ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

৬০ বছরেও রাষ্ট্রের ভাষা বাংলা হয়নি

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১২
৬০ বছরেও রাষ্ট্রের ভাষা বাংলা হয়নি

মাতৃভাষার মধ্যে শিক্ষাদান সহজ এবং স্বাভাবিক। কিন্তু অনেকে ভিন্ন ভাষায় কথা বলাকে গৌরবের বিষয় মনে করে।

ইংরেজ ও পাকিস্তান আমলে আমাদের ভাষার ওপর যে আক্রমণ ছিল, তা কিন্তু থামেনি। হিন্দি কিন্তু ঘরে ঘরে ঢুকে গেছে। ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে বা বিকৃত বাংলায় কথা বলাটা ফ্যাশন হয়ে গেছে। বিত্তবানরা ইংরেজি শিখছে। আমাদের শিশুদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের তিনটি ভাষা শিখতে হচ্ছে। এই মনস্তাত্ত্বিক চাপের ফল কিন্তু ভালো হবে না। মাতৃভাষার সঠিক চর্চার মাধ্যমেই কিন্তু বোঝা যায় আমরা ঠিক পথে এগুচ্ছি কি না। এর থেকেই বোঝা যায় বৈষম্যটা বাড়ছে। দেশের টেলিভিশন নাটকের সংলাপে বা বিজ্ঞাপনের ভাষায় যে বিকৃতি তা উত্পাতের মতো। বিদেশিরা উত্পাত করত। আমরা বিদ্রোহ করেছি। এখন উত্পাত আরও বেশি হচ্ছে। আমরা মেনেও নিচ্ছি। বিরোধিতা নেই। ভাষার মাধ্যমে পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্যও প্রকাশ পায়। ইংরেজি পুঁজিবাদের ভাষা।

বায়ান্ন সালে সংঘটিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বয়স ষাট বছর হচ্ছে এবার। ষাট বছর পরও রাষ্ট্র ও সমাজের ভাষা হতে পারেনি বাংলা। এখন দেশ স্বাধীন। বাংলা রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান ক্ষেত্রের ভাষা আজও বাংলা হয়নি। এটা কারও ব্যক্তিগত সমস্যা নয়। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের সমষ্টিগত সমস্যা। অনেক অত্যাচার, জুলুম, নিপীড়ন সহ্য করে বাংলা ভাষা টিকে আছে। প্রকাশ্যে ইংরেজি, গোপনে হিন্দি ভাষার উৎপাত চলছে বাংলার ওপর।

গত ষাট বছরের মধ্যে আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনভিত্তিক অনেক অর্জন আছে। আবার অসন্তোষ ও ব্যর্থতারও অনেক বিষয় আছে। যেমন, শিক্ষাক্ষেত্রে দেশে এখন ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলের চেয়ে বেশি বৈষম্য বিরাজ করছে। ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলেও শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য ছিল। তবে এখনকার মতো এত বৈষম্য ছিল না। ভাষা আন্দোলনের মূল প্রত্যাশা ছিল বাংলা ভাষার মাধ্যমে স্তরে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা। ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার জন্য আন্দোলন হলো। অথচ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সর্বস্তরে সেই ভাষা নেই।

আমাদের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছে ভাষাভিত্তিক। আমরা চেয়েছিলাম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আদালতসহ সবখানে বাংলা ভাষার প্রচলন হোক-তা হয়নি। এ রাষ্ট্রের মাতৃভাষার চর্চাই প্রধান হিসেবে গৃহীত হবে; জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, গবেষণা হবে বাংলা ভাষাভিত্তিক, এটাই ছিল স্বাভাবিক। ব্রিটিশ, পাকিস্তানি আমলেও বাংলা ভাষার পক্ষে জনমত ছিল-অন্য ভাষার প্রভুত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে আজ সেই প্রতিবাদ নেই। সচেতনতা নেই। যা হওয়া অনিবার্ ছিল। এ পরিণতি অপ্রত্যাশিত।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিভাজনটা এখন তিন ধারার। মাতৃভাষার ভিত্তিতে অভিন্ন শিক্ষারীতি হওয়ার কথা ছিল। এসব ধারার শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের ঐক্যবদ্ধ করছে না। ঐক্যবদ্ধ করার বদলে আমাদের বিভক্ত করছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বিভক্তিটা মূলত সামাজিক ক্ষেত্রে বিভাজনের ফল। এতে সমাজে বাড়ছে শ্রেণী-দূরত্ব। বাড়ছে বৈষম্য।

সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করা এখনও আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার কিছু চ্যালেঞ্জও ছিল। সেজন্য বাংলায় বই লেখা এবং বিদেশি বই অনুবাদ করা দুটিরই দরকার ছিল। কাজগুলো গত ষাট বছরে হয়নি। ফলে বাংলা ভাষায় উচ্চস্তরে শিক্ষা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। উচ্চস্তরের অধিকাংশ বই-ই ইংরেজিতে লেখা। এটাও সত্য, সাহিত্য, প্রবন্ধ ও বিভিন্ন বিষয়ের বই বাংলায় প্রচুর লেখা হয়েছে। তবে মৌলিক ও উচ্চশিক্ষার জায়গাগুলোর জন্য বই লেখার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা আছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পরও বিশ্বের বাংলাভাষীদের কাছে বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ তুলে ধরতে পারছি না। বিশ্বকে বাংলা সাহিত্যের একটি সামগ্রিকতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারছি না। এ ব্যর্থতার দায়ভার আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর।

বাংলা ভাষার বিপদ ও শত্রুকে আমাদের চেনা দরকার। পাকিস্তান আমলেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিলাভ করেছে বাংলা। নানা সময়ে রাজনৈতিক কারণে বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণ এসেছে। একসময়ে সংস্কৃত ভাষার দাপট বাংলা ভাষার ওপর চড়াও হয়েছিল। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়, আরবি, ফার্সি ভাষাও বাংলা ভাষার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায়। ব্রিটিশদের শাসনামলে আমরা দেখলাম ইংরেজি ভাষার প্রসার ও কর্তৃত্বে তত্কালীন শিক্ষিত জনগোষ্ঠী দ্বিভাষীতে পরিণত হয়েছিল। কেননা, রাষ্ট্রের ভাষা ছিল ইংরেজি। তবুও সে সময় খুব জোরালোভাবে বাংলা ভাষার চর্চা চালানো হয়েছে। ইংরেজির আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল। আমাদের সাহিত্যিকরা তাতে জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন।

সম্প্রতি আরও একটি নতুন উত্পাত এসে জুটেছে। তা হলো হিন্দি চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে হিন্দি ভাষার উত্পাত। শিশুরাও হিন্দির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ব্রিটিশ বা পাকিস্তানি শাসনামলেও বাংলার যতটা বিকৃতি তারা করতে পারেনি, স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষার বিকৃতি ঘটছে তারচেয়ে অনেক বেশি।

আবার আমাদের দেশীয় টিভি নাটকগুলোতেও একধরনের গোঁজামিল দেয়া আঞ্চলিক ঢঙের অদ্ভুত ভাষার চর্চা করা হচ্ছে—চরিত্ররা সব সে ভাষায় কথা বলছে। মোবাইল ফোন কোম্পানির বিজ্ঞাপনে বাংলা ভাষা বিকৃত করা হচ্ছে। এটা ভাষার জন্য আরেকটা বিপদ। এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়াটা কঠিন।

ফেব্রুয়ারি কেবল ভাষার মাস, এটা ঠিক নয়। ভাষার মাস বলে আলাদা কোনো মাস নেই। বছরের সব মাসই ভাষার মাস। ফেব্রুয়ারি এলে ভাষাচর্চার কথা বলা আর বছরের অন্য মাসে তা ভুলে থাকা, এটা অন্যায়। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে দেশের সংবাদপত্র ও টেলিভিশন মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পরও সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন না হওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। অথচ সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের জন্যই সেদিন আন্দোলন হয়েছিল।

বাংলা ভাষার বড় শত্রু হচ্ছে পুঁজিবাদ। ভাষার সঙ্গে শত্রুতা আর মানুষের সঙ্গে শত্রুতা একই। পুঁজিবাদ আমাদের সেই শত্রু, যা ভাষার বিকাশ, চর্চা বাধাগ্রস্ত করছে, সমাজে বাড়াচ্ছে বৈষম্য। স্বাধীনতা অর্জনের পর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিবাদ মুক্তি পেয়েছে। বিশ্ব পুঁজিবাদে বাংলা ভাষার স্থান নেই। কেননা, বিশ্ব পুঁজিবাদের সঙ্গে যারা যুক্ত, তারা বাংলায় আগ্রহী নন। পুঁজিবাদের সঙ্গে সম্পর্ক ইংরেজির। যারা এ রাষ্ট্র শাসনের দায়িত্বে থেকেছেন বা আছেন, তারা সেজন্যই বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব দেননি বা দিচ্ছেন না।

ফলে ভাষা আন্দোলনের ষাট বছরেও শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা চালু হয়নি। পূরণ হয়নি ভাষা আন্দোলনের মূল ও মৌলিক প্রত্যাশা। শাসকরা বাংলা ভাষার ব্যাপারে উত্সাহিত না হওয়ার আরেক কারণ সমাজের মৌলিক কোনো পরিবর্তন তারা চান না। পরিবর্তন না হলেই তাদের সুবিধা। কারণ, পরিবর্তনটা এলে আর সবাই সমান হয়ে গেলে তাদের ওই সুযোগ-সুবিধা থাকবে না।

সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হলে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। একাত্তরে স্বাধীনতালাভের পরও সমাজে কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। সমাজটা আগে যেরকম শ্রেণীবিভক্ত ছিল, এখনও সেরকমই রয়ে গেছে। শ্রেণীবিভাজন সমাজে সংরক্ষিত হচ্ছে পুঁজিবাদের কারণে। সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিত্তবানরা। তারা আছেন মূলত পুঁজিবাদের সঙ্গে। তারা তাই ইংরেজিতে কথা বলেন। বাংলা বললেও তা হয় ইংরেজি মিশ্রিত। মধ্যবিত্তরাও তাই করেন।

একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের সামনে বেশ কিছু জিজ্ঞাসা তুলে ধরে-দেশপ্রেম আগের মতোই আছে কি না, আমরা কতটা অনুগত ভাষার প্রতি, মানুষের প্রতি।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad