ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

পাণ্ডুলিপি থেকে সফেদ ফরাজীর একগুচ্ছ কবিতা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১২
পাণ্ডুলিপি থেকে সফেদ ফরাজীর একগুচ্ছ কবিতা

প্রথম দশকের কবি সফেদ ফরাজী। একুশে বইমেলায় এসেছে তার প্রথম কবিতার বই ‘উন্মাদ পিয়ানোর কম্পন’।

বইটি প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য প্রকাশনী। সফেদ ফরাজীর পাণ্ডুলিপি থেকে বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো একগুচ্ছ কবিতা।


উন্মাদ পিয়ানোর কম্পন



কত না আড়াল তুমি পুষে আছো অন্তরবিহারে।

এইবার চোখ খোলো, তাকাও-- কাছে-দূরে কোথাও
তোমারই হারানো দেহ, নিথর পড়ে আছে যেন
পথের ধুলোয় রক্ত ও লালা ঝরছে। শিয়রে
নিঃস্বকালো সর্পরানি ফণা তুলে
দুলছে আনন্দে।

দূর থেকে দেখছে ভীরু, চতুর ও সংশয়বাদীর দল।
এই স্রোতের ভেতর হয়তো মিশে আছো তুমিও
কারও পিঠে হাত রেখে, উঁকি দিয়ে-  যেভাবে মানুষ
চিরকাল শুধু দেখার কাজটুকু সেরে চলে যায়

অনন্ত কালোর সংকেতে, যখন নিভে আলো
সেই পথে, হারানো আত্মার গান, উড়ে উড়ে
যেন নিজেকেই খুঁজে ফেরে, চুপিসারে, অবেলায়।


প্রেতের হাসির মতো দিন এসে ভাঙে শুধু মনের উড়াল।

কুহকতাড়িত সমাধিফলক অনিশ্চিত লক্ষ্যে লাফ দেয়
তুমুল ধ্বংসের শেষে- সমস্ত মদ ও মদিরার ঘোর থেকে
টুকরো টুকরো আগুনের চোখ প্রবল গর্জনে, পুনর্বার
অগ্রন্থিত বেদনার সংগ্রহশালায় ঢুকে পড়ে;
 
যেন বা জীর্ণ নক্ষত্রের পাশে অতিকায় জন্মান্ধ প্রেম
ছেঁড়া পৃষ্ঠার মতো নামহীন স্মৃতির করতালি আর নীল পায়রা   
বহন করে চলে, ভেতরে অসংখ্য চিতা!



ঘুরেফিরে মৃত্যু, কেবলই মৃত্যুর কথা মনে আসে
নিজের পরিবর্তে অন্য এক ছবি ভেসে উঠতে দেখি
আয়নায়-

তাই আয়না ছেড়ে এখন পথে পথে ঘুরি
বনশিশুদের ভেতর খুঁজি আমার প্রতিচ্ছবি

দেখি, অন্ধকারের দিকে চলে যায় কিছু মানুষ
কিছু মানুষ কেবলই সন্দেহ-চোখে তাকায়
 
একটা বোবা বালক আমার দিকে কখনো তাকায় না
সে-ই সম্ভবত জানে,
পথে পথে আমি যে এক মৃতের আত্মা!


ডুবসাঁতার

অনেক দুঃখের দিন শেষে, প্রকৃত গানের
মর্ম বেজে ওঠে- উন্মাদের বর্মের নিচে
উত্তুঙ্গ কোলাহলে, হারিয়ে যাওয়া কোনো ভোর
দগ্ধ প্রাণে, এ সুর শুনতে পায়;

তখন বিষাদ-পাহাড়ের গায়ে রহস্যে বিভোর
ঝড়ের গোপন পৃষ্ঠা
নিজেকেই মেলে ধরে;

কফিন ও চাকু ঝরে
আকাশ থেকে,

নিশিকালে!  


আয়না রঙিন

সমস্ত ধ্বংসের পর অবশিষ্ট কী বা থাকে আর?
বড়জোর একটা দীর্ঘশ্বাস, একা একাই ঘুরেফিরে
নিজের ছায়ার কাছে নিজেই হাস্যাস্পদ হয়ে ওঠে।

করুণাঘেরা দেবমন্দিরের ভেতর এত মিথ্যাচার
এত ভ্রম ও অহং নিয়ে চলছে জগৎ-যন্ত্র
আর একটা বোবা ঘড়ি, সময়-সংকেতহারা
যেন জড়িয়ে দিচ্ছে সাপলুডোর জাল

পথে-প্রান্তরে, চিন্তার ক্যানভাসে
কত চোখ, কোলাহল, স্তব্ধতা-
কে জানে, কে আসলে কোলাহল, কে যে স্তব্ধতা
কার ভেতর উড়ছে
একটা কাল সাপের ফণা,
পাশাপাশি একটা পাগলের হাসি- রক্তাক্ত
                      অথচ উজ্জ্বল


মাটির হারমোনিয়াম

প্রতিটি পথের বাঁকে গোপন এক আশ্রম থাকে।
   
আধো নীল অতীত থেকে দেখছে কেউ অখিল অন্তরালে
বয়ে যাওয়া কুঙ্কুম, মুখশ্রী
সূর্যরথে- ছদ্মবেশী মিত্রের কটাক্ষে ভরা

নক্ষত্র-ছাই উড়ছে
শকুন গাইছে



স্বর্ণখনির গুঞ্জন ঘিরে প্রেতের জীবন
হাস্যকর
শুধু ক্ষুধা, চুম্বনের মহার্ঘ পুস্তক
চন্দ্রযান

ওড়ে সুর, পরিভাষা ফেলে, কুয়াশার দিকে
আত্মবিস্মৃতকালে অসংখ্য বকুল ঝরে
মৌন হয় চরাচর

আর শুধু সন্ধ্যা নেমে আসে বকুলের রক্তের ভেতর



সন্ধ্যাতারার সংসার

সন্ধাতারার সংসারের ভূমিকা কবিতা

যার জীবনে ভোর আসেনি, সে-ই একদিন গভীর অভিমানে সন্ধ্যাতারা হয়ে যায়। অনন্ত আঁধারে, চূর্ণ-বিচূর্ণ তার পাঁজরের হাড়, কোথাও চুপচাপ পড়ে থাকে, জšে§র আকাক্সক্ষা নিয়ে, প্রহেলিকাভরা আলোকলতায় ।

সেই হাড়, সেই অভিমান ঘিরে নেমে আসে মরুঝড়; যেন জল্লাদের হাসি, জড়ায় তীর্থ ও সুরের মন্দির, যেন জগৎজুড়ে সারাবেলা হেমনর্তকী নাচে।  
 
স্বপ্নের ভেতর যে থাকে, বিস্মৃতির আড়ালে- যে পারে না অন্যের রক্ত ঠুকরে বানাতে নিজের পথ; সে কি খুঁজে পায় সূর্যদ্বার, সেই নতর্কী, বসন্তের মধুর অঙ্গার?



যখন নিজের বলে আর অবশিষ্ট থাকে না কিছুই, তখন একুশ চোখঅলা বাস্তবতার সঙ্গে দেখা হয়; যার বুকের ভেতর সাত সমুদ্রের আর্তনাদ বিউগলের মতো বাজে- সে-ও চায় আশ্রয়।    
 
বুঝি, উন্মাদ ঝড়ের ইশারায় আলো সরে যায় দূরে, সহসা সন্ন্যাস উড়ে আসে, এ-জীবন স্বপ্নে অজস্র আকাশ যেন তারই পাপড়ি খুলে দিয়ে যায়--  আর সেই পথে জেগে ওঠে সর্বনাশের চোখ, নৈঃশব্দ্যের অস্তিত্ব ঘিরে, রয়েছে অরব

যে মুহূর্ত অনন্তের রক্তের দহন, তার ফাঁকে, কার হৃদয় চুইয়ে পড়ছে কালচে রাজহাঁস, ঝরনাজলে, ড্রাগনের পিঠের ওপর।


কোথাও জেগে উঠছে মর্মর, পতনের। ফেলে আসা পথে যেন মায়ার পরাগ-- চিরজাগরূক, শাদা; তাই, বিস্মৃতির পাহাড় ডাকে, গোপনে একা হতে বলে। চিন্তার ভেতর কারও মুখচ্ছবি ঘোরে, আর শুধু গোধূলি হয়ে যায়।

যখন উল্কাবৃষ্টিতে সূর্যাস্তের সঙ্গে দেখা সেরে নেয় অচিন বিড়াল, নীলে বিধ্বস্ত প্রদীপ চুপচাপ জ্বলে, খেলাঘরে-- পানপাত্র হাতে ভূতগ্রস্ত দাবদাহে নরখাদকের গান;

তখন ফুলগিরি নদীর তীরে বালিতে একা ডুবন্ত ছায়ামূর্তি, তার ভাবনার সঙ্গে কাটাকুটি খেলে, জলে ছোড়ে দেহশয্যা, সর্বশেষ নাকছাবিটির কথাও ভুলতে চায়, কিন্তু পারে না। সেই অক্ষমতার নিচে, অশ্রুদাগে, যেন নিশ্চুপ বসে থাকে অন্ধ ও নির্বোধ হাঁসের হৃদয়।


জগতের সকল সর্বনাশের জন্ম আসলে বর্ষায়-- সমুদ্রের ঢেউয়ে মিশে যাওয়া বন্ধুর অভিমত ছিল এই। বহুদিন পর সমুদ্র তীরে, বালির ওপর পড়ে থাকা এক বিষণ্ন কৃষ্ণচূড়া দেখে ভাবছি, তার জীবনেও কি এসেছিল কেউ? সমুদ্র যেভাবে তারাদের কাছে ডাকে, কেড়ে নেয় সোনার মাস্তুল, সেইভাবে

সব পথ আজ মিশে গেছে কাঁটাবনে। কাদের বিলাপ যেন ভেসে আসে, কালো বৃষ্টির ধারায়; তবু বাতাসে উড়ছে আদিম রক্তের উপত্যকা, বিষণ্ন বনমালী, অবহেলায় স্তব্ধ পুষ্প যেখানে রঙিন  

অন্ধকারে ভাঙা ডানা, ছিন্ন মুণ্ডু আর গোপন ক্ষতের নিচে যেন আশ্চর্য বর্ষাকাল কারও অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে।    


অধিকার হারিয়ে গেলে তুমিই সেই অতিরিক্ত মানুষ, যার সকল দুয়ার ভাঙা-- অন্তরে সন্ন্যাস ওড়ে; সুখস্মৃতি-- মৃত্যুপথগামী।

তোমারও গান ছিল, গানের ভেতর জেগে ছিল ঢেউ, যত প্রেম মাটি, বাতাস যেখানে নীল।  

বুঝি, পুরোনো পাথর মুছে আঙুরবাগান ছেড়ে জল্লাদের বনভূমির ওপর দিয়ে দূর কোনো প্রতিফলনের পিছু পিছু উড়ে যাওয়াই ধর্ম এই জীবনের-- পাতা ঝরার শব্দে যেখানে দূরত্বজ্ঞান লোপ পায়, আর কাটা পড়ে অতীত বৈচিত্র্যের মার্জিন, নির্বিকার।


তবু একই মানুষ তিন মানুষের রূপ নিয়ে তিন পথে হাঁটে, তিনটি বাড়ির দিকে অর্থাৎ তিনটি সর্বনাশের দিকে, তিনটি পরিচয় তার-- তাকেই অনুসরণ করে ধূসর প্রতিমাকুঞ্জ, সূর্যদ্বীপ ও মাতাল গানের বিকাশ।  

প্রতি রাতে তার সঙ্গে আমার দেখা হয় ভগ্নপ্রায় এক মন্দিরফটকে। যেখানে সমস্ত পিছুটান ঝলসে ওঠে কোনো ঝুলন্ত পলেস্তারার দীর্ঘশ্বাসে। মুচকি হেসে, সে শুধু আমাকে তাকাতে বলে তিন পাল্লা জানালার দিকে, ওই পথ দিয়ে নাকি উড়ে আসে জগতের সব রহস্য খোলার চাবি; অথচ সেই পথে আমি দেখি, ঈগলের অশান্ত চোখে হরিণ উড়ছে।  

তবে কি বিঘ্নিত অতীতের ওপর দিয়ে, বিস্মৃতির ওপর দিয়ে শুধু ছায়াটুকু ফেলে আমিই পেরিয়ে গেছি আমাকে, সুদূর।    


বেদনা, বেহাগ বুকে যেসব কামনা ঝরে, নয়নতারা গাছের নিচে-- তার অনুবাদক তুমি ও ধূসর প্রজাপতি। তোমরা কেউ কাউকে জানো না, অথচ এক হও, হাসো, দাঁতে কাটতে চাও অস্থির পৃথিবীর মুণ্ডু।  

কিন্তু পৃথিবী যে চোরা ফাঁদে ঢাকা। তাই, রক্তঝড়ের দিকে ছোড়া তীর শুধু ফিরে আসে-- পরিচয় কী হে, কাকে বলে প্রেম, কেনই বা মরণের ওই পারে দেখা যায় উড়ন্ত বেশ্যামূর্তি-- জানতে চায়।

তখন দূর থেকে কে যেন বলে, জানো তো, যতদূর সম্পর্ক, ততদূর মায়া...


বাংলাদেশ সময় ১৬১২,  ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad