ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

বাংলানিউজের গোলটেবিল (শেষ পর্ব)

লেখক-প্রকাশকদের পাশে থাকবে বাংলানিউজ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১২
লেখক-প্রকাশকদের পাশে থাকবে বাংলানিউজ

বাংলানিউজের গোলটেবিল (পর্ব-১)

ফেব্রুয়ারি বইমেলাকে সামনে রেখে ২১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বাংলানিউজে কয়েকজন তরুণ প্রকাশক ও লেখককে নিয়ে আয়োজন করেছিল এক অনলাইন গোলটেবিল বৈঠক। আলোচনার বিষয় ছিল ‘বইমেলা এবং প্রকাশনাশিল্পের সংকট ও সম্ভাবনা’।



গোলটেবিল বৈঠকিতে অংশগ্রহণকারী প্রকাশকরা হলেন--- পারভেজ হোসেন (কথাসাহিত্যিক, প্রকাশক, সংবেদ), সাঈদ বারী (প্রকাশক, সূচীপত্র), রবীন আহসান  (প্রকাশক, শ্রাবণ), আহমেদুর রশীদ টুটুল(প্রকাশক, শুদ্ধস্বর) ও খন্দকার সোহেল(প্রকাশক, ভাষাচিত্র)।

এছাড়া কবি, লেখক-সাহিত্যিকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন--- জুয়েল মাজহার (কবি-অনুবাদক, কনসালট্যান্ট এডিটর, বাংলানিউজ),শামীম রেজা (কবি ও সাহিত্য সম্পাদক, কালেরকণ্ঠ),মাহমুদ মেনন (চিফ অফ নিউজ অপারেশন্স, বাংলানিউজ), সাখাওয়াত টিপু (কবি ও প্রাবন্ধিক), ফেরদৌস মাহমুদ (কবি,শিল্প-সাহিত্য সম্পাদক, বাংলানিউজ), রানা রায়হান (অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর, বাংলানিউজ) ও শেরিফ আল শায়ার (গল্পকার ও ব্লগ এডিটর, বাংলানিউজ)।

আলোচনায় উঠে আসে বইমেলা ও প্রকাশনা শিল্প-সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়। বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো সেই গোলটেবিল বৈঠকের শেষ পর্ব।
সঞ্চালক : ফেরদৌস মাহমুদরানা রায়হান
   

বাংলানিউজ: শুদ্ধস্বরের টুটুল ভাই তো দীর্ঘ সময় ধরে প্রত্যেকের কথাই শুনলেন। এবার এ বিষয়ে আপনি আপনার কথাটা বলুন....

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012January/ahmedur rashid tutul 220120131224708.jpgআহমেদুর রশীদ টুটুল : ধন্যবাদ বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোরডটকমকে। আসলে এসেছি বলেই বলতে হচ্ছে। না বললে কেমন হয়? যা বলার সবই বলা হয়ে গেছে। আর বলতে গিয়েও আমি বিব্রতবোধ করছি। কারণ আমি যা এখন বলব সেটা গত দু’তিন বছর ধরেই বলছি। এভাবে বারবার বলায় আসলে শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়ায়, কি থাকে, আমার বোধগম্য হয় না।

এখানে অনেক বিষয় এসেছে। প্রথমে প্রকাশনা শিল্পের সম্ভাবনা আর সংকট নিয়ে কথা হলো। এটা সত্য কথা প্রকাশনা এখনও আর্ট অর্থে যে শিল্প তাকে ধরেই এগোচ্ছে। এটা এখনো ইন্ডাস্ট্রি পর্যায়ে এখনো এগোতে পারেনি। এটা না পারার যে কারণ, তা হলো--- আমাদের সম্পাদনা বোর্ড নেই, সিলেকশন বোর্ড নেই, আমাদের ওইভাবে মার্কেটিং নেটওয়ার্ক নাই--- এসবই একদম সত্যি কথা। এগুলি সবই আমাদের অযোগ্যতা বা অক্ষমতা বটে। এটা আমি স্বীকার করছি।

আসলে বইমেলা এলেই আমরা নড়েচড়ে বসি। এসময় মিডয়া, পত্রপত্রিকা স্রেফ একটা নিউজ আইটেম হিসেবে আমাদের ডাকে। মর্যাদাবান সত্ত্বা হিসেবে নয়।

বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে প্রিন্ট মিডিয়া এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইন মিডিয়া বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, শক্তি অর্জন করেছে। সমাজে সে শক্তির যে কার্যকারিতা আমরা লক্ষ করে আসছি তাতে আসলে আমার মনে হয়, আমরা যে সংকটগুলো চিহ্নিত করে আসছি বছরের পর বছর ধরে এই সংকটগুলো উৎরাতে মিডিয়া ভূমিকা রাখতে পারে। এবং সেটা যদি তারা তাদের সামাজিক দায়িত্বশীলতার পর্যায়ে থেকে বিবেচনা করেন, তাহলে আমার মনে হয়, বাংলাদেশের বইয়ের যে বাজার, পাঠভ্যাস কমে যাওয়ার যে ব্যাপার, প্রযুক্তিকে রেখেই এগুলিকে বাড়ানো ক্ষেত্রে মিডিয়াগুলো ভূমিকা রাখতে পারে।

তারা যদি সামাজিক দাযিত্ববোধের পর্যায়ে থেকে শুধুমাত্র এ দায়িত্বটুকু পালন করে আমি মনে বাংলাদেশের পাঠক অনেক বেড়ে যাবে।

এক বছরের একটা কর্মসূচি যদি দু্ই-তিনটা মিডিয়া নিতে পারে যে, আমরা সামাজিক দাযিত্বের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের পাঠক বাড়াবো, মানুষকে পাঠভ্যাসমুখী করে তুলব,তবে এটা সম্ভব। এর মাধ্যমে বিভিন্ন মিডিয়া আজকাল অনেক সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হচ্ছে।  

তারা এসিড ছোড়ার বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন করছেন, তারা ড্রাগের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন করছেন, তারা এরকম আরও নানারকমে বিষয়ে স্লোগান দিচ্ছেন, তারা বদলে দেয়ার কথা বলছেন। আসলে তরুণ সমাজকে যদি পাঠের দিকে নিবিষ্ট করা যায়... এই বদলে দেয়াটা অনেকখানিই সম্ভব। এটা আমি বিশ্বাস করি।

এক্ষেত্রে মিডিয়াগুলো ভূমিকা রাখতে পারে। আজকে আমাদের যে মিডিয়া কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাদেরকে আমি বলব, শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারির আইটেম হিসেবে নয় তারা সারা বছরব্যাপী এরকম একটা টার্গেট নিয়ে যদি কাজ করেন এবং বইয়ের বাজার সৃষ্টিতে যদি একটু ভূমিকা রাখতে পারে, মানুষকে যদি পাঠের দিকে একটু আগ্রহী করা যায় তাহলে আমাদের প্রকাশনা নিয়ে যে সংকট রয়েছে তা অনেখানিই কাটবে।

এরপর আমি আসছি বইমেলা নিয়ে। বইমেলা এলেই আমাদের কিছু প্রকাশকের এমন কিছু সংকট তৈরি হয়, যেটা নিয়ে একধরণের মানসিক টেনশন, আর্থিক একধরণের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। এছাড়া যখন আমরা বইপ্রকাশ করার একেবারে দোরগোড়ায় থাকি তখন আমরা বাংলাএকাডেমীর স্টল পাব কি-পাব না, কোথায় পাব... কেমন করে পাব... আমি আমার যোগ্যতা অনুযায়ী পাব কি-না... সেটা নিয়ে টেনশনে থাকি.... সেটা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি... তদবির...কতো কি!!

গত কয়েক বছর ধরে বাংলাএকাডেমীর বইমেলায় অংশগ্রহণ করে--- আমি এখনো বুঝিতে পারি নাই আমরা যে ফরমটা প্রথমে আনি, সেখানে যে নীতিমালাটা লেখা থাকে সেটার দরকার কী আসলে। সে নীতিমালায় যা লেখা থাকে, যে ক্রাইটেরিয়ার কথা লেখা থাকে আমি সে অনুযায়ী ফরমটা ফিলাপ করি, আমি আমার সাপর্টিং পেপারগুলো জমা দেই তবে কেন আমি আমার যোগ্যতা অনুযায়ী স্টল পাই না? আমার চেয়ে কম যোগ্যতা নিয়ে কেউ কেউ আমার চেয়ে ভালো স্টল পেয়ে যায়, আমি ঠিক বুঝি না এর পেছনের কারণ কী?

আমি মনে করি প্রকাশক হওয়ার জন্য একটা সিস্টেমের মধ্য দিয়ে আসা উচিৎ। অথচ এখানে যে কেউ চাইলেই প্রকাশক হতে পারে.....

আমার মনে হয়, প্রকাশকদের সমিতিটা খুব বড় করে সংগঠিত করা দরকার। এতে করে প্রকাশক নামধারী যেসব বইয়ের দোকানি মেলাকে কলুষিত করে সেগুলো দূর হবে। সমিতি কিন্তু পারে একজন লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে কি চুক্তি হবে, কিসের ভিত্তিতে আমরা বই প্রকাশক করব তা নির্ধারণ করতে। আমাদের বইয়ের ক্ষেত্রে একটা মানদণ্ডতো দাঁড় করাতে হবে।

ঠিক তেমনি কোন ধরণের বই প্রকাশ করব বা করব না, এটাও নির্ধারিত হবে। চার-পাঁচ হাজার বই প্রকাশ করা হয়, তারপরও আমরা আক্ষেপ করি বই কোথায়। লেখক নিয়ে আমরা আক্ষেপ করি। তবে এধরণের ব্যাপার যদি ঘটনো যায় তাহলে উচ্ছিষ্টদের সংখ্যা (বাজে ও অসৎ প্রকাশক) অনেক কমে আসবে। এক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব অনেক বাড়বে। সম্পাদনা করা, সম্পাদক তৈরি করা, প্রুফ রিডিং এবং একটা দীর্ঘ সময় নিয়ে মান সম্পন্ন বই তৈরি করার যে ব্যাপার, এর সবই তৈরি হবে। এখন পুরোপুরি একজন লেখক ও প্রকাশকের ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপরে আমাদের বই হয়। এতে যে সমস্যা হয়, লেখক তার সুবিধাজনক সময়ে বই দেয়... এতে কিন্তু ঝামেলার তৈরি হয়।

বাংলানিউজ : ‘সূচীপত্রে’র সাঈদ বারী ভাই কিছু বলুন।

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012January/Sayed Bari20120131225720.jpgসাঈদ বারী : প্রথমেই প্রকাশনাশিল্পের কথা বলি। আমি নিজে প্রায় ৭০০ বই প্রকাশ করেছি.... তবু আমি এখনো সংকটের মধ্যেই থাকি। এই সংকটটাকে আমি একার সংকট মনে করি না, এটা আমাদের সমগ্র প্রকাশনারই সংকট। আমাদের স্বাধীনতার এত বছরেও এখানে এখনো প্রকৃত রিডিং সোসাইটি (পাঠকসমাজ)গড়ে ওঠেনি। আমরা ধরেই নিই যে, বই মানে গল্প-উপন্যাস...। আমার কথা হলো সবাই সাহিত্য পড়বে সেটা আমি মনে করি না। আমি একজন ব্যাংকার ব্যাংকিংয়ের বই খুঁজব, আমি হয়ত গার্ডেনিংয়ের উপর বই খুঁজতে পারি... আমি ভ্রমণপিপাসু ভ্রমণের উপর বই খুঁজতে পারি। সেটা কিন্তু এদেশে নাই। এখানে সবই শুধু গল্প আর উপন্যাস।

রিডিং সোসাইটি গড়ে তোলার জন্য এই রাষ্ট্রের সমাজের একটা ভূমিকা দরকার ছিল। আমি নিজেও অনেক রকমের বই করার চেষ্টা করি। ফলে কোনো বই করলে যদি টাকাটা না উঠে আসে, অপর কোনো ভালো বই দিয়ে হয়ত সেটা ওঠানো সম্ভব হয়।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, কোনো একটা বইও আমি হাজার-বারোশোর বেশি ছাপাতে পারি না। কোনো কোনো বই আমি ৩০০ কপিও ছাপি। এখন কথা হলো ৩০০ কপি ছেপে কিভাবে চালান ওঠানো সম্ভব? বইমেলায় আমরা বিজ্ঞাপনের যে সুবিধা পাই এটা সারা বছর পেলে ভালো হতো। আমি মনে করি চুক্তি না করে কোনো লেখকের উচিত না নিজের পান্ডুলিপি দেওয়া।

বইমেলায় যেটা দেখি মিডিয়া খুব পপুলার লেখকদের ফোকাস করে। যারা রিপোর্ট করে তারা যেন হাতে গোনা ওই কয়েকজন লেখকদের নামই জানে, অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখক আছেন তাদের চেনেই না। তাদের কাজ যেন ওই কয়েকজন লেখকের নামই ঘোষণা করা। আমি হয়ত আদিবাসী নিয়ে লেখা কোনো লেখকের বই ছাপলাম। কিন্তু তাকে নিয়ে কিন্তু কোনো মাথাব্যাথা নেই মিডিয়ার। মিডিয়ার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের লেখক যেন হাতে গোণা। এই বিষয়টা আমার ভালো লাগে না।

এদিকে যদি তথ্যকেন্দ্রের দিকে যদি তাকাই, সেখানকার অবস্থাও তো ভালো না। প্রতিদিন প্রায় ২০০-৩০০ বইয়ের নাম ঘোষণা করা হয়। এই যে নাম ঘোষণা, এক্ষেত্রে কোনো বাছবিচার নেই। এ বিষয়টা আমার কাছে আদৌ যুক্তিসঙ্গত মনে হয় না।

আমি দেখেছি, বাংলা একাডেমীর তথ্যকেন্দ্রে আগে বসতেন রশীদ হায়দারের মতো গুণী লোক। এখন যারা তথ্যকেন্দ্রে বসেন বাংলা একাডেমীর তারা যেন ভাড়া করা। এক্ষেত্রে কোনো কোনো লেখকের বই হয়ত বের হয়েছে পাঁচ দিন আগে কিন্তু তা ঘোষণা চলছে সারা মাসব্যাপী। আমার তো মনে হয় এখানে তথ্যকেন্দ্র চালানোর মতো যোগ্য লোকই নাই। এ বিষয়টারও পরিবর্তন হওয়া দরকার।

বাংলানিউজ : এবার সংবেদ প্রকাশক পারভেজ ভাই বলুন....

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012January/parvej hossen20120131224922.jpgপারভেজ হোসেন : ধন্যবাদ সবাইকে । আসলে কথা এত হয়েছে... এর মাঝে আবার নতুন করে কি বলব আমি জানি না। বোধ হয় তেমন কিছু বলতে পারব না... কথার পুনরাবৃত্তি হতে পারে।

আমার একটা প্রশ্ন হচ্ছে আজকে আমরা যে এসেছি, এতজন লোক, এই যে আলোচনা অনেকক্ষণ ধরে করলাম, আমরা আমাদের ক্ষোভের কথা বললাম, আমরা আমাদের ব্যর্থতার কথা বললাম, আমরা কিভাবে ব্যর্থতা থেকে উত্তরণ হতে চাই সেসব আলোচনা হলো।

কিন্তু আজকে বাংলানিউজ আমাদের কেন ডেকেছে? ডেকেছে কারণ সামনে আমাদের একটা উৎসব আছে। যেটা
আমাদের জাতীয় উৎসব, যে উৎসব একমাসব্যাপী চলে, অসংখ্য মানুষ সে উৎসবে সামিল হয় সেই উৎসবটা উপলক্ষে। তো ৫২-এর ভাষা আন্দোলন আমাদের কাছে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। সেই ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে, সেই ভাষা আন্দোলনকে সামনে রেখে--- যেটা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমরা পালন করি একই সঙ্গে, সেটাকে কেন্দ্র করেই কিন্তু এই বইমেলাটা।

এই বইমেলাটা কিন্তু বইয়ের বাণিজ্যমেলা নয়। আজকে আমাদের আলোচনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে যে, বইয়ের ব্যবসা বাণিজ্যের যে ব্যাপারটা, লেখকের সঙ্গে প্রকাশকের সম্পর্ক কেমন হবে, কে রয়্যালিটি পেল কিংবা পেল না, বইয়ের মান কেমন হলো কি হলো না, বইয়ের সম্পাদনা কেমন হবে--- নানান রকমের কথা এসেছে। কিন্তু আমাদের মূল জায়গা কিন্তু তা নয়... আজকে যে মিডিয়া আমাদের ডেকেছে সেটা পুস্তক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে কিন্তু নয়।

এখানে আমাদের ডাকা হয়েছে একুশের চেতনাকে সামনে রেখে বিশাল বইউৎসবে সকলের সামনে তুলে ধরার ইচ্ছে নিয়ে।

আমি তো স্বপ্নে দেখি সারা পৃথিবীর ইতিহাস যেমন আমাদের ভাষাআন্দোলনের ঘটনাকে যেমন সম্মান জানিয়েছে... তেমনি আমাদের দেশে যে মেলা হয়, এখানে এর সঙ্গে সমান একটি ব্যাপার একুশের বইমেলা।

সাখাওয়াত টিপু : বই মেলা নিয়ে আমি দুটি সাজেশন দিতে চাই, নামেমাত্র মূল্য হলেও বইমেলায় যাতে টিকিটের ব্যবস্থা করা হয়। আমার মনে হয় এ ব্যবস্থা করা হলে একটা দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হবে।
 
আরেকটা বিষয় হলো এক মাসের বইমেলাকে ভেঙে এই মেলাকে বিভাগওয়ারি করা যায় কি-না। ঢাকায় ৭ দিন, অন্য বিভাগে ৭ দিন--- এভাবে যদি করা হয় তাহলে তো ভালো হত। কারণ বিভিন্ন জায়গায় পাবলিক লাইব্রেরি আছে বিভাগওয়ারি... ওরা চাইলেই কিন্তু এ আয়োজন করতে পারে।

সাঈদ বারী : মেলাটাকে যদি ১২দিন বা ১৫ দিনের মধ্যে আনা যায় তাহলে আমার ধারণা লেখক ও প্রকাশকদের মধ্যে আরও প্রফেশনালিজম তৈরি হবে । সবার ধারণা বইমেলা যত বেশি দিন হবে তত বেশি বই বিক্রি হবে, এটা খু্ব ভুল ধারণা। আমার কথা হলো, বই যা বিক্রি হওয়ার ওই ১২-১৫ দিনের মধ্যেই হবে। আমাদের প্রকাশকদের কারও কারও ধারণা আছে... যে বইমেলা ৪৫ দিন হলে হয়ত আরও বেশি বিক্রি হবে। বিষয়টা কিন্তু এরকম না।

আহমেদুর রশীদ টুটুল :  তবে আমার কথা হলো, একুশে বইমেলার চেতনাগত যে ব্যাপার সেটা আসলে অক্ষুণ্ন রাখা দরকার। সেক্ষেত্রে বাংলা একাডেমীতেই এ মেলাটা থাকা উচিত...। কারণ এ মেলার সাথে অন্য একটা ব্যাপার জড়িত আছে... এ বইমেলাকে কেন্দ্র আমাদের সাংস্কৃতিক বিবর্তন ঘটেছে... অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ঘটেছে... মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন... স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন কিন্তু এ মেলাকে কেন্দ্র করেই অনেক বেশি সংগঠিত হয়েছে, সেদিকও মনে রাখতে হবে।

সে হিসেবে এ চত্ত্বর থেকে মেলাকে বের করে নিলে এগুলোর সাথে যে সংযোগটা তা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। যে মানুষগুলো আসে সবাই কিন্তু বই কিনতে আসে না, এটা তো আমাদের কথা থেকেই বের হয়ে এসেছে। তারা কিন্তু প্রাণের টানেই আসে... এই সংযোগটা রাখতে হবে, সংস্কৃতির এই সংযোগটা।

রানা রায়হান : বাংলা নিউজের পক্ষ থেকে সবাইকে শুভেচ্ছা এই আড্ডায় অংশ নেয়ার জন্য। আমরা বইমেলার বিশেষ পাতা করতে যাচ্ছি.... প্রকাশনা সংস্থাগুলোর কোন বই বেরুচ্ছে, প্রকাশনাগুলোর স্টল নম্বর, তাদের বইগুলোর আলোচনা-পর্যালোচনা ইত্যাদি সে পাতায় থাকবে। আশা করছি এক্ষেত্রে আপনাদের যে কোনো ধরনের সহযোগিতা আমরা পাবো।

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012January/menon20120131225147.jpgমাহমুদ মেনন : এতক্ষণ যারা আলোচনা করেছেন তারা বই ও বইমেলার নানা প্রসঙ্গ নিয়েই বলেছেন। তাদের প্রত্যেকের কথাতেই উঠে এসেছে বাংলা একাডেমীর বইমেলা এক হিসেবে যতখানি আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারত তা কিন্তু হচ্ছে না। তারপরও আমরা সেখানে কেন ভিড় করি? কারণ, এর বিকল্প কিছু আমাদের নাই! তবু আমরা বাংলানিউজের পক্ষ থেকে চাই বইমেলাকে সফল করার জন্য যতখানি প্রচার, যতটুকু সহায়তা করা সম্ভব তা করতে। বাংলানিউজের পক্ষ থেকে আমরা যেটা বলতে পারি--- বইকে, বইপাঠকে জনপ্রিয় করার জন্য, বারী ভাইয়ের কথা অনুযায়ী রিডারগ্রুপ বাড়ানোর জন্য অনলাইনের পক্ষ থেকে যে কোনো ধরণের সাহায্য করতে আমরা প্রস্তুত। অনলাইনের পক্ষ থেকে যে কোনো ধরণের সাহায্য করার জন্য আমরা প্রস্তুত রয়েছি।

আমাদের মধ্যে এখনো বিজ্ঞাপন নিয়ে ভাবনা নেই। আমাদের মধ্যে ভাবনা আছে, বইমেলাকে আমরা প্রজেক্ট করতে চাই এবং হাজারো পাঠকের মধ্যে আমরা বইটাকে পৌঁছে দিতে চাই। ফলে আপনাদের বইয়ের প্রচারের জন্য আমরা সহায়তা করবো। আমরা চাই ভালো বইকে সবার মধ্যে পৌঁছে দিতে।

এমনকি অনলাইনে কেউ যদি আপনাদের বই বুকিং দিতে চায়... আমরা সেক্ষেত্রে আপনাদের হেল্প করতে চাই। দেশের বাইরে থেকে যে কেউ আপনাদের বই কিনতে চাইলে সেটা বাংলানিউজের মাধ্যমেও যোগাযোগের ব্যবস্থা হতে পারে।

আমরা আপনাদের ভালো বইয়ের রিভিয়্যু এবং ভালো লেখা ছাপতে চাই। বই মেলার সময় একটি বিশাল জায়গা আমরা বইমেলার জন্য ছেড়ে দেব। অনলাইন হচ্ছে এমন একটা জায়গা এখানে দৈনিকের মতো কোনো লিমিটেশন নেই--- চাইলে বইয়ের প্রচার ও প্রসারের জন্য ইচ্ছে মতো জায়গা ব্যবহার করা সম্ভব। আমরা আপনাদের ভালো বইয়ের প্রচারের জন্য যে কোনো ধরণের সুযোগ দিতেই প্রস্তুত।

রবীন হাসান : আমরা আপনাদের দেওয়া যেকোনো সুযোগই গ্রহণ করতে প্রস্তুত। আমি    ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় গিয়ে দেখেছি কিভাবে অনলাইনকে বইয়ের প্রচারের ক্ষেত্রে কাজ   
লাগানো সম্ভব।

মাহমুদ মেনন : এবারের বইমেলা বাংলানিউজ একটু ভালোভাবেই উদযাপন করতে চায়...

বাংলানিউজ : আমরা এতক্ষণ প্রকাশনা শিল্প আর বইমেলা নিয়ে অনেক কথা শুনলাম। এবার জুয়েল ভাই, কবি জুয়েল মাজহার, এ বিষয়ে তার বক্তব্য দিয়ে আমাদের বৈঠকের সমাপ্তি ঘোষণা করবেন।  

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012January/jewel majhar20120131225157.jpgজুয়েল মাজহার : আই অ্যাম দ্য লাস্ট ম্যান। আসরের লাস্ট ম্যানের কথা আসলে কেউ শুনতে চায় না। যাহোক, দীর্ঘ সময়ের আলোচনায় এতো বেশি প্রসঙ্গ, এতো অভিযোগ, যুক্তি আর পরামর্শ উঠে এসেছে, যেগুলো আমরা বিচ্ছিন্নভাবে জানতাম। বিশদভাবে জানতাম না।

প্রকাশকদের যে এতো দুঃখ আছে, লেখকরা হয়ত সেটা জানেনই না; আর লেখকদের যে এতো মনোবেদনা, সেদিকে প্রকাশকদের মনোযোগ ততটা নেই। লেখক প্রকাশকদের বাইরে আছেন সরকারের লোকেরা, আমলারা, আছে বাংলা একাডেমী। আর আজ আলোচকরা, প্রকাশকরা বাংলা একাডেমীর অনিয়ম বা নিয়ম নিয়ে কথা বলেছেন, বঞ্চনার কথা বলেছেন, রাজনৈতিক প্রভাবের কথা বলেছেন, অব্যবস্থার কথা বলেছেন।

আমরা বাংলা একাডেমীর কাছে কি চাই? কেবল কি ঐতিহ্য চাই, নাকি চাই ঐতিহ্যের বিস্তারটাও? ঐতিহ্যের কথা বলে বলে একাডেমী ঐতিহ্য ভেঙে ভেঙে এতদূর এসেছে। মেলায় পাইরেটেড বই দেদারসে বিক্রি হতে দেখেছি। নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে ছফা ভাই (আহমদ ছফা)  আমার মতো, ব্রাত্য রাইসুর মতো বেশ কিছু তরুণ লেখককে সঙ্গে নিয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন--- বুকে কাগজের ব্যানার সেঁটে সারা মেলাস্থল ঘুরে ঘুরে। তখন কোনো লেখককে-প্রকাশককে তার সঙ্গে সুর মেলাতে দেখিনি, পাশে এসে দাঁড়াতে দেখিনি। একাডেমীকে এমন অন্যায় নিয়ন্ত্রণ করতে দেখিনি তখন। এখন সে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।

আমাদের বইয়ের সংখ্যা বাড়লেও মানের দিকটায় আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে, বৈচিত্র্যের দিকটায় পিছিয়ে--- ওপার বাংলার বইয়ের থেকে। যেটা শামীম রেজা বলছিলেন, সেখানকার বইয়ের পাণ্ডুলিপিতে কোনো ত্রুটি থাকলে সেটা দেখার উপযুক্ত লোক থাকে। তাদের একটা সম্পাদকমণ্ডলীও থাকে, বিভিন্ন বিষয়ে সেরা পণ্ডিতদের নিয়ে। তাদের অভিজ্ঞ প্রুফ রিডার থাকে। আমাদের এখানে লেখক পাণ্ডুলিপি জমা দিলেই সেটা যেনতেন প্রকারে ছেপে দেবার অভ্যেস অধিকাংশ প্রকাশকের। বইয়েরর পাণ্ডুলিপির কনটেন্ট কতোটা সমৃদ্ধ, মান ঠিক আছে কিনা  সেটা কতজন প্রকাশক দেখেন? যে পাণ্ডুলিপি জমা পড়লো সেটা আদৌ পুস্তক পদবাচ্য হলো কি-না সেটা দেখার কোনো ব্যবস্থা আমাদের এখানে নেই।

এটা কেন হচ্ছে, কারণ একটাই-- আমরা যতটা আবেগ তাড়িত, ততটা পেশাদার হতে পারিনি, অথচ পেশাদারিত্বের সঙ্গে না এগোলে এটা হবেই। কাঁচা আবেগের মৌসুমী ঢল আমাদের একুল-ওকুল ভাসাবে। কিন্তু মানসম্পন্ন একটি বইয়ের জগৎ আমরা গড়ে তুলতে পারব না। আর দশটা জিনিসের মতো বইওতো একটা পণ্য, একটা প্রডাক্ট। প্রডাক্টা ভালো না হলে মান সম্পন্ন না হলে রুচিবান পাঠক কেনই বা নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে এটা কিনতে যাবে? এটা মাথায় রেখে আমাদের চলতে হবে।

আর বাংলা একাডেমীর মেলা এখানেই রাখা হবে না অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হবে সে প্রসঙ্গে আসি। আমাদের আলোচনায় যা যা উঠে এলো তাতে এ ব্যাপারে কিছুটা ধারণা ও সুপারিশ পাওয়া গেল। ঐতিহ্যের কথা মাথায় রাখলে মেলা একাডেমীর ভেতরেই রাখতে হয়: আবার প্রকাশকদের সংখ্যা বৃদ্ধির দিকে দেখলে, অসহনীয় ভিড়বাট্টার দিকটা দেখলে বলতেই হয়, শুধু ঐতিহ্যের কথা বললে হবে না। বিকল্প স্থান সংকুলানের ব্যবস্থাও করতে হবে। অর্থাৎ মস্তিষ্ক ও হৃদয় দুটোকে নিয়ে, ঐতিহ্য এবং বাস্তবতা দুটোকে নিয়েই এগোতে হবে। মানুষের হাঁটা-চলার সুযোগ রেখে ভেতরে স্বস্তিকর স্পেস যাতে থাকে সে ব্যবস্থা করতে হবে। নিরপেক্ষ থাকতে পারলে, ব্যক্তিগত স্বার্থচিন্তা না থাকলে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে থাকলে সেটা করা যায় সহজেই। একটি বিশেষ মানদণ্ড ঠিক করতে হবে, যে মানদণ্ডে উত্তীর্ণ প্রকাশকরাই কেবল ভেতরে স্টল পাবেন। অর্থাৎ প্রকাশকদের ক্যাটাগরি করে দিতে হবে। যারা প্রথম বা দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে পড়বেন, অর্থাৎ মানসম্পন্ন বইয়ের প্রকাশকরাই ভেতরে স্টল পাবেন। বাকিদের জন্য আণবিক শক্তি কমিশনের ভেতরে, বাইরে রাস্তার পাশে বা উদ্যানে স্টলের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে বাংলা একাডেমীকে কেন্দ্রে রেখেই এটা করা যায়।

আর একাডেমীকে দেখতে হবে যেসব শর্ত তারা বেঁধে দেন সেটা সব প্রকাশকের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কি-না। বাস্তবে সেটা আমরা দেখতে পাই না। আসলে প্রকাশকরা যদি ঐক্যবদ্ধ না থাকেন বাংলা একাডেমীর অনিয়ম, বৈষম্য দূর হবে বলে মনে হয় না।   লেখকদের দূরে রেখে প্রকাশকরা নিজেদের অধিকার ও প্রাপ্য সম্মান আদায় খুব একটা করতে পারবেন বলেও মনে হয় না।

যাদের আপনারা প্রকৃত লেখক মনে করেন, হতে পারে সৈয়দ শামসুল হক, বা তরুণ ফেরদৌস মাহমুদ— সব গুণী লেখককে টানতে হবে। লেখকদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। যে গাছ ফল দেয় তাকে যত্ন না করলে তো হবে না। এখানে একটা দেয়া-নেয়ার ব্যাপার আছে।

লেখক-প্রকাশকদের মধ্যে সামাজিক একটা প্লাটফরম তৈরি করতে হবে। অর্থাৎ মানসম্পন্ন লেখকদের সাথে প্রকাশকদের কাছাকাছি হবার একটা প্লাটফরম। তাতে প্রকাশকদেরই লাভ। প্রকৃত লেখক যদি প্রকাশকদের কাছ থেকে উপযুক্ত ফিডব্যাক পান তাহলে প্রকাশকদের দুর্দিনে তারাও পাশে দাঁড়াবেন। তাতে করে অচলায়তনটা একটু একটু করে ভাঙবে।

বাংলানউজের পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ। আশা করি ভবিষ্যতে আমরা আপনাদের সঙ্গে এরকম অন্তরঙ্গ মতবিনিময়ে মিলিত হতে পারবো।

বাংলাদেশ সময় : ২১৩০, জানুয়ারি ৩১, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।