোরুদ্যমান, সূত্রহীনতায়!

হে মেষপালক, শঙ্খ বেজে উঠতেই
কেন তুলে নিলে উষ্ণ কাপড়ের ঘ্রাণ!
লোভ-চক্ষু থেকে নেমে আসে মেয়ে মৌমাছির ঝাঁক
লজ্জাস্থান ঢাকে বাতিবৃক্ষ

দুয়ারে দুয়ারে মাথা তোলে শীতবস্ত্র
সোনামুদ্রা ফেলে যায় মানবপ্রজাতি।

এতোটা বিভ্রম ঠিক তাদের সাজে না
ঢেউটিন দেখে ভাবে, সমুদ্র-তরঙ্গ
তাঁতি-বংশে নিভে যায় প্রেরণার বাতি।

দু’টি মাকড়শা এসে সেই স্থান অধিকার করে।


পর্যটনমোহ

রক্তমাখা ফল পড়ে আছে
গোপনে ঢুকিয়ে দিচ্ছো তাতে বাঘনখ

সমস্ত নির্জন রাস্তা আতংকিত পায়ে
ঢুকে যাচ্ছে বিভিন্ন গলিতে
যেন কেউ সংক্রামক বিষের বল্লম
গেঁথে দিচ্ছে ফলের ফুসফুসে

বাতাসে কিসের গুঁড়ো? যেন এইমাত্র
উড়িয়ে দিয়েছে কেউ হিংসার ধুলো।

ফলের চারদিকে ধোঁয়া দেখে মনে হয়,
ডানায় যন্ত্রণাগন্ধ মেখে সেই মাছি
আজও তার পর্যটন সমাপ্ত করেনি।


মন্ত্র-১

অন্তত ধানের দর্প চূর্ণ করে দাঁড়িয়েছি মোমের সিঁড়িতে
এসো, এইবার দেখি, এইটুকু শস্য ফেটে কোন স্বর উত্থিত হয়েছে!
সমস্ত মৃত্তিকাগর্ভে ছড়িয়ে পড়েছে ভাঙা কাচ
এখন ছত্রিশ টুকরো দেহ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ঝিনুক-কুমারী।

এই মুক্তো তুলে রাখো ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরের জন্য
শুধু আমি পবিত্র গ্রন্থের চোখে তুলে দিচ্ছি ক্রন্দন-কৌশল।

যদি কেউ ডাকে, যদি রাতের উনুন জ্বলে ওঠে, জ্বলতে দাও
চতুর্দিকে তার চিৎকারের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়–ক

সকল প্রস্তরীভূত জ্যোৎস্নাবাগানের কাছে পৌঁছে দাও তাকে
যেন সেও সূর্যমোরগের ডাক শুনে
দেহের চামড়া খুলে দেখতে পারে মাংশের ধনুক।


প্রেম

তোমার চুল থেকে চান্দ্রমাছগুলি মাটিতে নেমে গেলো
গলা ও বুক জুড়ে তিনটি ঝর্ণার নরম স্রোত দেখে
হাসলো স্বপ্নের বেড়ালছানাটিও।

তোমার একদম কাণ্ডজ্ঞান নেই
ধনুকে ছুঁড়ে দিলে প্রবল বৃষ্টির ধারালো ফোঁটাগুলি
তুমি কি ভেবেছিলে, পৃষ্ঠে ডানাঅলা মোমের চাঁদ আমি?
পারদে প্রস্তুত শরীর নিয়ে হাঁটি
তোমার জানা নেই
ধারালো জলছুরি আমার এই দেহ কাটতে পারবে না।
আমার হাত দুটো কখনো হাত নয়
রুমাল-খণ্ডের মতোই পারি তাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিতে

তোমাকে হাতে পেলে মুঠোই খুলবো না
তুমি তো তাই চাও, নীলিমা-চক্ষুর অন্তরালে বসে
আমাকে খুলে দেবে গরম নিঃশ্বাস

তোমার গ্রীবা থেকে স্বর্ণ-জল নামে
পাহাড়ি ঢালু থেকে আলোর চিলগুলি হঠাৎ উড়ে যায়
কোথায় উড়ে যায়?



স্পর্শ

স্পর্শ এক অদ্ভুত ভ্রমণ...

নৈকট্য লাগে না
সমুদ্রের এপার থেকেও পাওয়া যায়
হুবহু বাতাস, ওপারের
পড়ে নেয়া যায় আদ্যোপান্ত
           আকাশের সাতটি পৃষ্ঠাই

কী করে এমন হয়, বলো-
স্পর্শ করি, তোমাকে না ছুঁয়েই!
এলোমেলো করে দেই
        শরীরের স্বাভাবিক ঢেউ

তোমাকে স্পর্শের পর মনে হয়,
শরীরের একশ সাতটি গলি
       ঘুরে দেখা সম্পন্ন করেছি



খুন

করো চলাফেরা ধমনীতে, উপশিরায়, শিরায়
এই স্রোত চলুক নির্জনে
আমাকে রঞ্জিত করে আপাদমস্তক তুমি বয়ে চলো
টগবগ ফুটতে থাকো হৃদয়ে, মস্তিষ্কে
আমাকে পুড়িয়ে দাও তোমার গরমে

বলো, কেন হলে তুমি এতোটা আগ্রাসী!
মিশে যাচ্ছো রক্তের প্রচ- লালে, শুভ্র কণিকায়
ছুটে যাচ্ছো শরীরের আনাচে-কানাচে!

তোমাকে ছিনিয়ে নিতে এখন তৎপর
ভয়ংকর আলপিন, ঘাতক ছুরিও...

গোপনে তোমাকে বলি--
তোমার একটা ফোঁটাও আমি কাউকে দেবো না!

বাংলাদেশ সময় ১৫২৩, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।