ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

পাণ্ডুলিপি থেকে রুবাইয়াৎ আহমেদের মুক্তিযুদ্ধের আখ্যান

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১২
পাণ্ডুলিপি থেকে রুবাইয়াৎ আহমেদের মুক্তিযুদ্ধের আখ্যান

বইমেলায় এসেছে প্রথম দশকের কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক রুবাইয়াৎ আহমেদের দুটি বই। একটি মুক্তিযুদ্ধের আখ্যান ‘জীয়ন্তকাল’ এবং অপরটি অনুবাদগ্রন্থ ‘সীমানা ছাড়িয়ে’।

বই দুটিই প্রকাশ করেছে ভাষাচিত্র প্রকাশনী। বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো আখ্যান ‘জীয়ন্তকাল’-এর অংশ বিশেষ।


প্রস্তাবনা

এই সুবর্ণভূগোল ছিল না একদিন।
নোনা স্বাদে ডুবে ছিল সমগ্র চরাচর।
কালের প্রবাহে তাতে জাগে ভূমির আদল।
নিবিড় ধ্যানে ফোটে যখন সবুজের দিশা,
শ্যামল মানবেরা ভাবে পরমের কৃপা।
এই ভূমে না ছিল সহজ জীবন না ছিল কঠিন।
রাত্তিরে বীজ বোণে সকালে ফসল,
বিপুল জলার ভেতর মাছ অফুরান।
অপার সম্পদ তার দিনে দিনে বাড়ে,
চুপিসারে দস্যুরা এই ভূমে নামে।
লুণ্ঠিত হয় ভূমি কতশতবার,
তবুও শ্যামল মানব পিছু হটে না।
অন্যায় হলে তারা বার বার লড়ে,
তাই বলি বীরজাতি বিদ্রোহ জানে।


কথা

কতিপয় দৃশ্য অবগুণ্ঠিত, সেগুলো পূর্ণতার আনন্দে ভরা। আর মানবের বিণষ্টি কিংবা অতৃপ্ত আত্মার ক্রন্দনে সিক্ত দৃশ্যগুলো ছড়িয়ে আছে এখানে সেখানে, কম্প্রমান। তাতে প্রতিমুহূর্তে সামিল হচ্ছে বেদনা জাগানিয়া লাখো ঘটনার কাফেলা। সেগুলো ঠোক্কর খেয়ে আটকে যাচ্ছে অসীম ব্রহ্মাণ্ডের ধারণাতীত এই স্থানটিতে। চারপাশে হত্যা, ধ্বংস আর হানাহানির ঘটনাসব দৃশ্যায়িত হচ্ছে একযোগে। তাতে জেগে ওঠে ঝরে পড়ছে বিকট শব্দ, প্রবল কান্না আর বেঁচে থাকার অন্তিম বাসনারা, অবলীলায়।

এই পূর্ণ আর অপূর্ণ দৃশ্যযজ্ঞের মাঝখানে যিনি, তিনিই পরম। সর্বব্যাপ্ত, আকারহীন অথচ চেতনাসম্পন্ন কোনোকিছু। সময়ের সমান বয়সী পরম অনাদিকাল হতে বিষণ্ন, ভারাক্রান্ত। আত্মনির্মাণের এমনতরো পরিণতিতে যেন যা অসহায়। এক নিরবচ্ছিন্ন প্রেমবাসনা পূরণে তিনি গড়েছিলেন মানুষের অবয়ব, দিয়েছিলেন অফুরান স্বাধীনতা। কিন্তু কী হলো এর পরিণতি! আজ মানুষ দাঁড়িয়েছে মানুষেরই বিরুদ্ধে। আপন সৃষ্টির এরূপ বিনাশযজ্ঞ কাঙিক্ষত ছিলো না তাঁর কোনোকালে। নিয়ন্ত্রণটুকু ছেড়ে দিলে তবে এমন রূপই ধরে।

 বোলাম

পরম ভাবেন--
:     যার নিয়ন্ত্রণ আত্মঅধিকারে রাখোনি, তার আচরণ তুমি নির্ধারণ করিবে কীরূপে?

কথা

নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটিই মানবের পৃথিবীতে মুখ্য সবসময়। অন্যের নিয়ন্ত্রণে গেলে যখন দাসখত নির্ধারিত হয় তখন তাকে বলি নিপীড়ন। নিয়ন্ত্রণের উল্টোপিঠে নিপীড়ন সমান পুরনো। মানবের নিয়ন্ত্রণে অস্ত্র তাই প্রধান অস্ত্র। ভূগোলজুড়ে তাই অস্ত্রের আধিপত্য, হাওয়ার সাবলিলতায় ভেসে যায় মানুষের প্রাণ। অস্ত্রের মুখে মানুষকে মানুষ বানিয়েছে দাস, করেছে শোষণ বছরের পর বছর। অথচ ক্ষণকালের তরেই মানুষের পৃথিবীযাপন। এই যাপণ তবে হয় না কেন শিশুর সারল্যে খসে পড়া হাসির মতোন। হায়!


পুনঃকথা

প্রিয় সুধীজনা, এ ব্রহ্মাণ্ডের কোনো এক মানচিত্রে একদা নেমে আসে ভয়াল আঁধার। শোষণ-নিপীড়ন আর ধ্বংস সহজ সেখানে। মুখ বুঁজে সহে কেউ, কেউ জানায় তুমুল প্রতিবাদ। বিদ্রোহী কণ্ঠগুলো স্তব্ধ হয় কিছুকাল পর। তবে কী তারা চিরকাল থেকে যাবে দাস, শৃঙ্খল কাটবে না, ভাঙবে না দানবের হাত। অতঃপর নিজভূমি বধভূমি হলে দলে দলে তারা পাড়ি জমায় অন্য সীমার পানে। কিন্তু কিছু মানুষ, যাদের চেতনা কখনো একরৈখিক নয়, যারা ভাবে এ ভূমি তার অধিকার, তবে কেন ছেড়ে যাবে তারে মুখে নিয়ে ভীরুতার ছাপ। না তারা যাবে না। তবে কী করবে তারা? বোঝার পরিধিতে তখন খেলে না কোনো উপায়ের যাদু। তারা জড়ো হয়, বসে পড়ে বৃত্তাকারে। এবং তারা নিমগ্ন হয় একান্ত ধ্যানে। তাদের বধির কান্না, তাদের নিবিড় স্বপ্ন, তাদের সমর্পণের বাসনায় মুগ্ধ পরম সাড়া দেয় অবশেষে।

বোলাম

:     তোমরা কী জন্যে এই শূন্যস্থানে জড়ো হইয়াছো?
:     আপনার অজানা নাই কিছুই।
:     জানি, তথাপি শুনিতে ইচ্ছা হয়।
:     আমাদের মুক্তির পথ প্রদর্শন করুন।
:     বস্তু জগতে মুক্তি বলিয়া কোনোকিছু নাই। ইহা একটি  
     ধারণা মাত্র।
:     আপনি তো অবস্তু, তবে বস্তু জগৎ কী করিয়া উপলব্ধি হয়?
:     অবস্তু বলিয়াই বস্তুর সীমবদ্ধতা আমার জানা। ভেতরে থাকিয়া বাহিরের আকার বুঝিয়া ওঠা দুষ্কর। আমি সর্বব্যাপ্ত বলিয়াই অন্তস্থের অবয়ব সহজেই দেখিতে পাই। মুক্তি সেও এক অবস্তু বটে, তাহাও আমার মাঝে ব্যাপ্ত হইয়া আছে। বস্তু জগতে থাকিয়া অবস্তু উপার্জিত হয় না হে।
:     তবে বুঝি আমরা চিরকাল দাসত্বের বেড়ি পড়িয়া থাকিব?
:     এইতো সহজ পথে আসিয়াছো। তোমরা দাস হইতে চাহিতেছ না। ইহা একটি বস্তুবাদী চিন্তা, যাহা তোমাদের সহিত মানিয়া যাইতেছে। এইবার কহো কী চাও তোমরা?
:     আমরা ভৃত্য থাকিতে চাহি না, আমাদের ভূখণ্ডে আমাদের মতো করিয়া বাঁচিয়া থাকিতে চাই। আমাদের সুখ, আমাদের দুঃখ আমরাই ভাগাভাগি করিয়া লইতে চাই।
:     কথাগুলো অবস্তুসূচক, বস্তু জগতে ইহা খুব বেশিদিন স্থায়ী হইবার নহে।
:     হইবে, আমরা আশ্বস্ত করিতেছি, ইহা অবশ্যই হইবে। আমরা সাম্যের ভিত্তিতে বাঁচিয়া থামিবো।
:     তোমরা অনন্তকাল ধরিয়া বাঁচিয়া থাকিবে না। যদি তাই সত্য হইয়া থাকে, তবে আর ইহার প্রয়োজন কী?
:     আমাদের সন্তান থাকিবে, তাহার সন্তানও থাকিবে। উহাদের মধ্যে আমাদের অস্থিত্ব ছড়াইয়া যাইবে। আমরা এইরূপ অনন্তকাল বাঁচিয়া থাকিবো।
:     বেশ, আমোদিত হইলাম। বস্তু জগতের সীমাবদ্ধতা মানিয়া লওয়ার পরও তোমাদের অনন্তকালের ভাবনা আমাকে মুগ্ধ করিয়াছে। যদিও ইহা একটি অবস্তু চিন্তা। একজনার অন্তর্ধানের সহিত তাহার যাবতীয় লুপ্ত হইয়া যায়। কতিপয় দেহাংশ আর কীর্তিগাঁথা ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
:     আমরা কীর্তিমান হইতে চাই।
:     কিন্তু যে লক্ষ্যে তোমরা আজ এইখানে সমবেত হইয়াছো তাহা পূরণ করিতে হইলে একটি সিদ্ধান্তে আসিতে হইবে।
:     কী তাহা।
:     বলিতেছি। আমার জানিতে হইবে, লক্ষ্যে পৌঁছাইবার জন্য তোমরা কী করিতে পারো।
:     সব পারি, সব পারি।
:     সব না পারিলেও চলিবে। শুধু এইটুকু জানিতে চাই, যদি চাই তবে কী তোমার তোমাদের সবচেয়ে প্রিয়বস্তুর মায়া ত্যাগ করিতে পারিবে?
:     অবশ্যই পারিবো।
:     এইবার কহো, তোমাদের সবচেয়ে প্রিয়বস্তু কী?
:     আমরা বুঝিতে পারিতেছি না।
:     জানিতাম, এইরূপই কহিবে তোমরা। বেশ, আমিই বুঝিয়া লইতেছি। তোমাদের মাঝ থেকে চারজন আমার সম্মুখে আইসো। তাহারা বিভিন্ন বয়সী ও বিপরীত লিঙ্গের হইবে। তাহাদের বস্তু জগতের মানুষের সঙ্গে মানুষের যেসকল সম্পর্ক তাহা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থাকিতে হইবে। তাহারা এমন হইবে যাহা হইতে আমি একটি পরিবারের ধারণা বুঝিয়া লইতে পারি। কারণ পরিবারই সর্বব্যাপ্ত হইয়া একটি মানচিত্রে একত্রে থাকিবার ভাবনা সৃজন করে।

এরপর নানা বয়সী দুই নারী ও দুই পুরুষ উঠে আসে পরমের সম্মুখে। তাদের একজন বয়োজ্যেষ্ঠ। সহজেই বোঝা যায় পিতা হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে তার। আসে একজন তরুণী। বধু কিংবা প্রেয়সী হিসেবে মানিয়ে যাবে তাকে। একজন মধ্যবয়সী নারী এসে দাঁড়ালে মায়ের আদল মনে হয়। সবশেষে যে যুবকটি নিকটবর্তী হয়, স্বামী অথবা প্রেমিক কিংবা সন্তান বলে বিবেচনা করা যায় সহজেই। পরম তখন অতিলৌকিক স্বরে নির্দেশ করেন--

:     এ ভূমের একটি মানচিত্রে একদা বাধিয়াছিল যুদ্ধ। আমি তোমাদের সেই অতীতে ফিরায়া নিব। তোমরা দেখিবে যাহা ঘটিয়াছিল সেইকালে। তোমাদের থাকিবে অদৃশ্য থাকিয়া দৃশ্যমানকে দেখিবার এক অপার্থিব ক্ষমতা। এই ক্ষমতার ওপর ভর করিয়াই তোমরা ঘুরিয়া ঘুরিয়া সবকিছু দেখিবে আর নিজের অভিজ্ঞতার সহিত মিলাইয়া ঠিক করিবে সমর্পণের বস্তু। ঠিক সপ্ত অহোরাত্রসম সময় অন্তে তোমাদের অদৃশ্য থাকিবার ক্ষমতা লুপ্ত হইবে। তখন তোমরা আবার এইখানে মিলিত হইবে। আমি আসিবো। তোমরা আমায় জানাইবে, বস্তু জগতে মানুষের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান কী?


প্রথম বয়ান
কথা

হে শ্রোতৃমণ্ডলী, মনের আর্গল খুলে তবে প্রত্যক্ষ করুন এ ভূমেরই এক মর্মস্পর্শী শোকগাথা। অনুভূতির আরো নিকটবর্তী হোন, তখন কাল-কালান্তরের বোধলুপ্ত হলে আপনিই তো বলে উঠবেন, হায়, আমাদের পূর্বসূরীদের জীবনে এমন কেয়ামত তবে নাজিল হয়েছিল একদিন!
 
কথা ও বোলাম

শহরতলীর পাড়ায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আনোয়ার লুকিয়ে রেহনুমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। কিন্তু তার এই সন্তর্পণ সাক্ষাতের খবরটি বাজারের পাশে স্থাপিত শান্তি কমিটির অফিসে হানাদার বাহিনীর প্রধান ক্যাপ্টেনের কাছে পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগে না। আনোয়ার তার বাহিনী নিয়ে হানাদারদের ভোগাচ্ছে বেশ। এই সুযোগে পালের গোদাটাকে ধরতে পারলে অঞ্চলটি তাদের একচ্ছত্র অধিকারে আসে ভেবে ক্যাপ্টেন হাঁক দিয়ে ওঠে--
:     সবাই তৈরি হও। এক্ষুণি বেরুবো।
সামনে দণ্ডায়মান শান্তি কমিটির আঞ্চলিক প্রধান ইদ্রিস খাঁর দিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন সহসা ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠে--
:     তুমি ঠিক দেখেছো? মুক্তি আনোয়ারই তো?
:     হুজুর মা-বাপ। ভুল কইলে খালি একটা গুলি কষ্ট কইর‌্যা আমার মাথায় খরচ করবেন।
:     বেশ বেশ।
:     মাইয়্যাডা যে অহনো বাড়িত আছে টের পাই নাই।
:     লাড়কি? খুব সুরত?
:     জ্বি হুজুর, খুব সুন্দর। বেহেস্তের হুর গো লাহান!
:    তুমি হুর দেখেছো?
:     তা দেহি নাই, তয় হুর নিশ্চয় ওর মতোই দেখতে অইবো। আনোয়াররে দেইখ্যা টের পাইলাম মাইয়াডা বাড়িতেই আছে।
:     হুম, তোমার মুর্খামির জন্যই এতো ভোগান্তি। নইলে মুক্তি কমান্ডারকে বহুত আগেই পাকড়াও করতে পারতাম।
:     জ্বি হুজুর কেমনে?
:     হা হা হা। মুর্খ। ওই লাড়কিকে ধরে নিয়ে আসতাম। আর তারপর বলতাম আনোয়ার ধরা দাও, তোমার মুনিয়া এখন আমাদের কাছে।
:     জ্বি হুজুর জ্বি। আপনার তুলনা নাই। লা জওয়াব।
একজন সিপাই এসে জানায়--
:     আমরা প্রস্তুত স্যার।
:     ওকে, আমি আসছি।
ইদ্রিস খাঁকে নিয়ে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে জিপে ওঠে ক্যাপ্টেন। হানাদার বোঝাই পাঁচটি জিপ ছোটে শহরতলীর পাড়ার দিকে।

নাচাড়ি

বাজে নাই সানাই সেই স্বর্গীয় ক্ষণে,
দুটি পরমাত্মার মতো মুখোমুখি তারা,
যেন বা বন্ধন অটুট
ছিঁড়বে না কোনোকালে।
অথচ অমোঘ প্রকৃতি নিভৃতে কাঁদে,
জানে সে তো
ভেঙ্গে যাবে এই মোহময় ছবি,
যাদের ঘিরে নাচে আনন্দ নূপুর
তারা তা জানে না শুধু।

কথা ও বোলাম

তখন সূর্য মধ্যাকাশে। নিভৃত গৃহকোণে তালপাতার পাখায় বাতাসের ফোয়ার ছোটায় রেহনুমা। আর আনোয়ার পরম তৃপ্তি নিয়ে ভাতের লোকমাগুলো মুখে পুড়ে নেয়। কোনো বার হয়তো একটি লোকমা তুলে দিয়ে চায় মাত্র তিনদিনের সংসার যাপণের সঙ্গীনির দিকে। সঙ্গীনি লজ্জায় আঁচলে মুখ লুকায়Ñ
:    আপনে খান, আমি তো হগল সময় খাওনের মধ্যেই আছি।
:     আমার হাতে খাইলে কী হয়?
:     ইস, কেউ যদি দেইখ্যা ফালায়। লজ্জায় মরমু না আমি?
:     তোমারে দিতাছি নাহি? আমি তো দিতাছি আমার সন্তানরে।
আনোয়ার পরম মমতামাখা দৃষ্টি নিয়ে তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা রেহনুমার উঁচু হয়ে ওঠা উদরের দিকে তাকায়।
:     বেহায়া পুরুষ।
কপট রাগে কথা দু’টি ছুঁড়ে দেয় কয়েক দিনেই ভালোবেসে ফেলা মানুষটির দিকে। আর সেই মানুষটি যুদ্ধের ময়দানে অকুতোভয়, শত্রুর ঘুম কেড়ে নেয়া চোখ তুলে তাকিয়ে অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়বার মুহূর্তে চুপ। তার এই গোপন অভিসার জানাজানি হলে শহরতলীর এই পাড়ায় গজব নেমে আসবে। দুধমাখা ভাতের শেষ লোকমাটি মুখে দেওয়ার মুহূর্তে আনোয়ারের কানে আসে জিপের আওয়াজ। সচকিত হয়ে ওঠে সে। তবে তার এই আসা গোপন থাকে নাই। শ্বশুর রফিকুদ্দিন দ্রুত ভেতরে আসে--
:     বাবা আনোয়ার, বাড়ির কাছে আর্মি। তুমি পালাও।
আনোয়ার ক্ষণকাল রেহনুমার দিকে তাকিয়ে উঠে যায় দ্রুত--
:     আমার সন্তানরে সামলায়া রাইখো। বাঁইচ্যা থাকলে আবার দেহা অইবো।
পেছনের দরজামুখ থেকে ফিরে আসে আনোয়ার। রেহনুমা কিছু বুঝে ওঠার আগেই টের পায় বলিষ্ঠ পুরুষটির বাহুর বন্ধনে সমর্পিত তার দেহ। ইচ্ছে হয় না ছেড়ে দিতে। কিন্তু মাথার ওপর জীবন-মরণের বিদ্যুৎ চমকায়। আনোয়ারের হাতের বন্ধন ছিন্ন করে ঠেলে দেয় পালানোর পথে--
:     যান, সন্তানের দোহাই, দেশটারে মুক্ত না কইর‌্যা ফিরবেন না কইলাম।
আনোয়ার পালানোর পথে দ্রুত মিলায়। কিন্তু এ কী, চারদিক ঘিরে আছে অস্ত্রধারীরা। উপায় না দেখে পাশের কলাবাগানে মিশে যায় যেন আরো একটি বৃক্ষ হয়ে।

ইদ্রিস সবার আগে, পেছনে অস্ত্রধারী কয়জনা। রফিকুদ্দিন তখন ঘরের দাওয়ায় একটি বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে যেন বা নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে।
:     আনোয়ার কোথায়?
:     আনোয়ার? হে তো মাইয়াডারে বিয়া কইর‌্যা তিনদিনের মাথায় নিরুদ্দেশ হইছে।
:     তাই না?
ইদ্রিস দ্রুত ঘরের ভেতরে ঢোকে। পেছন পেছন তাকে অনুসরণ করে কয়েকজন সিপাই। রেহনুমা তখন আনোয়ারের শেষ খাবারের থালা আর পিতলের পানপত্রটি সরাতে ব্যস্ত। ঘরের ভেতরে এতগুলো মানুষ দেখে রেহনুমা শাড়ির আঁচলে ঘোমটা টেনে দেয়। ইদ্রিস আপন মনেই বলতে থাকে--
:     বেশিক্ষণ হয় নাই পালাইছে। আশে পাশেই আছে।
ইদ্রিসের ইঙ্গিতে সারাঘর আঁতিপাঁতি খোঁজা শেষ করে সিপাইরা। কিন্তু পায় না। তখন এ অঞ্চলের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ইদ্রিসের মনে পড়ে ক্যাপ্টেনের বলা কথাগুলো। আর তখুনি হ্যাঁচকা টানে রেহনুমাকে নিয়ে ঘরের বাইরে আসে সে। উঠোনে দণ্ডায়মান ক্যাপ্টেন।
:     হুজুর, ওই শালারে পাই নাই। আপনের কথামতো এইডারে লইয়া আইলাম। নেন যা খুশি করেন।
ক্যাপ্টেন ঘুরে ঘুরে রেহনুমাকে দেখে--
:     ইদ্রিস, তুমি সব সময় আমার কাছে মিথ্যে বলে থাকো।
:     না হুজুর, আমি আপনার লগে কুনো মিথ্যা কই নাই।
:     তাই যদি না হোবে, এই লাড়কিকে আমার হুরের চেয়ে সুন্দর বলে মনে হোবে কেন?
আকস্মিক এই ঘটনায় বিমূঢ় রফিকুদ্দিন নিজের মেয়ের সম্ভাব্য পরিণতি আঁচ করতে পারে। আর তখনই দ্রুত মাটিতে পড়ে জড়িয়ে ধরে ক্যাপ্টেনের পা--
:     হুজুর আমার মা মরা একমাত্র মাইয়া, তিন মাসের পোয়াতি। ওরে আপনে কিছু কইরেন না। ছাইর‌্যা দেন। রহম করেন।
ক্যাপ্টেনের ডান পা রফিকুদ্দিনের হাতের বেষ্টনে আটকে ছিল। কিন্তু বাঁ পা মুক্ত। আর সেই স্বাধীন পা কেই প্রবল শক্তিতে এপাশ ওপাশ করে খাঁকিপোশাকধারী ক্যাপ্টেন। আর তাতে বুকের ওপর প্রবল আঘাত নিয়ে ছিটকে পড়ে রফিকুদ্দিন, গোঙায়। কিন্তু তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই ক্যাপ্টেনের। সে ধীর পায়ে হেঁটে এসে রফিকুদ্দিনের বুকের ওপর তুলে দেয় বুট। অতঃপর জমাট বরফ শীতল কণ্ঠে, কোনো কম্পন না তুলে অধিকর্তার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে--
:     আনোয়ার কোথায়?
রফিকুদ্দিন ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে বলে--
:     জানি না হুজুর।
:     শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি, বল আনোয়ার কোথায়?
:     সত্যি কইতাছি হুজুর। হে আইছিল, তয় চইল্যা গেছে।

ক্যাপ্টেন অকস্মাৎ কোমরের পাশ থেকে ওয়েস্টার্ন মুভির আউট ল দের মতো পিস্তল বের করে একটিমাত্র গুলি ছোঁড়ে। রফিকুদ্দিনের মাথা জড়িয়ে থাকা শান্তিরঙা সাদা টুপিটি দেখতে দেখতে সিঁদুরবর্ণ ধারণ করে। রেহনুমা তীব্র চিৎকারে লুটিয়ে পড়ে সদ্যমৃত পিতার দেহের ওপর। কিছুক্ষণ আগেও শিহরিত, লজ্জানত, অপার্থিব কোনো সুভানুভূতিতে ছেয়ে ছিল এই নারীর সর্বান্তকরণ। আর এখন সেখানে কেবলই শোকের লোবান, কান্নার বলকে কম্পিত শরীরে বেদনার ঢেউ। ইদ্রিস এগিয়ে এসে রেহনুমার চুল ধরে টেনে তোলে। তারপর স্বদম্ভে চিৎকার দিয়ে ওঠে--
:     আনোয়ার, তুমি আশেপাশেই লুকায়া আছো। ধরা দাও, তোমার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী নইলে বেইজ্জত হইবো।
ইদ্রিসের এই ঘোষণার পর কিছু সময় কেটে যায়। আর শহরতলীর পাড়ার এই অংশটিতে হুট করেই নামে কবরের নিস্তব্ধতা। কিন্তু দূরে কোথাও একটি কাক কা শব্দে ডেকে উঠলে সেই নিরবতায় আপাতঃ টোল পড়ে। কিন্তু ওটুকুই। ক্ষিপ্ত হয়ে ইদ্রিস তার হাতের মুঠায় থাকা চুলে টানের মাত্রা বাড়ায়, আর তাতে ব্যথায় ক্রন্দসী রেহনুমার কণ্ঠ দিয়ে কেবলি আ আ ধ্বনির নুড়ি ঝরে পড়ে। অতঃপর ঘরের নেপথ্য হতে ধীরে ধীরে উঠোনে দৃশ্যমান হয় আনোয়ার--
:     ওরে ছাইর‌্যা দাও।
রেহনুমাকে ছেড়ে দিয়ে ইদ্রিস তাকায় আনোয়ারের দিকে। যেন বা এমন অবাক করা দৃশ্য ইতোপূর্বে সে দেখে নাই। তার সেই দৃষ্টিতে বিস্ময় আর ক্রূরতার যুগল হুল্লোড়Ñ
:     সাবাস আনোয়ার। এই না হইলে পুরুষ কিয়ের অ্যা!
অস্ত্রধারী সিপাইরা মুহূর্তেই আনোয়ারকে ঘিরে ধরে। তাদের হাতে থাকা রাইফেলের চকচকে ধাতবনলগুলো এক একটি উদ্যত ফণা। ক্যাপ্টেনের ভেতরে তখন ভর করে অপ্রাকৃত পৈশাচিকতা। বেদনায় ন্যূব্জ রেহনুমা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে, খানিকটা টলায়মান। ক্যাপ্টেন হঠাৎ করেই রেহনুমার শাড়ির আঁচল ধরে টানে। ও তো আর দ্রৌপদী নয়, সম্ভ্রম হরণের মুহূর্তে যার ফুরাবে না শাড়ির আড়াল। নিতান্তই বস্তুজগতের নারী রেহনুমা দু’হাতে আড়াল করে দেহ, শাড়ি তার গড়ায় ধূলায়। প্রেমাষ্পদের এই অপমানের দৃশ্যে আনোয়ারের ভেতর ক্ষিপ্ততার বাঘ ডেকে উঠবে, এ আর এমন কী? তার কণ্ঠে হিসহিসিয়ে ওঠে কথার চাবুক--
:     আমি তো ধরা দিছি, ওরে কিছু কইরেন না কইতাছি।
আনোয়ারের এই হুমকি সমবেত অস্ত্রধারীদের হাসির খোড়াক হয়ে ওঠে হয়তো। খাঁচায়বন্দি বিক্রমশালী কোনো প্রাণীর আস্ফালন দর্শণার্থীরা চিরকাল বাদাম কিংবা চিপস চিবুতে চিবুতেই উপভোগ করে কী না! বন্দি যোদ্ধারও এই বৃথা বাক্যবাণ! ক্যাপ্টেন দ্বিগুণ উৎসাহে রেহনুমার ঊর্ধ্বাংশের জামায় রাখে হাত। ঠিক কয়েক মুহূর্ত মাত্র। আনোয়ার তার দিকে তাক হয়ে থাকা ফণাসম অস্ত্রগুলোর একটি কেড়ে নেয় সর্বশক্তি দিয়ে। তারপর অব্যর্থ অর্জুনের মতো ছোঁড়ে মাত্র একটি গুলি। রেহনুমার বস্ত্রহরণের মুহূর্তে মেঘমুক্ত আকাশে লুকাতে পারেনি সূর্য। তার গনগনে তাপের প্রতাপ ছাপিয়ে আর একটি লাল টকটকে সূর্য রেহনুমার বুকের ঠিক কেন্দ্রে ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকে। মুখে বেদনার ছাপ ছাপিয়ে কৃতজ্ঞতাভরা হাসির রেখা টেনে রেহনুমা ঢলে পড়ে বাংলার উত্তপ্ত ভূমিতে। আর রণাঙ্গণের অকুতোভয় মুক্তিসেনানী আনোয়ারের নির্ঘুম চোখ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে ধুলায়।

ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে হাওয়ায় লুপ্ত শরীর তরুণী এই দৃশ্যময়তা দেখে। সে মাথা নিচু করে। অতঃপর মনে মনে ভাবে--
:     মানুষের সবচেয়ে আরাধ্য বস্তু তার সম্ভ্রম। মুক্তির জন্যে আমি তা বিকিয়ে দিতে পারি অবলীলায়।


দ্বিতীয় বয়ান

কথা

অতঃপর বর্ণনাপিপাসুগণ, নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কখনো জানতে চেয়েছেন কি, গোত্র-সম্প্রদায় অথবা ধর্মের সীমার চেয়ে মানুষের পরম্পরা অধিক মূল্যবান কি না! কোনো এক অদৃশ্যলোকের মায়ায় সময়ের ভগ্নাংশসম এ জীবন কতো অপচয়ের স্রোত বেয়ে হারিয়ে গেছে অন্ধ সমুদ্রে। করোটির সচেতন অংশে কম্পন তুলে ভাবুন, এই জল-বৃক্ষ জড়ানো পৃথিবীতে মানুষ নাই একজনা, তবে আকার কিংবা অদৃশ্যবাদীদের প্রভুর অর্ঘ্য অর্জিত হবে কোথা হতে, অথচ এই চরাচর মনুষ্যহীন হলে প্রকৃতির কোনো ছন্দ পতন হবে না নিশ্চিত। যার কথা ভেবে ভেবে পারলৌকিক বিভায় নিমগ্ন অহোরাত্র, আপন স্তুতির আশে অতটা নিষ্ঠুর তিনি নন, যতটা নিষ্ঠুর মানব বিপরীত দর্শনে থাকা জীবন বিনাশে, হায়!

কথা, বোলাম ও নাচাড়ি

অস্ত্রধারী হানাদারেরা যখন গ্রামটিতে ঢোকে তখন সন্ধ্যা। তাদের বহনকারী কতিপয় যন্ত্রযান। গাঁয়ের পথ জোনাকজ্বলা। আলাভোলা পথে ঠোক্কর খেয়ে চলছে যন্ত্র দানবেরা। একগুঁয়ে। মাড়িয়ে যাচ্ছে ঝোঁপ, লতাগুল্ম, উঁইয়ের ঢিবি।   বেশ খানিক দূর থেকে ভেসে আসছে মন্দিরা আর খোলের আওয়াজ। সঙ্গে সম্মিলিত কণ্ঠের সুর। আরো খানিক এগিয়ে গেলে কানে আসে কথাগুলো। একই কথা অথবা পদ, পুনরাবৃত্ত হচ্ছে তালে ছন্দে। কিন্তু তাতে কী ভীষণ আবেগ আর ভক্তি পড়ছে ঝরেÑ
হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ,
কৃষ্ণ কৃষ্ণ, হরে হরে
হরে রাম, হরে রাম
রাম রাম, হরে হরে
কীর্তনের আসর বসেছে। মন্দিরের চাতালে গোল হয়ে আছে কিছু মানুষ। বেজে চলেছে হারমোনিয়াম, খোল আর মন্দিরা-করতাল। একজনে সুরটা ধরে দিল তো সমবেতগণ বহন করে চলে একযোগে। কীর্তনের সুরে ভক্তগণ খোঁজের পরমের সান্নিধ্য। মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়েই কীর্তনের সুরে মজে ছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষটি।

ঠিক তখন সেখানে উজিয়ে আসে কয়েকটি জলপাইরঙা যন্ত্রযানগুলো। তাতে বোঝাই অস্ত্রধারী। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই অস্ত্রধারীরা ধুপধাপ নেমে পড়ে, চালায় গুলিÑ দ্রুম দ্রুম। অশরীরী হয়ে থাকা বয়োজ্যেষ্ঠর পাশ দিয়ে ছুটে যায় উড়ন্ত কিছু বুলেট। আর আটজন সাধু কীর্তনের সুরের রেশ মিলানোর আগেই ঢলে পড়েন মন্দিরের শীতল চত্ত্বরে। যে পরমের খোঁজে তারা সুরের অর্ঘ্য ঢেলে দিচ্ছিলেন এই খানিক আগে, রক্তের স্তোত্রে ভেসে সেই পরমের সত্তায় লীন হতে পেরেছিল কিনা জানা নাই, তবে আটটি মৃতদেহ জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দিলে সাধুদের কায়া যে ধীরের ধীরে অসীম শূন্যতায় ধাবিত হয়েছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। এ গাঁয়ের রশিদউদ্দিন মোল্লার গোঁফের আড়ালে থাকা মোটা দুই ঠোঁট তখন বেশ কিছু পরিমাণ বিস্তৃত হয়েছিল। ফলফলারির বাগান আর বিশাল পুকুরসহ এই মন্দির নিজের দখলে নেওয়ার পথে আর কোনো কাঁটা নাই ভেবে স্বস্তি বোধ করে সে।
:     মালাউন নিপাত যাক, পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
হঠাৎ এই আওয়াজ তুলে রশিদ উদ্দিন পাকিস্তানি বাহিনী নিয়ে গ্রামের অভ্যন্তরে অগ্রসর হয়। আর পৃথিবীতে প্রিয়তম বস্তুর খোঁজে ভ্রাম্যমান অদৃশ্য বয়োজ্যেষ্ঠও পিছু নেয় সেই ঘাতক বাহিনীর।

পদ

আত্মা নয় দেহের অংশমাত্র তবু
অনিবার্য এক বন্ধন গড়ে দেয়,
তার তরে রাখে জীবনের সব বাজি
ফুৎকারে ত্যাগে অর্জন যতো আছে।
কে হায় কবে ছেড়েছে তাহার মায়া
বিশাল কোনো স্বপ্নের দিশা পেয়ে।
আসে কোনো ক্ষণ তারও ফাঁক গলে
 বন্ধন ছেঁড়ে অজানা হাওয়ায়।

কথা ও বোলাম

গুলির শব্দ ধনাঢ্য চিত্ত সেন বাড়ির উঠানের দাওয়ায় বসেই শুনতে পেয়েছিল। তাতে চিত্ত সেনের চিত্তে দুঃশ্চিতার ভাঁজ পড়ে। রেডিওতে তখন আকাশবাণীর খবর। উঠোনটা বেশ প্রশস্ত হলেও চিত্ত সেন স্বল্পায়তনেই সীমায়িত করেন অস্থির পায়চারি। স্ত্রী আশালতা দ্রুত ঘরের বাইরে এসে দিকে শঙ্কাতুর দৃষ্টি দিলে চিত্ত সেনের চারপাশ ঘিরে ফেলে একরাশ অসহায় বোধ--
:     মিহির, শংকর, সিদ্ধার্থ আর অনিল কই?
:     ওরা খাওয়া-দাওয়া কইর‌্যা ঘুমাইছে।
চিত্ত সেনের রাখাল হরিহরণ দৌড়ে আসে। হাঁপাচ্ছে। কালো শরীরে যেন হাঁপড়ের ওঠানামা। চিত্ত সেন তাকিয়ে থাকেন। অপেক্ষা করেন। হরিহরণ দু’হাত হাঁটুতে ভর দিয়ে দ্রুত লয়ে বলে চলেÑ
:     কত্তা, মন্দিরে অনেক মানুষ মাইর‌্যা ফালাইছে পাকিরা। সাধু গোরেও মারছে। তাগোরে একলগে পোড়ায়া দিছে গো!
:     হেরা অহন কই?
:     জানি না। তবে হুনছি, এইগ্রামে মুক্তিবাহিনী আসছে। হেরা তাগোরে ধরনের লাইগ্যা গ্রামে ঢুকছে। সাথে খবিশ রশিদ্যা আছে।
:     আইচ্ছা, তুই গোয়াইল ঘরে গিয়া থাক।
:     এই বাড়িত যদি আহে?
:     আইলে আর কী করন যাইবো?
:     চলেন কত্তা ভাগি, পলাইয়্যা যাই।
:     পালায় যামু কই? তুই যা।
:     কত্তা, সাধুগোরে রেহাই দেয় নাই, যদি আপনেরে কিছু করে।
:     করলে আর কী করন যাইবো। কপালে যা আছে তাই অইবো।

ঠিক এমন সময় কিছু মানুষের দ্রুত পায়ের চলন কানে আসে। উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা শঙ্কাগ্রস্ত ত্রয়ী এক যোগে শব্দের উৎস খোঁজে। কয়েকজন যুবক দ্রুত এসে সামনে দাঁড়ায়। চাদরে ঢাকা তাদের শরীর।
:     কারা আপনেরা?
কম্পিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে চিত্ত সেন। যুবকদের মধ্যে একজন দ্রুত বলে ওঠে--
:     চিৎকার করবেন না। আমরা মুক্তিযোদ্ধা। মিলিটারির তাড়া খায়া এহানে আসছি।
:     মিলিটারিরা কই অহন?
অপর এক যুবক জানায়--
:     এই দিকেই আসতাছে। তিনটারে খতম করছি। কিন্তু ওই রাজাকারডারে ফালাইতে পারলাম না। আমারারে একটু লুকাইয়্যা থাহনের জায়গা দেন।
:     বাবারা তোমরা যেহানে খুশি লুকায়া পড়ো।
চিত্ত সেনের কণ্ঠে আর্দ্রতার আভাস। হরিহরণ সামনে এগিয়ে আসেÑ
:     আমার লগে আহেন।
ঘুমহীন চোখে তাড়া খাওয়া যুবকের দল সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে হরিহরণের দিকে তাকায়--
:     ওর লগে যাও বাবারা।
হরিহরণ প্রদর্শিত পথে যুবকেরা গোয়ালঘরের অভ্যন্তরে মিলায়। তখনো আশালতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৃদু ধমক দিয়ে ওঠেন চিত্ত সেন--
:     দাঁড়ায়া দেখতাছো কী? ঘরে যাও।
:     আপনেও আহেন।
:     আসতেছি যাও।
স্ত্রী তার ঘরে যায়। চিত্ত সেন চারপাশের ভাসা ভাসা অন্ধকারে চোখ বুলিয়ে আকাশমুখা তাকায়। কী খোঁজে? হয়তো ফেলে আসা দিনগুলোর ভাঁজে ভাঁজে থাকা বিভাজনসূত্রের হদিস! কিন্তু অখ- আকাশের কোথাও নাই এতোটুকু বিভক্তিরেখা। এক দীর্ঘতর শ্বাস বাতাসে মিশিয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ানো মাত্র একটি কণ্ঠস্বরের ডাকে থমকে দাঁড়ায় চিত্ত সেনÑ
:     চিত্তবাবু একটু খাড়ান।
চিত্ত সেন দ্রুত পেছন ফিরে দেখে রশিদউদ্দিন মোল্লা কয়েকজন খাঁকি পোশাকপরিহিত অস্ত্রধারী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উঠোনে। আসন্ন বিপদ আঁচ করলেও প্রাণপণে নিয়ন্ত্রণ করে নিজেকে। চেষ্টা করে গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার। তারই অংশ হিসেবে দ্রুত লয়ে প্রশ্ন করে যায় শুধু--
:     আরে রশিদ সাহেব আপনে? এতো রাইতে? কী মনে কইর‌্যা? আছেন কেমন?
:     হ, আমি। বেশি বালা নাই। দেশ আর মুসলমানগোর কথা চিন্তা কইরা একটু পেরেশানিতে আছি আর কী।
:     সব ঠিক হয়া যাইবো?
:     কী অইবো?
:     না মাইনে, যুদ্ধ শেষ হইয়া যাইবো।
:     কীসের যুদ্ধ, কার লগে যুদ্ধ? একটা গ-গোল শুরু হইছে আর বেবাকে মিইল্যা এইডারে যুদ্ধ বানায়া ফেলছে। কী ব্যাপার চিত্তবাবু আপনের মুখেও তো মুক্তিগো লাহান কথার সুর।
‘মুক্তি’ শব্দটি পাকিদের শ্রবণ পরিধিতে পৌঁছানো মাত্রই হাতে থাকা রাইফেলগুলো ঝনাৎ করে ওঠে-
:     মুক্তি? মুক্তি কোথায়? কাঁহাসে?
:     না না স্যার, মুক্তিরা দৌড়াইয়া এদিকেই আসছে। এই বাড়িতেই তারা লুকাইছে। কী চিত্তবাবু কইনে লুকাইছেন হেগোরে?
:     আমি জানি না, দেহি নাই।
:     স্যার, সোজা আঙুলে ঘি উঠবো না, আঙুল একটু বাকা করন লাগবো।
:     মানে?
:     মানে স্যার, একটু টাইট দিতে অইবো।
:     হুম!
হানাদার কমান্ডারের ইঙ্গিতে চারদিক থেকে চিত্ত সেনকে ঘিরে ফেলে খাঁকিপোশাকধারীর দল। উঁচু করতে শুরু করে রাইফেল। চিত্ত সেন বিরবির করে স্রষ্টাকে স্মরণ করেন। ঠিক এমন সময় ভেসে আসে একটি আর্ত চিৎকার--
:     হেরে ছাইরা দেও। হে কিছু জানে না গো। হা ভগবান রক্ষা করো।
অস্ত্রধারীরা চমকে উঠে থেমে যায়। চক চক করে তাদের চোখ। সেখানে তখন কেবল ভোগের আকাঙক্ষা
:     জেনানা কণ্ঠ!
:     জ্বি স্যার, হের বিবি।
:     খুব সুরত!
:     বুড্ডা স্যার, বুড্ডা।
:     হোয়াট?
রশিদউদ্দিন তখন বৃদ্ধার মতো হাঁটার ভঙ্গি করে-
:     এইরহম স্যার।
লোলুপ হানাদারগুলো একযোগে হেসে ওঠে-
:     তুমহারা গ্রাম, জেনানা নেহি?
:     আছে স্যার, সব হইবো স্যার। আগে মুক্তি।
:     ঠিক বলেছ, মুক্তি।
অস্ত্রধারীদের কয়েকজন তাদের কমান্ডারের ইঙ্গিতে দ্রুত চিত্ত সেনের ঘরের    অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় রশিদউদ্দিন। ঘরে ঢুকেই তছনছ করে সবকিছু। আলমিরা ভেঙ্গে নিয়ে নেয় স্বর্ণালঙ্কার, বেশকিছু অর্থ। বাসন-কোসন আর ভঙ্গুর কোনোকিছুই রক্ষা পায় না। অতঃপর বেরিয়ে আসে তারা। রশিদউদ্দিন বলে-
:     কেউ নাই স্যার।
পাকি কমান্ডার বাঁশিতে ফুঁ দিলে এক সেপাই অন্ধকার হতে উদয় হয় সম্মুখে-
:     স্যার?
:     কাউকে দেখেছ?
:     না স্যার। সারাবাড়ি ঘিরে রেখেছি আমরা। একটা মাছিও বেরুতে পারবে না স্যার।
:     ওকে, যাও।
:     বলুন, মিস্টার চিত্ত সেন, মুক্তি কোথায়?
রশিদউদ্দিন একটি কাপড়ে লুট করা স্বর্ণালঙ্কার বাঁধতে বাঁধতে খেঁকিয়ে ওঠে--
:     ওই মালাউনের বাচ্চা, হেরারে কই লুকায়া রাখছোস?
পরমুহূর্তেই রাইফেলের বাট সজোড়ে আঘাত হানে চিত্ত সেনের পিঠে। চিত্ত সেন ভগবানের নাম স্মরণ করে ব্যথায় ন্যুব্জ হয়। গোয়াল ঘর থেকে একটি বাছুর হাম্বা হাম্বা রবে ডেকে ওঠে। অস্ত্রধারী হানাদারেরা একযোগে তাকায় সেদিকে। চিত্ত সেন মাটিতে ঝুঁকে গোঙাচ্ছে তখনো। কয়েকজন সিপাই অস্ত্র তাক করে এগোতে থাকে গোয়ালের দিকে। রশিদউদ্দিন সর্বশক্তি দিয়ে লাথি বসায় চিত্ত সেনের বুকে। চিত্ত সেন লাথি খেয়ে চিৎ হয়ে যান, দেখেন গোয়ালের দুয়ারে পৌঁছে গেছে অস্ত্রধারীরা। চিত্ত সেন চিৎকার দিয়ে ওঠে-
:     ওই ঘরে।
মুহূর্তে অস্ত্রধারীরা অগ্রসর হয় চিত্ত সেনের দেখানো ঘরটির দিকে। ঘিরে ফেলে দ্রুত। সেই সঙ্গে উঠে যায় অস্ত্র। পাকি কমান্ডারের তখন হয়তো বা তামাকের তৃষ্ণা পেয়ে থাকবে! পকেট থেকে চুরুট নিয়ে ঠোঁটে ঠেকিয়ে তাতে ফস করে দেশলাইয়ের আগুন ধরায়। পরমুহূর্তে অবশিষ্ট জ্বলন্ত কাঠিটি ছুঁড়ে দেয় সেই ঘরের খড়ের চালে। বৈশাখের খরতাপে শুষ্ক খড়গুলোও আগুনের ডাকে সাড়া দিয়ে পুড়তে থাকে দ্বিগুণ হয়ে। দেখতে দেখতে ঘরটি নিমজ্জিত হয় আগুনের গ্রাসে। তারও কিছুক্ষণ পর ওই ঘরের অভ্যন্তর হতে শোনা যেতে থাকে জান্তব চিৎকার। চিত্ত সেন মাটিতে লুটিয়ে গোঙাতে গোঙাতে কাঁদেন। চারটি দেহ শরীরে আগুন মেখে অগ্নিঘর ছেড়ে বেরুতে চাইলে অস্ত্রধারীদের তাক করা বন্দুকগুলো গর্জে ওঠে একযোগে।

কথা

হে দৃশ্যপিপাসুগণ, নতমুখা হোন, বিলাপ করুন এই অগ্নিপুরাণ দর্শনে। মৃতের অন্তিমবাসর যে চিতা, চারটি জীবন্ত দেহ তাতেই পেতেছে শয্যা, হায়! কলজেতে ঈগলের ঠোক্কর খেয়ে আগুনচোরা প্রমিথিউসের যে চিৎকার, শুনতে পাচ্ছেন কি? পাচ্ছেন না! এরাই তবে এ কালের প্রমিথিউস, আগুনটুকু নিজের গায়ে নিয়ে শৃঙ্খল ভেঙে মুক্তি দিয়ে গেল।

কথা ও বোলাম

আগুনে জ্বলন্ত দেহগুলো একঝাঁক বুলেটে বিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটায়, স্তব্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে ভস্মীভূত হয় ঘরটি। আর মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে আসা হানাদার বাহিনী অপারেশন ‘সাকসেসফুল’ করে কমান্ডারের নির্দেশে গাড়িতে গিয়ে ওঠে। রশিদউদ্দিন তখন ওই পুড়ে যাওয়া ঘর হতে নিয়ে আসে কিছু ছাই। চিত্ত সেনের একটি হাতের বুড়ো আঙুল সেই ছাইয়ে ঠেসে ধরে অতঃপর পাঞ্জাবির পকেট থেকে সাদা কাগজ বের করে তাতে নিয়ে নেয় টিপসই। বড্ড অবহেলায় হাতটি ছুঁড়ে ফেলে শোকাকুল চিত্ত সেনের বুকের ওপর পা রাখে রশিদউদ্দিন-
:     কাইল এই গ্রাম থাইক্যা চইল্যা যাবি তগোর দেশে। আর য্যান কুনো দিন না দেহি। এই যে তরে মারি নাই, বাঁচাইয়্যা রাখলাম, টিপসইডা হের নজরানা। বুঝছোস? তর পোলাগোরে পাইলাম না। আগেভাগে পাডায়া দিছস, না? যাউকগ্যা, বাঁইচ্যা গেল।

কান্নার প্রবল প্রতাপ উপেক্ষা করে চিত্ত সেন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। মূল ঘরের অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে আসে ক্রন্দসী আশালতা। দু’জনে মিলে চারটি দেহের নিকটবর্তী হয়। আগুনে পুড়ে কুণ্ডলি পাকিয়ে পড়ে থাকা লাশগুলোতে তবু মিহির, শংকর, সিদ্ধার্থ আর অনিলের চিহ্ন খোঁজে তারা। কিন্তু পৃথক করতে পারে না। আশালতা মূর্চ্ছা গেলে চিত্ত সেন হু হু করে কাঁদেন। তার চোখের জলে ভেজে তপ্ত বাঁকাচোরা দেহগুলো।

অদৃশ্য বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ চোখ মোছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বাঁচাতে নিজের চার পুত্রকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলো চিত্ত সেন। বয়োজ্যেষ্ঠর মনে পড়ে, খোদা সবচেয়ে প্রিয়বস্তু উৎসর্গের আহ্বান জানালে নিজপুত্র ইসমাইলকে জবাই করতে উদ্যত হয়েছিলেন ইব্রাহিম। সন্তানই তবে পৃথিবীতে সবচেয়ে কাম্য প্রিয়বস্তু!

পরদিন এক কাপড়ে গৃহত্যাগ করেন চিত্ত সেন আর আশালতা।

বাংলাদেশ সময় ১৪৫৩, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।