ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

আবদুল মান্নান সৈয়দ- এর ‘গল্পসংগ্রহ’

জেসমিন আক্তার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১২
আবদুল মান্নান সৈয়দ- এর ‘গল্পসংগ্রহ’

বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে আবদুল মান্নান সৈয়দ-এর বই ‘গল্পসংগ্রহ’ ।   এই প্রথম তার সমস্ত গল্প নিয়ে এমন একটি সংকলন প্রকাশিত হলো।



প্রকাশক সূত্রে জানা যায়, এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি, ফাইনাল প্রুফ, সম্পাদনা মান্নান সৈয়দ বেঁচে থাকতেই সম্পন্ন করে গিয়েছিলেন। বইটি নিয়ে তাঁর আগ্রহ, কৌতূহল ছিল ব্যাপক। জীবদ্দশায় তিনি বইটি দেখে যেতে না পারলেও এখন তাঁর ভক্ত-পাঠকদের জন্যে এই বই বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে।

সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ-এর জন্ম ১৯৪৩ সালে। ষাটের দশকে তাঁর উন্মেষকালে ‘মাতৃহননের নান্দীপাঠ’ গল্প লিখে সাহিত্যমহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সত্যের মতো বদমাশ’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একমাত্র নিষিদ্ধ গল্পগ্রন্থ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে সে নিষেধাজ্ঞা অবমুক্ত হয়। প্রাচ্য সাহিত্যের নিদর্শন স্বরূপ শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে তাঁর গল্প পড়ানো হয় বহুকাল ধরে। সাহিত্যের অন্যান্য মাধ্যমের মতো গল্পেও তিনি বিগত কয়েক দশকব্যাপী তাঁর অগ্নিপ্রভ শিল্পনিপুণতা সজীব রাখতে সক্ষম হয়েছেন।

আবদুল মান্নান সৈয়দ ২০১০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।

প্রথমবারের মতো আবদুল মান্নান সৈয়দের গল্পসংগ্রহ প্রকাশিত হচ্ছে, যেখানে স্থান পেয়েছে আটাশটি গল্প। সংগ্রহটি গ্রন্থিত ও অগ্রন্থিত দুটি পর্বে বিভক্ত। গ্রন্থিত অংশে ‘জলপরি’, ‘কে তুমি’, ‘চোখ’ ইত্যাদিসহ তাঁর বিভিন্ন প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ থেকে ১১টি গল্প নেয়া হয়েছে। আর অগ্রন্থিতভাগের গল্প-- যেগুলো এই প্রথম মলাটবন্দী হচ্ছে। তাই পুরোনো বিখ্যাত গল্পগুলোর পাশাপাশি একগুচ্ছ অগ্রন্থিত গল্পে পাঠক নতুনত্বের আস্বাদ পাবেন। তবে গল্পের বয়ানে ও বুননে নিজস্ব অন্তর্বাস্তবিক কুশলতা চিরচেনা মান্নান সৈয়দকে মনে করিয়ে দেয়।

আবদুল মান্নান সৈয়দ-এর গল্প সম্পর্কে কিছু নির্বাচিত মন্তব্য :

১.    [‘চলো যাই পরোক্ষে’ সম্পর্কে] এটি নিছক গল্প উপন্যাসের বই নয়, একটি পরীক্ষামূলক রচনা, ভেবে-চিন্তে লেখা। যে-সব রচনা সাহিত্যকে বিস্তৃত করে, পাঠককে শিক্ষিত করে--এই গ্রন্থটি সেই জাতের এবং এই লেখকের সেরকম যোগ্যতা আছে নিঃসন্দেহে।
 --সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সাপ্তাহিক দেশ

২.    [‘চলো যাই পরোক্ষে’ সম্পর্কে] বাংলাদেশের গদ্যপদ্য সম্পর্কে আমাদের প্রাথমিক কৌতূহল এখন স্তিমিত।
     বিশেষত গদ্য সত্যিই আশানুরূপ লাগেনি। একদিকে শওকত ওসমান অন্যদিকে হাসান আজিজুল হক-দুই ই-শওকত ওসমান প্রথমতই এবং হাসান শেষাবধি non-entertaining লাগে। এই সেই ‘এন্টারটেইনমেন্ট’, যার কথা ব্রেখ্ট বলেছেন বারবার ও কার্যত দেখিয়েছেন। আপনার লেখা শেষ অবধি এই অর্থে entertaining এবং প্রথম থেকে। এছাড়া সকল ভালো গদ্যলেখকের মত অবশ্যম্ভাবী কবি আপনি।
-- সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, ব্যক্তিগত চিঠি

৩.    আবদুল মান্নান সৈয়দ এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রায় একসঙ্গে সাহিত্যে প্রবেশ করেছিলেন। তাঁরা এখনো সাহিত্যিক সহযাত্রী, যদিও তাঁদের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। শক্তিমান দুজনেই, কেননা তা নাহলে এতদিনে একজন আরেকজনের অনুগামী হতেন। তবু ইলিয়াস মরবিড ও স্পর্শকাতর; সৈয়দ গ্রোটেস্ক ও অবিশ্বাসী। সৈয়দের প্রধান অবলম্বন তাঁর স্বতন্ত্র ভাষা।
-- আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, সাম্প্রতিক ধারার গল্প : আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত

৪.    আবদুল মান্নান সৈয়দ-এর সবচেয়ে বড় চিত্ত--ভাষা উপার্জন করে নিয়ে সাহিত্যে এসেছিলেন। এমন গ্রাম্যতামুক্ত, স্বচ্ছন্দ, বেগবান, দ্যুতিময় ভাষা আয়ত্ত করা একজন লেখকের কম বড় কৃতিত্ব নয় (এবং বোধকরি সবচেয়ে জরুরিও বটে)। ফলে যা কিছুই তিনি লিখুন না কেন পাঠককে তা পড়তেই হবে। আর তাঁর পক্ষে শ্লাঘনীয় বটে যে, তিনিই বোধকরি এদেশে একমাত্র লেখক অতি অল্প সময়ের মধ্যে যিনি তাঁর পরবর্তী তরুণ লেখকদের প্রভাবিত করতে পেরেছেন।
--কায়েস আহমেদ, ছোটগল্প

৫.    মনের অন্ধকার, পিচ্ছিল ও বেখাপ্পা কন্দর থেকে কিছু সত্য যে টেনে বার করবার হিম্মত নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ এবং যখন গিয়েছিলেন তাঁর সেই অভিযাত্রায় তখন তাঁর কোনো সহযাত্রী ছিল না এদেশে। ‘সত্যের মতো বদমাশ’-এর গল্পসমূহের যতো ছিদ্রন্বেষণই আজ করা যাক না কেন, এটি নিঃসন্দেহে আমাদের ছোটগল্প সাহিত্যে এক মাইলস্টোন।
--সৈয়দ আবদুল মকসুদ,  একজন গল্পকার : আবদুল মান্নান সৈয়দ : আনওয়ার আহমদ সম্পাদিত, নভেম্বর ১৯৭৮

৬.    প্রিয় মান্নান সৈয়দ,
    একমাত্র আপনিই আমাদের সময়কার সেই গল্পকার- যাঁর গল্পে নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা লক্ষ্য করা যায়। কি ভাষায় কি বক্তব্যে, কি প্রেজেনটেশনে ‘মাতৃহননের নান্দীপাঠ’ থেকে ‘এক অমানুষের গল্পে’র দূরত্ব একজন লেখকের পক্ষে অবশ্যই বহুকালের সাধনার ফল। আপনি খুব দ্রুত তা পেরেছেন। সাবাস।
    -- ইমদাদুল হক মিলন, ঐ

৭.    দোষই হোক বা গুণই হোক, মান্নান কখনো আহ্লাদী কণ্ঠে গল্প বলেন না। তাঁর গল্পের শরীর পেশীবহুল। গল্পের রাষ্ট্রে কবিতা হয়তো কখনো কখনো প্রবেশ করে কিন্তু শব্দের দ্যোতনায় সাঙ্গীতিক আবহ সৃষ্টিতে তিনি অনাগ্রহী। ফলত গল্পের স্রোত পাঠককে কখনোই আত্মবিস্মৃত করে ভাসিয়ে দেয় না, স্বীয় নির্ভরে পাঠককে হেঁটে হেঁটে এগোতে হয়। কখনো বা হোঁচট খেতে হয় এবং প্রতি মুহূর্তেই অনুভব করতে হয় আমি আবদুল মান্নান সৈয়দের গল্প পড়ছি।
-- খান মোহাম্মদ ফারাবী, চলো যাই পরোক্ষে আলোচনা, উত্তরাধিকার

৮.    এই সময়ের [ষাটের দশকের] গল্পশিল্পীদের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ‘সমাজ বাস্তবতার’ নির্মাণ। তবে আবদুল মান্নান সৈয়দ এর ধারেকাছেও যাননি। তাঁর গল্প ধ্রুপদী মাত্রা পেয়েছে মানুষের অন্তর্লোক চিত্রায়নের কুশলী সফলতায়। মানবমনের বহুবিচিত্র ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সূক্ষ্ম চিত্রণে তাঁর তুলনা মেলা ভার মানুষকে তিনি প্রধানত তুলে এনেছেন তার অন্তর্লোকের পরিপ্রেক্ষিতে, তার সমস্ত আকুলতা-আকুতি, আবেগ-আবেশ, বিস্ময়-বিপন্নতা, ভয়-ভাবনা আর এসবের অদ্ভূত-অসাধারণ ব্যাখ্যাসহ।
-- আহমাদ মোস্তফা কামাল, শ্রেষ্ঠ গল্প : আবদুল মান্নান সৈয়দ


৯.সমাজবাস্তবতার আচ্ছাদনে দুর্বল কথাসাহিত্য যেখানে দশক-দশক রাজত্ব করে বেড়ায় সেখানে ব্যক্তিকে গল্পসাহিত্যে চরম মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা নিঃসন্দেহে সাহসের ব্যাপার। আশার কথা এই যে আরো অনেক কিছুর ন্যায় গল্পের ক্ষেত্রেও আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রথাজাড্যে গা ভাসাননি। অনেক পরে হলেও হাসান আজিজুল হক স্বীকার করেছেন যে ষাটের দশকে তাঁরা মান্নান সৈয়দকে ভাবতেন ‘আধুনিকতম গল্পকার’।
-- পিয়াস মজিদ, খেয়া, ভাদ্র ১৪১৫
[‘গল্পসংগ্রহ’ পৃ. ২৭০-২৭২]]

‘গল্পসংগ্রহ’-এর ভূমিকা ও পরিশেষ লিখেছেন সাব্বির আজম। সাব্বির আজমের কথায়  ‘... মলাটবন্দী হতে যাচ্ছে এই প্রথম। সে হিসেবে পুরনো পরিচিত গল্পের পাশাপাশি এক ঝাঁক নতুন গল্পের সম্মিলন পাঠকের মনে আনন্দ সঞ্চার করবে সন্দেহাতীতভাবে। ’

বইটি উৎসর্গ করেছেন আবদুল মান্নান সৈয়দ-এর গল্প লেখার প্রথম তিন সঙ্গী হুমায়ুন চৌধুরী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-এর উদ্দেশে।

আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘গল্পসংগ্রহ’ প্রকাশ করেছে ‘সূচীপত্র’,  প্রচ্ছদ করেছেন সাঈদ বারী, মূল্য : ৪৯৫.০০ টাকা।

বাংলাদেশ সময় ১৫৩৩, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।