ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

একুশের বইমেলা নিয়ে চিন্তাভাবনা

আবদুশ শাকুর, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১২
একুশের বইমেলা নিয়ে চিন্তাভাবনা

গ্রন্থমেলা বলতেই প্রথম উচ্চারিত নামটি হল ফ্রাংকফুর্ট বুক ফেয়ার। বিশ্বের বৃহত্তম গ্রন্থমেলা বলতেও উচ্চারিত হয় একই নাম।

শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থমেলা বলতেও উত্তর হয় অভিন্ন। কৌতূহলবশত আন্তর্জালে প্রশ্ন রাখলাম : বিশ্বের দীর্ঘতম গ্রন্থমেলা কোনটি? উত্তর এলো : ব্যাংকক বুক ফেয়ার। কারণ সম্ভবত গাণিতিক। ফ্রাংকফুর্ট গ্রন্থমেলার মেয়াদ মধ্য অক্টোবর মাসের সাড়ে ৫ দিন, অন্যান্য গ্রন্থমেলার মেয়াদও বেশির ভাগ ১ সপ্তাহ; যথা দিল্লি বুক ফেয়ার, চেন্নাই বুক ফেয়ার যেখানে ব্যাংকক গ্রন্থমেলার মেয়াদ শেষ মার্চ আর প্রথম এপ্রিলের ১২ দিন। কিন্তু কলকাতা বইমেলার মেয়াদও তো শেষ জানুয়ারি আর প্রথম ফেব্রুয়ারির ১২ দিন।

এ ব্যাপারে দুনিয়ার কোনো গ্রন্থমেলাই অবশ্য ঢাকার ২৮-২৯ দিন মেয়াদি একুশে গ্রন্থমেলার ধারেকাছেই নেই। একমাত্র আন্তর্জাতিক সম্পৃক্তির অভাবেই আমাদের একক একুশে গ্রন্থমেলাটি আন্তর্জাতিক হিসাবনিকাশ, জরিপ এবং প্রচারণাতে থাকে না। গণনায় থাকে বলেই কলকাতা বইমেলা ২০০৬ সালে ফ্রাংকফুর্ট বুক ফেয়ারের গেস্ট অব অনার হিসেবে আমন্ত্রিত হওয়ার মতো বইয়ের ভুবনের একক সম্মানে ভূষিত হয়েছে।

এই উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আন্তর্জাতিক সম্মান ফ্রাংকফুর্ট বুক ফেয়ার আর কলকাতা বইমেলা প্রতি বছরই দিয়ে থাকে। ফ্রাংকফুর্টের ২০১০ সালের বুক ফেয়ারে আর্জেন্টিনা ছিল গেস্ট অব অনার আর ২০১১ সালে থাকবে  আইসল্যান্ড। কলকাতা বইমেলার ২০১০ সালের থিম কান্ট্রি ছিল মেক্সিকো এবং ২০১১ সালের থিম-কান্ট্রি হবে যুক্তরাষ্ট্র। বালাদেশ থিম-কান্ট্রি ছিল ১৯৯৯ সালে। ১৯৭৬ সালে শুরু হওয়া কলকাতা বইমেলাকে বছর বছর ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যের কিংবা রাষ্ট্র্রের থিমে সমৃদ্ধ করার প্রথাটি চলে আসছে ফ্রাংকফুর্ট বুকফেয়ারের অনুসরণে ১৯৯১ সাল থেকে।  

ফ্রাংকফুর্টে কেবল দেশ নয়, ইভেন্টকে এবং সংস্কৃতিকেও গেস্ট-অব-অনার করা হয় যেমন ২০০৬ সালে ইভেন্ট হিসেবে এই বিরল সম্মানটি দেয়া হয়েছে কলকাতা বইমেলাকে এবং ২০০৭ সালে সংস্কৃতি হিসেবে দেয়া হয়েছে কাতালান কালচারকে। কাতালোনিয়ার অধিবাসীদের ভাষা Ôরোমান্সÕ  প্রোভাঁসের ভাষার নিকটাত্মীয়। অন্যকথায় কাতালোনিয়ানরা দক্ষিণ ফ্রান্স এবং পশ্চিম সার্দিনিয়ার ভাষাভাষী। কাতালান প্রকাশনা শিল্প ও সংস্কৃতিকে নির্ভেজালভাবে চিহ্নিত ও উপস্থাপন করার প্রয়োজনে সে-বছরের বুকফেয়ারটিকে সম্পূর্ণরূপে নন-স্প্যানিশ রাখা হয়েছে। অথচ অনেক কাতালোনীয় লিখে থাকেন স্পেনীয় ভাষায়। এছাড়া সে-বছরেই স্পেন সরকার মেলাটির ব্যয় মেটাতে প্রায় ৭ মিলিয়ন ইউরো চাঁদা দান করেছে। বিষয়টির অবতারণা করলাম, সংস্কৃতি-সেবার আদর্শে একটি বাণিজ্যমেলার নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতার উদাহরণস্বরূপ।

প্রসঙ্গত ফ্রাংকফুর্ট বুক ফেয়ারের ভ্রান্তপরিচয়মূলক নামের বিষয়টিও চর্চিত হওয়া আবশ্যক। ফ্রাংকফুর্ট বুক ফেয়ার নামটি একটি মিসনমার বা অপনাম। সঠিক নামটি হত ফ্রাংকফুর্ট বুক ট্রেডফেয়ার। কারণ ওটা বস্তুত বুক ফেয়ারই নয়, ট্রেড ফেয়ার। ব্যাংকক ও দিল্লি বুকফেয়ারও অনেকাংশে তাই। নির্ভেজাল গ্রন্থমেলা হল ঢাকার অমর একুশে এবং কলকাতার পুস্তকমেলা। ব্যাপারটাকে খুলে তুলে ধরতে হলে কেবল ফ্রাংকফুর্ট বুক ফেয়ারটির সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণই যথেষ্ট।

প্রকাশনাশিল্পের কার্যকর পন্থাগুলির শীর্ষস্থানীয় একটি হল বাৎসরিক বুকফেয়ার বা গ্রন্থমেলার আয়োজন। যে-কোনো প্রকাশনাবর্ষের এ আয়োজনের বিশ্ব-কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয় ফ্রাংকফুর্ট বুক ফেয়ার। এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে সমবেত হয় সমগ্র বিশ্বের প্রকাশক সম্প্রদায়। তাঁরা এখানে জড়ো হন সংশ্লিষ্ট বছরে তাঁদের বড় অর্জন, আহরণ ও সম্পাদিত চুক্তিসমূহের সবচেয়ে কার্যকর আন্তর্জাতিক প্রচারণার সুযোগ গ্রহণ করতে।

কারণ এখানে ফোকাস থাকে  রাইট-সেইল বা স্বত্ব বিক্রয়ের ওপর, বিশেষত বিভিন্ন বিষয়ে লিখিত বিভিন্ন ভাষার বইপুস্তক অনুবাদ-স্বত্বের। সাড়ে-পাঁচ দিনের মেলার সীমিত সময়টুকুতে আধা ঘণ্টার পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাৎ-সূচি অনুযায়ী প্রকাশকদের নিয়ন্ত্রণাধীন অনুজ প্রকাশক সন্ধানে হাঁসফাঁস থাকে তাঁদের স্টাফ। বছরের বাকি সময়ের জন্য প্রকাশকদের এই স্বত্ববিক্রয়-চুক্তি অত্যাবশ্যক। স্বত্ব ক্রেতা-বিক্রেতাদের এমনি মুখোমুখি কথাবার্তা বলে বোঝাপড়া করা এই ই-মেইলের যুগেও কেমন বিকল্পবিহীন তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ২০১০ সালের লন্ডনের গ্রন্থমেলাতেÑ যেখানে ছাইমেঘে আকাশ ছেয়ে যাওয়ার কারণে আসতে পারেননি বিশ্বের বহু আন্তর্জাতিক পুস্তক প্রকাশক।

লন্ডন-ফ্রাংকফুর্ট বুকফেয়ারগুলি বিক্রি এবং বিতরণের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এসব বুকফেয়ারেই হয় এক পাবলিশার কর্তৃক আরেক পাবলিশারের বই বিক্রির বহু চুক্তির আপস-আলোচনা এবং ঘোষণা। সারা পৃথিবীর বড় পাবলিশারদের প্রধান সম্পাদকগণ এখানে আসেন গ্রন্থস্বত্ব বিক্রির অকশানে অংশ নিতে। তাঁদের সাক্ষাৎসূচিও থাকে ঘণ্টায় আঁটা।

বর্ণিত বিবরণটুকুই পূর্ণরূপে ব্যাখ্যা করে কেন ক্রিস হোলিফিল্ড লেখক এবং পাঠকদের ফ্রাংকফুর্ট বুক ফেয়ারে যেতে  বারণ করেছেন। গ্রন্থকারদের উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে লিখেছেনÑ আপনি নিশ্চিতই এ গ্রন্থমেলায় অভ্যর্থিত নন, বরং অবাঞ্ছিতই। বিশ্বের এক নম্বর এই বুকফেয়ারে আপনি যেতে পারেন, যদি আপনার প্রকাশক আপনাকে আমন্ত্রণ করে থাকেন। তবে সেখানে তিনি আপনার সঙ্গে একশব্দ কথা বলার সময়ও পাবেন না। বরং বিশাল ওই গ্রন্থমেলার ১,৯০,০০০ বর্গমিটার জুড়ে পুস্তকপর্বত পরিক্রমা করতে করতে ভেবে নিরাশ হবেনÑ এত বই লিখে ফেলেছেন অন্যরা!

তাহলে ফ্রাংকফুর্ট বইমেলাতে লেখকের যোগদান-যে না থাকার মতো তা তো বোঝাই গেল। পাঠক যান কী সেখানে? যান। তবে বই কিনতে নয়, বই বাছতেÑ যাতে পরে সুবিধে মতো বাজারে বা বিপণিতে কিনতে পারেন। ক্রিস লেখেন, এর কারণ হলÑ পরীক্ষিত প্রজ্ঞা বলে কেবল ফ্রাংকফুর্টেই নয়, লন্ডনসহ সমধর্মী অন্যান্য বইমেলাতে যে-কোনো পুস্তকের ক্রয়মূল্যই অনেক বেশি। এ শুধু ক্রিসের মতো পর্যবেক্ষকের মতই নয় বরং পুরো পুনঃসমীক্ষক-মহলেরই অভিজ্ঞ অভিমত। প্রতিতুলনায় ঢাকার অমর একুশে গ্রন্থমেলার কথা ভাবুন, যেখানে বেস্টসেলার বইয়ের বেলায়ও গ্রাহকদের ৩০% পর্যন্ত ছাড় দেয়া হয়Ñ অর্থাৎ এদেশের সাধারণ বই-বাজারের প্রচলিত বাটার চেয়েও ১০% বেশি। সেও প্রায়ই প্রিয় লেখকদের অটোগ্রাফ সমৃদ্ধ।
বর্ণিত দিক থেকে দেখলে ঢাকা-কলকাতা-চেন্নাইয়ের মতো পাবলিশার-রিডার-রাইটারদের বুকফেয়ারের আলোচনায় ফ্রাংকফুর্ট-ব্যাংকক-দিল্লির মতো কেবল পাবলিশারদের বুকফেয়ারের উল্লেখ উচিত হয় না। ১৯৭২ সালে আরম্ভ হয়েছে বলে দিল্লি বুকফেয়ারটিকে উপমহাদেশের প্রাচীনতম গ্রন্থমেলা বলাও ঠিক হয় না। কারণ ঢাকার বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণের অমর একুশে গ্রন্থমেলাটি শুরু হয় ১৯৭২ সালের অমর একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবসেÑ বাংলাভাষার জন্য শাহাদাত বরণ করা শহীদদের স্মরণে।

মুক্তধারাÕর প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহার সে-উদ্যোগে ক্রমে ক্রমে অন্য প্রকাশকগণ যোগ দেন পরের বছরগুলিতে। গ্রন্থমেলাটির আয়োজনের দায়িত্ব বাংলা একাডেমী গ্রহণ করেন ১৯৭৮ সালে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা নামকরণ হয় ১৯৮৪ সালে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বরে একুশে ফেব্রুয়ারিকে মাতৃভাষার জন্য জীবনদাতাদের স্মরণে ইউনেস্কো Ôআন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসÕ ঘোষণা করে। ২০০০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি দিবসটি বিশ্বব্যাপী প্রথম পালিত হয় এবং তার পর থেকে প্রতি বছর একটি থিমের ওপর সমাহৃত হতে থাকে।

এদিকে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণের একুশে গ্রন্থমেলাটি বছর বছর বিপুলভাবে বাড়তে বাড়তে বিশাল এক গণউৎসবের রূপ নেয়। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ সরকার ডিসেম্বর মাসে আয়োজিতব্য ‘ঢাকা গ্রন্থমেলা’-নামে আরেকটি বাৎসরিক মেলা চালু করে ফেব্রুয়ারি গ্রন্থমেলার প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে। কিন্তু মেলাটি অদ্যাবধি জমে ওঠেনি। ১৯৮০-র দশকের শুরু থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও গ্রন্থমেল-নামক একটি বাৎসরিক বইমেলা চালু করে পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স আয়োজিত কলকাতা বইমেলার প্রতিযোগী হিসেবে। কিন্তু মেলাটি জমেনি। তাই পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৯৯২ সালে গ্রন্থমেলাকে বইমেলার সঙ্গে মার্জ করে দেয়। বাংলাদেশ সরকারেরও ঢাকা গ্রন্থমেলাকে একুশে গ্রন্থমেলার সঙ্গে মার্জ করে দেয়া উচিত বলে মনে করি আমি, যাতে ফ্রাংকফুর্ট-লন্ডন বুকফেয়ারের মতো ঢাকা বুকফেয়ার বলতেও একটাকেই বোঝায়Ñ একুশে গ্রন্থমেলা বা অমর একুশে গ্রন্থমেলা।

ইউনেস্কোর উদ্যোগটি থেকে প্রত্যাশিত ছিল যে আমাদের একুশে গ্রন্থমেলার আন্তর্জাতিকতা ধাপে ধাপে মাত্রায় মাত্রায় বাড়তে থাকবে। কিন্তু কিছুই বাড়েনি। ফলে এই মেলা আন্তর্জাতিক হিসাবনিকাশেও আসেনি। মাত্রাগুলি কী কী ধরনের হতে পারে তা নিকটতম আন্তর্জাতিক বইমেলা কলকাতার ওয়েবসাইটে তাকালেই দেখা যাবে। তাই সেসব এখানে লিখে কথা আর বাড়াবো না আমি। তবে ই-ফোরামে কলকাতাও পিছিয়ে আছে। এ ব্যাপারে স্বদেশের দিল্লি যে-দুর্লঙ্ঘ্য চ্যালেঞ্জ রেখেছে, তাতে প্রতিযোগী কলকাতার বিশাল ইনিংস-পরাজয় অবধারিত।

প্রগতি ময়দানে দিল্লি বুক ফেয়ার ২০১২ শুরু হয়েছে ২০১০ সালের ২৫ ডিসেম্বর শনিবারে এবং শেষ হয়েছে ২০১১ সালের ২ জানুয়ারি রবিবারে। আগের দিন ১ জানুয়ারি শনিবারে বইমেলাটিতে ১০০০ ই-বুক এসেছে বলে ২ জানুয়ারির দি হিন্দু দৈনিক পত্রিকাটি এর অনলাইন এডিশনে জানিয়েছে। বিভিন্ন জঁর বা সংরূপের এইসব  বইয়ের মধ্যে রয়েছে পৌরাণিক মহাকাব্য রামায়ণ-মহাভারত এবং মুন্সী প্রেমচাঁদের গল্প উপন্যাস প্রভৃতি। অতীব গুরুত্বপূর্ণ এ উদ্যোগটি উপস্থাপনকালে ইসি মিডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক রভি ডি. সি. বলেছেনÑ উদ্যোগটির নিহিত উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়সূচির বিরল, মুদ্রণবহির্ভূত, পেপারব্যাক বা নরমমলাট পুস্তকরূপে বিপণিত অভীষ্ট পুস্তকগুলিকে ডিজিট্যাল প্ল্যাটফর্মে পরিবেশন করে পাঠকের নিজের টেবিলে তুলে দেয়া। এই উদ্বোধনী ভাষণটিতে ঢাকা ও কলকাতা বইমেলা আয়োজকদের জন্য নিহিত বার্তাটি লক্ষণীয়।

একুশে গ্রন্থমেলায় বাংলাদেশের প্রকাশকদের উল্লেখযোগ্য ই-বই আনতে এখনো অনেক দেরি থাকতে পারে। কিন্তু এদেশের বিশ্বমানের তরুণ প্রোগ্রামারগণ পর্যাপ্ত ই-তথ্য তো আগামী গ্রন্থমেলাটির ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেই আনার চেষ্টা করতে পারেন। কথাটি বললাম দুটি কারণে। প্রথম কারণÑ এ লেখাটির তথ্য আহরণের জন্যে সকল গ্রন্থমেলার ওয়েবসাইটে বেড়ানোর শেষে বাংলা একাডেমীর সাইটে ঢু মারতেই দেখলাম লেখা আছেÑ সাইটটি বর্তমানে নির্মাণাধীন। (ইন্টারনেটে ওয়েবসাইট চালু হবার এত বছর পরেও নির্মাণাধীন?)। দ্বিতীয় কারণÑ কলকাতা বইমেলার ই-প্রচারণার কিছু অবাস্তব দাবি সম্পর্কে সন্দেহ।
“It is a unique book fair in the sense of not being a trade fair - the book fair is primarily for the general public rather than whole-sale distributors. It is the world`s largest non-trade book fair, Asia`s largest book fair and the most attended book fair in the world. It is the world`s third largest annual conglomeration of books after the Frankfurt Book Fair and the London Book Fair.”   

বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে ১২ দিনের কলকাতা বইমেলা তার চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ দীর্ঘতর ২৮-২৯ দিনের ঢাকা গ্রন্থমেলা থেকে বেশি দর্শনার্থী পায়। আশা করি আমার সন্দেহ অচিরেই ভঞ্জন করবেন আমাদের তথ্যপ্রযুক্তিবিদগণ।

পরিশেষে পাবলিশিং হাউসের প্রফেশনাল এডিটর সম্পর্কে নির্দিষ্ট কিছু কথা বলতে চাই। কেউ বলতে পারেনÑ একটি উন্নয়নশীল দেশে এমন অগ্রসর একটি প্রসঙ্গের অবতারণা কেন। উন্নত দেশেও তো বর্তমানে বইয়ের মার্কেটিং স্টাফের দাপটে এডিটিং স্টাফ প্রায় পলাতক। স্বয়ং এডিটরই তো পাবলিকেশনের মূলধারা থেকে ছিটকে পড়ে, হয়ে আছেন পাণ্ডুলিপি-উপদেষ্টা। আমি বলবো, তাহলে প্রকাশকগণ তাই করে রাখুন সম্পাদককে। তবু আমাদের প্রকাশনা জগতের জঙ্গলটি কিছুটা বাগান হয়ে উঠবে। কারণ মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগের অস্তিস্তই তো নেই এখানে, নেই প্রয়োজনের ধারণাও। আছে কেবল উৎপাদন আর বিপণন বিভাগ।

অথচ পাবলিকেশন-ইন্ডাস্ট্রির বিশ্বে স্পেশালিস্ট হিসেবে এডিটর হচ্ছেন একক, যাঁর তুলনায় অন্যরা সবাই বলতে গেলে জেনারেলিস্ট। যেমন একজন প্রোডাকশন স্টাফকে বুক প্রিন্টিঙের বদলে যে-কোনো স্টেশনারি প্রিন্টিঙের কাজেও ব্যবহার করা যায় তাঁর সমান দক্ষতায়। একজন বিক্রয়-বিভাগের স্টাফ তাঁর দক্ষতার সবটুকু কাজে লাগিয়ে মুড়ি-বিস্কুট বেচে যেতে পারেন। পক্ষান্তরে প্রকাশনা-সম্পাদকের দক্ষতা অন্য কোনো ব্যবসার কাজে লাগে না। এজন্যেই রিচার্ড কার্টিস বলেনÑ এডিটরই হচ্ছেন একটি পাবলিশিং কোম্পানির প্রাণস্বরূপ।

কী করেন তিনি? এডিটর সাহেব? এককথায় তিনি বাছাই, যাচাই, ছাঁটাই এবং সাজাই করে বইটিকে উচ্চমানসম্পন্ন প্রকাশনার যোগ্য বলে রায় দেন। একটা উদাহরণই যথেষ্ট। সবাইকে বিস্মিত করে অস্টিন ক্লার্ক তাঁর দি পলিশ্ড হো-নামক নভেলটির জন্য কানাডার বিখ্যাত গিলার প্রাইজ লাভ করেন। পুরস্কারটি গ্রহণকালে তিনি তাঁর পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন, পুরস্কারদাতার প্রতি নয়, তাঁর এডিটরের প্রতিÑ যিনি লেখকের পাণ্ডুলিপিটির চার ভাগের তিনভাগই ছেঁটে ফেলে দিয়েছিলেন।

ব্যাপার হল, সম্পাদক লেখকের প্রতিভার অভাব পূরণ করতে পারেন না বটে, যেমন খেলার কোচ খেলোয়াড়ের অ্যাবিলিটি বাড়াতে পারেন না। তবে সম্পাদক লেখকের নৈর্ব্যক্তিকতার অভাব অবশ্যই ঘুচাতে পারেন, যে-কাজটি নভেলিস্ট অস্টিন ক্লার্কের এডিটর করতে পেরেছিলেন। তিনি ব্যক্তিনিরপেক্ষতা এবং বস্তুনিষ্ঠতার বাটালি দিয়ে কুরে কুরে কুঁদিয়ে লেখককে ছিমছাম, আকর্ষণীয়, উপভোগ্য, এমনকি উপাদেয় হতে সাহায্য করেছেন সার্থকতার সঙ্গে।

মার্ক টোয়েন বলেছেন, এডিটর রাইটারকে সঠিক শব্দটি দিয়ে সাহায্য করতে পারেন। আর আমি যোগ করতে চাই যে  ``ঠিক`` শব্দ এবং ``প্রায়-ঠিক`` শব্দের মধ্যেকার ব্যবধান অনেক সময় অপারই হতে পারে। লেখককে সঠিক শব্দটি জুগিয়ে দিয়ে পার করার মতো, প্রকাশককেও সঠিক পাণ্ডুলিপিটি বেছে দিয়ে প্রকাশনার সার্থকতা নিশ্চিত করতে পারেন সম্পাদক। আসলে লেখক একজন স্বাপ্নিক। তাঁর স্বপ্নটির একজন ব্যাখ্যাতা প্রয়োজন। সফল সেই ব্যাখ্যাকারই হলেন প্রকাশনা-জগতের এডিটর অথবা সম্পাদক।

উচ্চমান প্রকাশনা সংস্থার জন্য তিন শ্রেণির এডিটরের প্রয়োজন পড়েÑ লাইন-সম্পাদক, কপি-সম্পাদক এবং উন্নয়ন সংক্রান্ত অথবা ধারণা সংক্রান্ত সম্পাদক। আমাদের প্রকাশনা জগতে আছেন কেবল কপি-এডিটর, যাঁকে আমরা প্রুফ-রিডার বলি। তিনি প্রধানত পান্ডুলিপির বানান-ব্যাকরণ সামলান। আরেকটা বিষয়েও তিনি চোখ রাখেন বইকি। নায়ক বা পার্শ্বনায়কের নামগুলি বিভিন্ন চ্যাপ্টারে বিভিন্ন রকম হয়ে গেল কি না। তেমনি প্রথম অধ্যায়ে বর্ণিত নায়িকা কি পার্শ্বনায়িকার নীল চোখ দশম অধ্যায়ে কটা চোখ হয়ে গেল কি না।

মেলার অনেক বইপুস্তক পড়তে গিয়ে আমি যাঁর অভাব সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছি, সেই লাইন-এডিটরের অস্তিত্বই নেই আমাদের দ্রুতবর্ধিষ্ণু প্রকাশনা জগতে। ইনি পাণ্ডুলিপিটি লাইন-বাই-লাইন পড়েন এবং প্রকাশক অথবা লেখককে বলেন লাইনগুলিকে কীভাবে স্বচ্ছ ও সাবলীল করা যায়। কোথাও শব্দ বাড়াতে বা কমাতে কিংবা বাক্যের মধ্যেকার শব্দগুলির ক্রমও অদলবদল করতে বলেন তিনি। এঁর কাজ গভীর ধৈর্য এবং প্রচুর সময়সাপেক্ষ। মার্ক টোয়েন এঁর কথাই বলেছেন। এঁর মনোযোগ ম্যাটারের চেয়ে বেশি ফর্মে অর্থাৎ কন্টেন্টের চেয়ে বেশি স্টাইলে।  

ডেভেলপমেন্টাল অথবা কনসেপচুয়াল এডিটরের কাজ প্রকাশনার উন্নয়ন এবং ধারণা সংক্রান্ত। ইনি পাণ্ডুলিপিটি সম্পর্কে যেসব প্রশ্ন তুলবেন, সেসবের কয়েকটি এরকম। পাণ্ডুলিপিটি স্বক্ষেত্রে খাঁটি অবদান রাখবে কী? ম্যানাসক্রিপ্টের টপিকে লেখকের মাস্টারি কেমন? পান্ডুলিপিটির সম্পদ কী? বিপদই বা কী? কোনটি বেশি? এ-পান্ডুলিপি কি ব্যাপক পাঠক পাবে? না কি কেবল সীমিত-তবে-সুধী পাঠক পাবে। স্বীয় ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানটি কেমন হবে পাণ্ডুলিপিটির? কেমন বাজার পাবে এটি? কেমন ধরনের বাজার সেটি?

প্রসঙ্গটির অবতারণা জরুরি মনে হয়েছে আমার কাছে। কারণ সারাটা মাস জুড়ে তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র একটি অঙ্গনে লক্ষ লক্ষ পাঠক-গ্রাহকের প্রতিদিনের আনাগোনার স্থানে বাৎসরিক এমন লাভজনক সুযোগটি লুফে নেওয়ার মানসে পান্ডুলিপির পেশাদার সম্পাদনা এবং মানসম্পন্ন প্রকাশনার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলি শিকেয় তুলে রেখে ফুচকা-চটপটি আর ঝালমুড়ির মতো তাৎক্ষণিক স্বাদের সদ্যভাজা গরম-গরম নতুন বই মিছিল করে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিনটি পর্যন্ত মেলায় আসতে থাকে।

অবশ্য বাংলা একাডেমীর হাতে এমনিতেও অনেক হাতিয়ারই মজুদ আছে। সেসব শুধু প্রয়োগ করলেই মানসম্পন্ন প্রকাশকদের পাণ্ডুলিপিগুলি পেশাদার সম্পাদকীয় তৎপরতার মাধ্যমে চালুনিবাছুনির প্রক্রিয়ায় মান প্রকাশনা অনেকটাই নিশ্চিত হতে পারে। প্রকাশক কর্তৃক দাখিলকৃত প্রচলিত তথ্যফর্ম মারফতই একাডেমী যথাসময়ে জেনে নিতে পারেÑ কারা সারা বছরের প্রকাশক, কারা কেবল ফেব্রুয়ারি মাসের; কারা উৎকৃষ্ট প্রকাশক, কারা নিকৃষ্ট; কাদের ট্রেড-লাইসেন্স আছে, কাদের নেই; কারা কত বিক্রয়কর দিয়েছে, কারা আদৌ দেয়নি; বড় প্রকাশক হিসেবে কাদের কত বেশি স্টল লাগবে, ছোট প্রকাশক হিসেবে কাদের কত কম স্টলে চলবে; কাদের প্রকাশনার মান যথাযথ সম্পাদনার মাধ্যমে যথার্থরূপে নিয়ন্ত্রিত, কাদের সম্পাদনার কোনোরকম ব্যবস্থাই নেই।

এক কথায় একটি জাতির শ্রেষ্ঠতম আবেগতাড়িত উচ্চতম পর্যায়ের বাৎসরিক গ্রন্থমেলাটিকে অলংকৃত করার অধিকার কাদের আছে, কাদের নেই ইত্যাদি জেনে নিয়ে মেলায় বাঞ্ছিত মানের বইয়ের আগমন বাংলা একাডেমী অবশ্যই নিশ্চিত করতে পারেন।
 
লেখক-কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।