বেশ কিছুদিন হল কী যে এক আশঙ্কায় দিনাতিপাত করছি। মগজের সবগুলো তার যখন বেসুরো সুরের মতো বেজে ওঠে।
আজ বহুদিন হ`ল তাঁর দেখা নাই। এই দুর্মূল্যের বাজারে হয়তোবা ধরাধামের মায়াই ত্যাগ করেছে লোকটি! কী জানি ‘পটল তুলে’ ঈশ্বরের সবজীর কারবারে আত্মনিয়োগী হয়েছেনও বা!
শৈশবে যখন সে ‘আমার রাসুল হবে উম্মতের জামিন...` ভরাট গলায় আমাদের সরু গলির বদ্ধ হাওয়া দুলিয়ে যেত; সাথে থাকত তার শীর্ণকায় মলিন বৌটি। বৌয়ের হাতে ধরা লাঠির ইশারায় পথ চলে গান গেয়ে ভিক্ষে করে ফিরত। ভগ্ন স্বাস্থ্যের ভিখিরিনীর পাশে গাতক পুরুষটি ছিল বেমানান। চওড়া বপু, প্রায় ছ`ফুট লম্বা সুঠাম দেহের অধিকারী ভিক্ষুকের স্বাস্থ্য তো ঈর্ষণীয়! গুটি বসন্তের ‘তারকা’ খচিত চেহারাটি অবিস্মরণীয়। কাঁচাপাকা চাপদাঁড়িতে আধ্যাত্মিকতার আভা মেশা। ঘোরলাগা ভুবনজোড়া অবিরাম বর্ষার একদিনে; ভূতের বাড়ির (পরিত্যক্ত বাড়ি) আঙিনায় ঠাঁই নেয় ভিখিরি দম্পতি। আমার খোলা জানালা দৃষ্টিগোচর হয়নি তাদের। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখি বাউল-ভিখিরি দম্পতির খুনসুটি-রোমাঞ্চ! আদি মানবের দুই হাতে বৃষ্টিস্নাত ভিখিরিনীর মাথার রুক্ষ চুলে পরম যত্নে বিলি কাটার নয়নাভিরাম দৃশ্য।
‘আরে কার বা কাছে করি দোয়া? কে বা দয়া করে রে... ওরে ভাই মোমিন?’ প্রশ্ন করে শ্রোতাদের গভীর সংকটে নিপতিত করে ফের ‘আমার রাসুল হবে উম্মতের জামিন’ বলে ভরসা দিত। তাকে ভিক্ষে দেয় কার সাধ্য? অমূল্য গানের যৎকিঞ্চিত সম্মানি সমঝদার মাত্রই পরিশোধ করত। কারো দুয়ারে কোনোদিন কড়া নাড়েনি ভিক্ষার জন্য। এক পথ ধরে এসে অন্য পথে হারিয়ে যেত কোথায় যেন!
স্কুল ফেরতের পর গা-গোসল-আহার তারপর দীর্ঘায়ু দুপুর! ফুরোতেই চাইতো না সেই একঘেয়ে মহাকালব্যাপী অলস দুপুর। হোমওয়ার্ক নতুবা ঘুম; বিকল্প সকল রাস্তার দুয়ার তালাবদ্ধ। এমন জঘন্য দিনে `জিবরাইলের ডানা` হয়ে আসত তাঁর গান `আরে অন্ধ ফকির করে দোয়া...`। প্রতিদিন সে আসত না প্রতি সপ্তাহান্তেও নয়। ঈদের চাঁদের মত উদিত হতো একেকদিন। মিরপুরে নিম্নবিত্তের সংকীর্ণ দরদালানের গুমোট হাওয়া স্বস্তির দমকা হাওয়ায় নাচিয়ে যেত। দেখা মাত্রই এক বাটি চাল দৌড়ে গিয়ে ঢেলে দিতাম তাঁর কাঁধের ঝোলায়। স্বল্পবাক লোকটি কথা বলতো না একেবারেই। আর দশ ফকিরের ন্যায় কারো জন্যে আয়ু বা সৌভাগ্য কামনা তো নয়ই। থালায় জমা পড়া সিঁকি-আধুলির ঝনঝনানিতেও ঘাড় ঘুরিয়ে চাইতো না দাতার দিকে। চোখে ছিল না কৃতজ্ঞতার লেশমাত্র চিহ্ন।
শেষবার তাকে দেখি বছরখানেক আগে। আট কি দশ বছরের এক বালক, ছেলে বা নাতি; হাতের লাঠি হয়ে হাঁটছে তার সাথে। ‘বৈষ্ণবী কি গতায়ু হয়েছেন?’ শীতের সকালে পুরুষ্ট পায়ের পাতা চৈত্রের শস্যহীন জমির মতো ফাটা ফাটা। গলা ভাঙা, তবে কি আশ্চর্য দেহটি ভাঙেনি আজও। পলিতকেশ, শ্বেতশুভ্র দাঁড়িময় মুখখানায় ভারতীয় সুফীর আদল। জ্ঞানের মহিমায় আভাসিত! `আরে একটা টাকা করলে... আখেরাতে পাবে রে.../ওরে ভাই মোমিন, তোমার রাসুল হবে উম্মতের জামিন। ` সেই শেষবার জামিনদারের সন্ধান দিয়ে গেলেন, আর ফিরে আসেননি। অন্য কাউকে সন্ধান দিচ্ছেন কি? তার সাক্ষাৎ পাবার সৌভাগ্য আমার আর ঘটলো না।
বাংলাদেশ সময় ১৬৫৪, জানুয়ারি ৩০, ২০১২