ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

গল্প

অধরাকে লেখা কাঞ্চনের শেষ চিঠি

তাহজীব হাসান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১২

প্রিয় অধরা

জানি, মন খারাপ করে বসে আছ। চোখ থেকে দু এক ফোটা পানিও পড়ছে।

পড়ুক, পড়তে দাও। কাঁদলে মানুষের মন হালকা হয়।

আমার মতো একটা বেয়াকুবকে, ভাল না বাসলে তোমার কোন ক্ষতি হতো না। কত ছেলে তোমার পিছনে ঘুর ঘুর করতো। এদের মধ্যে ক্লাসের ফাস্ট থেকে শুরু করে পাড়ার মাস্তানও কেউ বাদ ছিল। এই পাগলদের যন্ত্রতায়, আমরা কোথাও বসে ঠিকমত গল্প টল্প করতে পারতাম না। ফাস্ট ফুড বা রেস্তোরায় কিছু খেলে কেউ না কেউ বিল দিয়ে উধাও হয়ে যাবেই। সাথে রেখে যেত ছোট একটা চিরকুট আমার  ভালবাসার জন্য, কেউবা লিখিত আমার স্বপ্নের জন্যে আরো কত কি।

এসব একদমই সহ্য হতো না, তোমার। রাগে, তোমার গোলাপী গাল  লাল হয়ে যেত। মিটি মিটি  হাসতাম, আমি। এ দেখে আরো লাল যেতে। তখন কি সুন্দর লাগত তোমাকে।
বলে বুঝাতে পারবো না।
তাদের বাদ দিয়ে তুমি কি না আমাকে ....
লক্ষিটি, মন খারাপ করে থেকো না। একটু বুঝার চেষ্ঠা কর, কষ্ঠ হলেও আমাকে ভুলে যাও। ভুলতে তোমাকেই হবেই। আমার কোন ক্যারিয়ার নেই। কোন ভবিষৎ নেই। আছে শুধু, জেলখানার চার দেয়াল। শরীফ ছেলে হিসেবে খারাপ না। কাজেও শরীফ ছেলে। মস্ত বড় ডাক্তার। গাড়ি, বাড়ি খ্যাতি তার কিসের অভাব। তুমি আমাকে ভুলে গিয়ে তাকেই. . .।

কি করব বল? রাজনীতির খাতায় আমার নাম। তাও আবার বোকা পার্টির, বোকা নেতা। আমার পার্টির লোকজন কিংবা আমি এদিক সেদিক টাকা মারতে পারি না। জনগণকে ভুলে গিয়ে নিজেদের কথা ভাবতে পারিনা।

থাক, এসব কথা। মনে আছে, রাহাত কি কান্ডটাই না করেছিল? এ জগতে তোমাকে পাব না, তাই ইহা ত্যাগ করলাম। অন্য জগতে তোমাকে খুঁজবো।

এক টুকরো কাগজে এ কথা গুলো লিখে হলের ছাদ থেকে লাফাল। মরল ত না ই। পা’টা ভাঙ্গল। তুমি আর আমি মিলে হাসপাতালে তার সেবা করলাম। হাসপাতালে দিনে তোমার ডিউটি ছিল আর রাতে আমার। জানো, রাহাত বড় একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পাসীতে উঁচু বেতনে চাকরী করে, সাথে বড় বাড়ী আর দুইটা গাড়ী দিয়েছে অফিস থেকে। ফুটফুটে ছোট্ট একটা মেয়ে নিয়ে দারুণ সংসার।

বউ কে জান, আমাদের অনীতা। সমাজবিজ্ঞানে পড়তো মেয়েটা। ভাল গানও গাইত।

দেখ, আমাকে নিয়ে তোমার চিন্তা করার কোন প্রয়োজন নেই। যে েিনেজকে নিয়ে চিন্তা করে না। তাকে নিয়ে তুমি কেন চিন্তা করবে। নিজের জীবনটা এভাবে নষ্ট করবে? যারা তোমাকে নিয়ে ভাবে, তোমাকে ভালোবাসে তাদের কথা চিন্তা কর।
তাদের ভালোবাসতে শিখো। যারা তোমাকে কষ্ট দেয়, তাদের কষ্ট দাও। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। এ নিয়ম পাল্টালে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই পাবে না।

ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সময় একটা পা হারালাম। তারপর থেকে ক্রেচই আমার সব সময়ের বন্ধু। জেলে থাকি আর জেলের বাইরে, মিটিং যাই কিংবা মিছিল করি সব সময় আমার সাথে থাকে। সরকার দলের ছেলেদের হারিয়ে নির্বাচনে জিতে ছিলাম আমরা। এই অপরাধে সোহেল, শান্ত আর আমাকে জেলে বন্দি করে রাখল। জেলখানায় ওরা প্রতিদিন শান্ত আর সোহেলকে প্রচুর মারত। আমাকেও মারত, পা নেই বলে বেশি মারেনি। তিন বছর জেলের ঘানিটানার পর ছাড়া পেলাম। জেল গেইটে ফুল হাতে তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে। আমার পার্টির ছেলেরাও এসেছিল। আমি তোমাকে দেখে না তেখার ভান করে চলে গিয়েছিলাম। পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলে আমার দিকে। চোখে পানি ছিল কিনা দেখিনি। প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছিলে, জানি। তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমি একদম কষ্ট পাইনি। শুধু আনন্দ পেয়েছি। সেই তোমাকে শেষ দেখা। তারপর সূর্যকে দুইবার প্রদক্ষিণ করেছে
পৃথিবী।

এইতো কয়েকদিন আগে, পার্টি অফিস থেকে বের হয়ে দেখি, শরীফ দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রতা সুলভ কথাগুলো শেষ করে, তোমার কথায় আসল। সে তোমার জন্য সারা জীবন অপেক্ষা করবে। তোমাকেই ঘিরেই তার স্বপ্ন, সব চাওয়া। আসল কথায় আসি। শরীফের মা খুব অসুস্থ। তিনি বোধ হয়, বেশিদিন বাঁচবেন না। মৃত্যুর আগে ছেলের বউ দেখে যেতে চান। তোমার চিন্তায় তোমার আম্মাও তো খুব অসুস্থ। একবার চিন্তা করে দেখ, দুইজন অসুস্থ মায়ের মুখে তুমি হাসি ফোটাতে পার। অন্তত পক্ষে
দুইজন বৃদ্ধ মাকে শান্তিতে মরতে দাও। শরীফ তোমার বন্ধু ছিল, আমারও।

শরীফের মা আমাদের আদর করে কত কি না খাইয়েছেন। তোমাকে তিনি কত আদর করতেন। এর সব কিছুই কি ভুলে গেছ। তার কোন মূল্য তোমার কাছে নেই। একবার ভেবে দেখ। তুমি চাইলেই নিজের জীবনটা সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিতে পার। পৃথিবীর প্রতিটি সুন্দর, শুধুই তোমার জন্যই অপেক্ষা করছে। আগামীকালের সকাল তোমার সুন্দর জীবনের অপেক্ষায়। প্লিজ আর আমাদের কষ্ট দিও না। শরীফকে বিয়ে করে ফেল। আমি একাই পথ চলতে পছন্দ করি। দু-বেলা পেট ভরে খেতে পাই না। তার চেয়ে বড় কথা, কখন কোথায় থাকি ঠিক নেই। কখনো জেলে থাকতে হয়, কখনো পালিয়ে বেড়াতে হয়।

আমার এ পৃথিবীর কাছে কিছুই চাওয়ার নেই। শুধু একটাই চাওয়া, এ নোংড়া সমাজটাকে সুন্দর করে গড়া। সুন্দর এক পৃথিবীর দিকে ছোটে চলা। জানি আমাদের মত কতগুলো অর্থব এ সমাজ বদলাতে পারবেনা না। তবু আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাব। বারবার। যতদিন বেঁচে থাকব। যতদিন না একটা সুন্দর পৃথিবী পাব। আসা করি। সিদ্ধান্ত নিতে তুমি আর কোন ভুল করবে না। কতগুলো মানুষকে কষ্ট দিবে না। যারা তোমাকে খুব ভালোবাসে।

অপদার্থ কাঞ্চন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।