ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

বাংলানিউজের গোলটেবিল (পর্ব-১)

বইমেলা: লেখক-প্রকাশকদের যতো অভিযোগ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১২
বইমেলা: লেখক-প্রকাশকদের যতো অভিযোগ

কিছু দিনের মধ্যেই শুরু হতে যাচ্ছে মাসব্যাপী একুশের বইমেলা। বইমেলাকে সামনে রেখে ২১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বাংলানিউজে কয়েকজন তরুণ প্রকাশক ও লেখককে নিয়ে আয়োজন করেছিল এক অনলাইন গোলটেবিল বৈঠক।

আলোচনার বিষয় ছিল ‘বইমেলা এবং প্রকাশনাশিল্পের সংকট ও সম্ভাবনা’।

গোলটেবিল বৈঠকিতে অংশগ্রহণকারী প্রকাশকরা হলেন--- পারভেজ হোসেন (কথাসাহিত্যিক, প্রকাশক, সংবেদ), সাঈদ বারী (প্রকাশক, সূচীপত্র), রবীন আহসান  (প্রকাশক, শ্রাবণ), আহমেদুর রশীদ টুটুল(প্রকাশক, শুদ্ধস্বর) ও খন্দকার সোহেল(প্রকাশক, ভাষাচিত্র)।

এছাড়া কবি, লেখক-সাহিত্যিকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন--- জুয়েল মাজহার (কবি-অনুবাদক, কনসালট্যান্ট এডিটর, বাংলানিউজ),শামীম রেজা (কবি ও সাহিত্য সম্পাদক, কালেরকণ্ঠ),মাহমুদ মেনন (হেড অফ নিউজ অপারেশন্স, বাংলানিউজ), সাখাওয়াত টিপু (কবি ও প্রাবন্ধিক), ফেরদৌস মাহমুদ (কবি,শিল্প-সাহিত্য সম্পাদক, বাংলানিউজ), রানা রায়হান (অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর, বাংলানিউজ) ও শেরিফ আল শায়ার (গল্পকার ও ব্লগ এডিটর, বাংলানিউজ)।

আলোচনায় উঠে আসে বইমেলা ও প্রকাশনা শিল্প-সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়। বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো সেই গোলটেবিল বৈঠকের অংশবিশেষ।
সঞ্চালক : ফেরদৌস মাহমুদরানা রায়হান
 
   

ফেরদৌস মাহমুদ : শুরু হতে যাচ্ছে একুশের বইমেলা। এ মেলাকে সামনে রেখেই মূলত আমাদের গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন। আজ আমাদের আলোচনার মূল বিষয় হচ্ছে, ‘বইমেলা এবং প্রকাশনা শিল্পের সংকট ও সম্ভাবনা’। প্রতি বছরই ফেব্রুয়ারি মাস এলে বইমেলা হয়। আর নানা মিডিয়ায় এ ধরণের আয়োজন হয়, নানা রকমের সমস্যা নিয়ে কথা হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত আসলে দেখা যায় যেমনটা তেমনই থাকে। এ বিষয় নিয়ে এখানে আমাদের কথা হতে পারে।

এদিকে আমাদের স্বাধীনতার চল্লিশ বছর হয়ে গেল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের প্রকাশনা শিল্পটা শুরুতে যেরকম ছিল, সেখান থেকে আসলে আমরা কতটা এগুতে পেরেছি? শুরু থেকে এ পর্যন্ত আমাদের প্রকাশনা শিল্পের পরিবর্তন আসলে কি হয়েছে? আমরা গত ৫-৭ বছরের দিকে তাকালে দেখবো এরই মধ্যে আমাদের জীবন-যাপনের একটা অংশ হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট, ফেইসবুক, ব্লগ, অনলাইনসহ অনেক বিষয়ই। ফেইসবুক, ব্লগ ও অনলাইনেও আজকাল সাহিত্যচর্চা হয়, বইয়ের প্রচার হয়।

এক সময় ই-বুক ছিল না। আজকাল ই-বুকেও অনেক বই প্রকাশ হয়। এ বিষয়টা নিয়ে কোনো কোনো প্রকাশকের মনেও একধরণের দ্বিধা আছে। এটাকে কেউ ভালোভাবে দেখছেন, কেউ দেখছেন না। আমরা চেষ্টা করব প্রকাশকদের কাছে এসব বিষয়েও জানতে।

এদিকে বইমেলার কলেবর ও লোক সমাগম বেড়ে এখন এর ব্যাপকতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে একুশে বইমেলাস্থল বাংলা একাডেমীতেই থাকবে, নাকি সরিয়ে নেওয়া হবে এনিয়ে বেশ ক’বছর ধরে চলছে আলোচনা বিতর্ক।
 
অনেকে ঐতিহ্যগত কারণে বাংলা একাডেমীতেই বইমেলাস্থল রাখার পক্ষে। আবার কেউ কেউ স্থান সংকটের  কারণে বইমেলাটাকে বাংলা একাডেমীর বাইরে নেয়ার পক্ষে।
আর আমাদের বইমেলা হয় মাসব্যাপী। সম্ভবত পৃথিবীর কোথাও মাসব্যাপী বইমেলা হয় না। এ বিষয়টা কারও কারও কাছে অনেক সময় লেংদি, অনেক লম্বা সময়, বলে মনে হয়। এটা নিয়েও পরস্পরবিরোধী যুক্তি ও মতামত আছে।

আমরা দেখেছি লেখক আর প্রকাশকদের মধ্যে যেমন ভালো সম্পর্ক আছে, তেমনি ভেতরে ভেতরে এক ধরণের দ্বন্দ্বও আছে। এক্ষেত্রে লেখকদের প্রকাশকদের কাছে অনেক কিছু চাওয়ার থাকে। আবার প্রকাশকদেরও লেখকদের কাছে চাওয়ার থাকে অনেক কিছু।
আমরা আমাদের বৈঠকিতে এ বিষয় নিয়েও আলাপ করতে পারি। আমার মনে হয় আমরা এখন আলোচনা শুরু করতে পারি। শুরুটা করবেন খন্দকার সোহেল..


খন্দকার সোহেল : টপিকটা আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। এটা এমন একটা টপিক, এ নিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটা গোলটেবিল বৈঠক হতে পারে। কারণ বইমেলা সম্পর্কে আমরা http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012January/khandoker sohel 120120126195613.jpgসবাই জানি, এ নিয়ে প্রচুর কথা হয়। কিন্তু প্রকাশনা শিল্প... এ নিয়ে আসলে কতখানি কথা হয়! এখন ‘শিল্প’ শব্দটাকে আমি যদি বিশ্লেষণ করি--- তাহলে শিল্পের অর্থ হচ্ছে দুটি। একটা হচ্ছে ‌‌‘শিল্প’ শব্দটা আমরা ‘আর্ট’ বা শিল্পকলা অর্থে ব্যবহার করি, আবার ইন্ডাস্ট্রি অর্থেও ব্যবহার করি।

আমাদের এখানে প্রকাশনাই একমাত্র মাধ্যম যেটার সাথে আর্ট এবং ইন্ডাস্ট্রি দুটোই হান্ড্রেট পার্সেন্ট জড়িত। কিন্তু এখনো পর্যন্ত আর্ট এবং ইন্ডাস্ট্রির কতটুকু সংযোগ হচ্ছে সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এবং আমরা যারা প্রকাশনা করার চেষ্টা করতেছি, তারা মনে করছি এক্ষেত্রে বিজনেস অর্থে যে শিল্প এবং নান্দনিকতার যে শিল্প—এ দুয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক।

একটা বইয়ের জন্য, প্রকাশনার জন্য মূল কাঁচামাল কোনটা? কাঁচামাল হচ্ছে লেখা। এটা আমাদের লেখকদের কাছ থেকে আসে। আমাদের এখানে যে সমস্ত লেখা আমাদের লেখকরা লিখে অভ্যস্ত তাতে যথেষ্ট বৈচিত্র্যের অভাব রয়েছে বলেই আমার মনে হয়। বেশিরভাগ লেখকই কবিতা-গল্প-ছোটগল্প আর উপন্যাস লেখেন। এর বাইরে যে কতো কতো বিষয় রয়ে গেছে সে বিষয়ে বই কোথায়? লেখক কোথায়?

বইকে তখনই আমি শিল্প বলব, যখন ওটাকে আমরা প্রডাক্ট বলব। যখন ওটাকে লেখকদেরকে তাদের প্রাপ্য অর্থটা দিয়ে বাজারভ্যালু তৈরি করে বাজারজত করতে পারব।     

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো--- আমরা প্রকাশকরা অনেকেই মাঝেমধ্যে ঠাট্টা করে বলি, বাংলাদেশে এমন ২০ জন লেখকও নেই যাদের বই আমরা একসাথে, সরকারি হিসেবে, ১২৫০ কপি, প্রথম মুদ্রণ ছাপতে পারি। এটা আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক বিষয়।

আজকেই এক বৈঠকিতে আলোচনা হচ্ছিল বাংলাদেশের লেখকদের লেখালেখির বিষয়-বৈচিত্র্য নেই। শুধুমাত্র গল্প-ছোটগল্প-উপন্যাস-কবিতার বই-ই লেখকরা লেখেন। সৃজনশীল এ লেখাগুলোর বাইরে তাদের লেখার অভাব রয়েছে।

অথচ আমরা আমাদের পাশেই পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালে দেখব, ওখানে লেডিস হোস্টেল, তিনি চাকার রিক্সা, দেয়াল লিখন বা বস্তির মত ছোট ছোট বিষয় নিয়ে অনেক অদ্ভুত বই লেখা হয়। যার বিক্রিও অনেক ভালো। আমার মনে হয়, আমাদের দেশের লেখকদেরও এরকম নানান বিচিত্র বিষয় নিয়ে লেখার দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত।

আমাদের অনেক পাঠক রয়েছেন যারা সৃজনশীল লেখার পাশাপাশি অনেক তথ্যবহুল বইও পড়তে চান। আমারতো মনে হয় সৃজনশীল লেখার মধ্যেও গবেষণার অনেক সুযোগ থাকে।

আমি বলব যে, আমাদের এই প্রকাশনা শিল্পটার বিকাশের জন্য লেখক-প্রকাশক-পাঠক-মিডিয়া ----আমাদের সবাইকেই ভূমিকা রাখতে হবে। কেবল বইমেলায় নয়, বছরের মাঝমাঝিতে যদি আমরা আমাদের কথাগুলো বলার সুযোগ পাই, ওটা আমাদের জন্য ভালো হয়।

আমি এখন আমাদের বইমেলা নিয়ে কিছু কথা বলি। আমার মনে হয় বইমেলায় অনিয়মটা যেন একটা ঐতিহ্য হয়ে গেছে। অনিয়মটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমার মনে প্রায়ই প্রশ্ন জাগে, বইমেলার আসল উদ্দেশ্য কি? বইমেলা কি বই জনপ্রিয় করার বা ব্রান্ডিংয়ের সুযোগ দিচ্ছে? সিস্টেম তো এরকম হওয়ার কথা ছিল যে, এক মাস আমরা বইয়ের ব্রান্ডিং করব, বাকি ১১ মাস এর সুফল পাবো। কিন্তু ফল তো হয় উল্টো। আমাদের পুরো প্রকাশনা যেন ১ মাসে বন্দী। এক মাসব্যাপীই যেন আমাদের পুরো প্রকাশনা শিল্প। আমার মনে হচ্ছে বইমেলাকে অসাধু ব্যবসায়ীদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে।

বাংলানিউজ: সোহেল ভাই তো বললেন। এবার রবীন ভাই আপনার দৃষ্টিতে মেলার আয়োজন সম্পর্কে বলুন...

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012January/robin ahsan 120120126195410.jpgরবীন আহসান : বাংলা একাডেমী কোনো রাজনৈতিক দলের নয়। বাংলা একাডেমীর ডিজি তো বলতে পারে(ন) না আমি কাউকে স্টল দেব না। ওই মেলা হওয়ার কথা প্রকাশকদের। প্রকাশকদের যোগ্যতা অনুয়ায়ী হওয়ার কথা। ওইখানে মূল স্টল প্রকাশকরা পাবে। ওখানে কোনো রাজনৈতিক দলের স্টল হওয়ার কথা না। তারপরও আমার মনে হয়, আমাদের বইমেলায় স্টল বরাদ্দের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে।

ওখানে প্রতিবছর... সামনে পিছনে যখন যে ক্ষমতায় আসে তাদের ছবি টাঙিয়ে মেলার স্টল নেওয়া হয়। আমার মনে হয় এমন দুর্ভাগ্য পৃথিবীর কোনও দেশের মেলায় নেই।

মহাত্মা গান্ধীর ছবি টাঙিয়ে কেউ ব্যবসা করতেছে, ইন্ডিয়ার কোনো বইমেলায়, দিল্লি বইমেলায় এটা কিন্তু কেউ বলতে পারবে না। আমাদের বইমেলায় রেকর্ড আছে বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙিয়ে ইসলামী বই বিক্রি করতেছে... ধর্মগ্রন্থসহ মেলার চরিত্রের সঙ্গে যায় না এমন বইও বিক্রি করতেছে। কারণ আমরা প্রকাশকরা কিছু বলতে পারি নাই। বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতির পিতা, কেন তার স্টলে ধর্মীয় বই বিক্রি করা হবে? এটা করে তো বঙ্গবন্ধুকে কলুষিত করা হচ্ছে, বইমেলাকে কলুষিত করা হচ্ছে।

এদিকে আমাদের স্টলের সাইজ নিয়ে বললে তো হতাশার কথাই বলতে হয়। পৃথিবীর কোনো বইমেলায় ছয় ফিট স্টল হতে পারে, এটার একটা নমুনা আমরা দেখিয়েছি। ৬ ফিট মানে ৬টা বই... ২৪ টা বই নিয়ে আমরা বসতে পারি। আমরা কি ফুটপাতে বসা দোকানদার? তাহলে মেলায় না বসে আমরা তো চারুকলার সামনে ফুটপাতে বসতে পারি। ওখানে আশিক আকবর  
ফুটপাতে যে দোকান নিয়ে বসেছে তাকেও তো আমাদের চেয়ে অনেক বেশি সৌভাগ্যবান মনে হয়। তার সামনেও বিশাল জায়গা রয়েছে... তাকিয়ে দেখার মতো আমাদের তাও নেই।

আমাদের ডিজিটাল সরকার... অথচ, আমাদের বাংলা একাডেমীর বই মেলায় প্রকাশকদের কম্পিউটার ব্যবহার নিষিদ্ধ! আমাদের প্রকাশক সমিতি যারা আমাদের নেতা, তারা বলতে পারে না যে... এখন এই যুগে, ডিজিটাল সময়ে আপনি কম্পিউটার ব্যবহার করতে দেবেন না, তাহলে এটা কিসের মেলা।

আমি যদি বাংলা একাডেমীর বইমেলায় তিন ঘণ্টা থাকি, আমাকে ইন্টারনেটে থাকতে হবে, আমাকে ফেইসবুকে থাকতে হবে, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকমে থাকতে হবে...এরকম অন্যান্য সাইটে থাকতে হবে... কে কি করতেছে, কোথায় কি হচ্ছে প্রচারণার জন্য খোঁজ রাখতে হবে। কিন্তু সে সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত।

বইমেলাকে তো সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন করতে হবে। সে পরিবর্তনের তো কোনো স্বপ্ন আমি দেখছি না একাডেমী কর্তৃপক্ষের। বাংলা একাডেমী যদি সময়ের সাথে তাল মেলাতে না পারে, পরিবর্তনের সাথে না থাকে তাহলে এক সময় আমরা প্রকাশকরাই বলব গুডবাই বাংলা একাডেমী। আমরা তোমার সাথে নাই। ডিজিটাল যুগে ডিজটাল প্রযুক্তির সাথে যদি বাংলা একাডেমী থাকতে না পারে, যদি তাকে বাধাগ্রস্ত করে তাহলে তারা বর্তমান প্রযুক্কিনির্ভর যুগের বইমেলা কিভাবে করবে?

বইমেলাকে আমাদের স্বপ্নের অনুকূল জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। শিশুরা, টিনএজরা বইমেলায় আসতে পারে না। আমাদের বইমেলা যেখানে হয় সেখানে ধুলা ধাক্কাধাক্কির মধ্যে বাচ্চারা যেতে পারে না।

১৯৯২ সালে যখন আমার প্রথম ছড়ার বই প্রকাশ পায়, তখন আমি দেখেছি অনেক পরিবার তাদের বাচ্চাদের নিয়ে আসতে পারত। মেলায় একটা বড় জায়গা ছিল। আমাদের বইমেলার যারা উদ্যোক্তা তারা দেখে নাই যে...পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাচ্চাদের স্টল কি-রকম হয়। অথচ আমাদের বইমেলার ভিড়ের মধ্যে তো বাচ্চাদের অবস্থা কাহিল। বাচ্চা নিয়ে আসলে বাচ্চার মা চিন্তা করে তার বাচ্চা হারিয়ে গেল কি-না। তাছাড়া ভিড়ের মধ্যে বাচ্চার মায়েরাও কি এখানে নিরাপদ? মেয়েদের জন্য বইমেলা কতোটা নিরাপদ, কতোটা স্বস্তিকর সেটা ভেবে দেখতে হবে।

আমি মনে করি যে, আমরা তরুণরা যারা নতুন প্রকাশক হচ্ছি, তারা যেন বইমেলাকে স্বপ্নের জায়গায় নিয়ে যেতে পারি। তারা যেন দেখতে পারি বইমেলা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো একটা স্বপ্নের জায়গা।


বাংলানিউজ : প্রকাশক দু’জনের বক্তব্য তো শুনলাম। এ প্রসঙ্গ ধরেই শামীম ভাই---কবি শামীম রেজার বক্তব্য শুনতে চাচ্ছি...

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012January/shamim reza20120126195013.jpgশামীম রেজা : রবীনের বলার পর.. আসলে বলার আর কিছু থাকে না। বিপ্লবীদের মত ওর বক্তৃতা। বিপ্লবতো এক সময় থিতু হয়ে যায়... তারপরতো একটা অন্য জয়গায় তাকে দাঁড়াতেই হয়। আমার ভাবনার বিষয় আমাদের আর কতবার একই দাবি নিয়ে বক্তৃতা দিতে হবে। গলা ফাটাতে হবে?

আমার মনে আছে, রবীন আহসান যখন প্রথম দিকে ৯৮ কি ২০০০ সালে প্রকাশনাজগতে প্রবেশ করে তখন এক গোলটেবিল বৈঠকে ওকে আমি ডেকেছিলাম। ওই সময় সম্ভবত বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ছিলেন সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, মোহাম্মদ রফিক, সেলিনা হোসেন বা সেলিম আল দীনের মত সাহিত্যিকরা।

ওই সময়ও রবীন একই রকম জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছিল। আজকেও তাকে প্রায় ওই একই সমস্যা নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে... ... তার মানে কি দাঁড়ালো? এতদিন পরেও আসলে আমাদের বইমেলার , প্রকাশনার জগতের আগের অবস্থার কোনো বেসিক পরিবর্তন হয়নি। শিশুদের জন্য তখনও ভালো স্পেস ছিল না, এখন তো আগে যেটুকু ছিল সেটুকুও নেই। টিএনএজ মেয়েদের জন্য নিরাপদ না জায়গাটা। অনেক দিন ধরেই বলা হচ্ছে মেলাটা লেখকদের বা প্রকাশকদের হওয়া উচিৎ। তা-কিন্তু আজ অব্দি পুরোপুরি হয়নি।

অনেকদিন ধরেই মেলাটাকে সম্প্রসারণের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু হচ্ছে না। আমার প্রস্তাব হলো, মেলার সময় ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি বলা হয় এক মাসের জন্য বাংলাএকাডেমীর পেছনের দেয়ালটাকে একটু পিছিয়ে দিতে তাহলেই হয়ত জায়গা বেরুতে পারে।

একটু আগেই সোহেল বলছিল, আমাদের এখানে ১২০০ বই বিক্রি হয় এমন ২০ জন লেখকও নেই। আমি বলব গবষণামূলক লেখা লেখার মতো এখানে অনেক লোক আছে। প্রকাশকরা চাইলেই গবেষণামূলক লেখালেখি করার মতো লেখক বের করা সম্ভব। এক্ষেত্রে প্রকাশককে লেখককে বের করে নিতে হবে।

এবং শুধু ১২০০ কপি না ৩০০০ কপি বই বিক্রি করাও সম্ভব, যদি কাজটা প্রকাশকরা ঠিকমত করিয়ে নিতে পারে। আমি তো মনে আমাদের এখানে বাইজি নিয়ে... বেদেদের জীবন নিয়েও লেখালেখি করার মতো অনেক যোগ্য লেখক আছেন। প্রকাশকরাই তাদের খোঁজ করছেন না, তাদের তুলে আনছেন না। তারা কেবল তৈরি লেখকের কাঁধে চেপে চলতে চান। আর কেবল দেখেন লাভের দিকটা। মান নিয়ে , ভেতরের কনটেন্ট নিয়ে তারা ভাবেন না।
 
আমাদের কোনো প্রকাশকেরই কোনো নিজস্ব সম্পাদনা বোর্ড নেই। পৃথিবীর সব বড় বড় প্রকাশনারই সম্পাদনা বোর্ড থাকে। আমার যেটা মনে হয়, আমাদের বিপণন ব্যবস্থা, আমাদের সম্পাদনা ব্যবস্থা নিয়ে কিছু বলার আছে। প্রকাশনার জায়গা থেকে দেখলে আমরা আসলে বইটা শেষ মুহূর্তে পাই, আমরা কি সম্পাদনা করবো, আমাদের সম্পাদনা বোর্ড কারা... তার কোনো ঠিক নেই। এটা কিন্তু খুব প্রকাশ্যে থাকে পশ্চিমবঙ্গে, আমাদের পাশের দেশের ছোট্ট একটি প্রদেশ। ফলে তারা যে আয়োজন করে...তাতে জনগণের সম্পৃক্ততা থাকে.... প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ লোক অংশগ্রহণ করেন।

আমার মনে হয়, আমাদের এখানেও প্রকাশকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। পশ্চিমবাংলায় পাবলিশার্স গিল্ড আছে, আমাদের এখানেও এমন একটা গিল্ড থাকা উচিত ছিল। মেলার স্টলের বিষয়গুলো ওই গিল্ড দেখভাল করবে, অনিয়ম যাতে না হয় সেটা দেখবে, প্রকাশের প্রাপ্য অধিকারটুকু আদায় করবে।

আর বই সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার প্রসঙ্গে বলব, আমাদের ৬৪ জেলায় আমরা কি রকমের পরিকল্পনা করছি? আমরা ৬৪ জেলার লোকেরা কি করছি, কেবল সরাকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলেতো চলবে না। আমার মনে হয় নিজেদের বই ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সরাকারি গ্রন্থাগারের পাশাপাশি আলাদা গ্রন্থাগার করার ব্যবস্থা করা উচিত, তরুণ প্রকাশকদের।

বাংলানিউজ : এবার টিপু ভাই... কবি সাখাওয়াত টিপু, কিছু বলুন...

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012January/tipu 220120126195020.jpgসাখাওয়াত টিপু : সবাইকে ধন্যবাদ। আজকের বিষয় হচ্ছে ‘বইমেলা এবং প্রকাশনাশিল্পের সংকট ও সম্ভাবনা’। আসলে আমরা সব কিছুতেই সংকটের মধ্যেই আছি। গোটা দেশ থেকে, রাজনীতি-সংস্কৃতি থেকে একদম সব কিছুতেই আমরা আসলে সংকটের মধ্যে আছি। সংকটটা দেখলেই সংকট সব সময় সংকটই থাকে।

বাংলা একাডেমীর এখনকার যে মেলা এটা প্রকাশকরাই শুরু করেছিল। এটা বাংলা একাডেমীর মেলা না মোটেও। এটা হচ্ছে প্রকাশকদের মেলা, লেখকদের মেলা। যেখানে লেখক, প্রকাশক এবং পাঠকদের একটা সম্মিলন ঘটবে। একটা সম্মিলন ঘটার জন্য যে ধরণের আয়োজন প্রয়োজন বাংলা একাডেমীর পক্ষে তা করা কখনই সম্ভব না। প্রতি বছর এখানে একটা গতানুগতিক... আয়োজন-আনুষ্ঠানিকতা চলে।

আসলে, আমাদের এখানে প্রতি বছরই কিছু উৎসব হয়, যেমন— পহেলা বৈশাখ। এটা কেউ আয়োজন না করলেও ... ছায়ানট আয়োজন না করলেও এটা হবে অটো। ছায়ানট আয়োজন না করলেও বৈশাখের মেলা ঠিকই হবে। কারণ এটা মেলা। আমরা দেখি যে, আমাদের প্রায় সব গ্রামে চৈত্রসংক্রান্তির উৎসব হয়... এটা অটোই হয়। নির্দিষ্ট কোনো একাডেমীর প্রয়োজন হয় না এই আয়োজনের জন্য। এই রকমের একুশের বইমেলার ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে, কেননা
একুশ আমাদের অনেক গভীরে গেঁথে আছে।

এখানে আসার সময়ই আলাপ করতেছিলাম, বাংলা একাডেমীর মেলার স্টলের যে সাইজ তা একটা মানুষ কবরে গেলে যে পরিমাণ সাইজ লাগে, অনেকটা ওই সাইজ। স্টলের সাইজ আসলে ওইটার চেয়েও কম।

এখন কথা হচ্ছে ওইভাবে বললে বলতে হয়, বাংলাএকাডেমী হচ্ছে একটা  গোরস্তান। ওই যে গোরস্তান, ওই কবরস্থান থেকে মুক্তবাতাসে বাংলা একাডেমী বইমেলাকে বের করে নিয়ে আসা উচিত। এটা যতদিন না হবে, ততদিন আমাদের সাহিত্য বলি, প্রকাশনা বলি কোনো কিছুই এগুবে না।

গত দশ বছরে আমরা বাংলা একাডেমীর এমন কোনো প্রকাশনা দেখি না যেখান থেকে একটা বুদ্ধিবৃত্তিক, কালচারাল সংস্কৃতিক উন্নতি ঘটে। এরই মধ্যে দেখলাম ওরা প্রমিত ভাষার একটা বাংলা ব্যাকরণ করেছে।

বাংলাভাষায় এখন পর্যন্ত যে ব্যাকরণ লেখা হয়েছে সেটা হচ্ছে রাজা রামমোহন রায়ের গৌরীয় ব্যাকরণ। ওই ব্যাকরণের কোনো কিছুর উল্লেখ নাই ওখানে।   এই ধরণের একটা চালবাজী জিনিস বের করার মানে কি? তাছাড়া   

বাংলাভাষা কেন প্রমিত হবে। নোয়াখালির ভাষা, বরিশালের ভাষা, চট্টগ্রামের ভাষা, ঢাকার ভাষা... .... এরকম সব ভাষারই আলাদা আলাদা গুরুত্ব আছে। বাংলাভাষাকে এভাবে প্রমিত করতে যাওয়া তো ঠিক না।

আমি খন্দকার সোহেলের সাথে দ্বিমত পোষণ করি। আমাদের এখানে ভালো লেখক আছে। তবে প্রকাশকদের লেখক বের করার সার্চিংটা নাই, অন্বেষণটা নাই। ভালো সম্পাদকের অভাব আছে, সম্পাদনা ঠিক হয়ে ওঠে না। আমাদের এখানে কিন্তু অনেক ভালো প্রবন্ধও লেখা হয়। যতীন সরকার, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বদরুদ্দীন উমর বা সলিমুল্লাহ খানের মতো লেখকরা আছেন।    

আমি নাম বলব না, কয়েক মাস আগে আমি আশির দশকের একজন খুব ভালো কবির  
ভালো কিছু কবিতা নিয়ে একটি বই করার কথা বলছিলাম কিন্তু কোনো প্রকাশকই দেখলাম তা প্রকাশ করতে আগ্রহী হলো না।


রবীন আহসান : যদি প্রকাশকরা সারভাইভ করতে না পারে.... তাহলে ওইটা প্রকাশ কেন করবে? প্রকাশকদেরও তো অনেক খরচ আছে, তাতো অন্তত উঠতে হবে। মাস শেষে প্রকাশককেও তো দোকান ভাড়া দিতে হয়, গুদাম ভাড়া দিতে হয়, কর্মচারীরর বেতন দিতে হয়, টেলিফোন বিল দিতে হয়, বই বের করার খরচ বহন করতে হয়।

এদেশে স্বাক্ষরতার হার এখনো অনেক পিছিয়ে... আমার পক্ষে চাইলেও অনেক ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব না। তাছাড়া এখানে চাইলেও একজন লেখককে ওইভাবে ব্রান্ডিং করা সম্ভব না... এক্ষেত্রে যে কারও বই একটা প্রকাশক করার ঝুঁকি কিভাবে প্রকাশক নেবে!
 
খন্দকার সোহেল : রবীন ভাইয়ের কথার সূত্র ধরেই বলি, আজিজ মার্কেটে যে দোকানগুলো রয়েছে, যেমন— প্রথমা, মধ্যমা, সন্দেশ বা এরকম যা আছে তারা কিন্তু বাংলাদেশি বই নিতেই চায় না। আপনি ২৫ টি বইয়ের ক্যাটালগ পাঠালে দেখা যাবে তারা হয়ত দুটো বই নিলো। এই দোকানগুলোতো আপনার বই ডিসপ্লেতে রাখবেই না, দেখা যায় ওরা বিক্রি করে ইন্ডিয়ান বই। তারা বড় বড় কথা বলে, কিন্তু দেশি বইয়ের বিক্রির ক্ষেত্রে বলার মতো কোনো ভূমিকা কিন্তু তাদের নেই। তারা দেশের বই দেশের বই বলে গলা ফাটায় আর বিক্রি করে, ডিসপ্লে করে ইন্ডিয়ান বই। তারা দেখে শুধু লাভ। এ অবস্থা শুরু হয়েছে ঢাকার বাইরেও। চট্টগ্রাম বা সিলেটে যদি ২০০ বইয়ের ক্যাটালগ পাঠানো হয়, দেখা যায় তারাও তিন-চারটার বেশি বই নেয় না।

ইন্ডিয়ান বই যে আমাদের বাংলাদেশি বইকে খেয়ে ফেলছে... এটা তো ওরা বোঝে না। আর এক্ষেত্রে আপনার ওই কবিতার বই ওরাতো ডিসপ্লেই করবে না। বইটা যতো ভালোই হোক।

সাখাওয়াত টিপু : বই বিক্রি হয় না এটা মনে হয় না পুরোপুরি ঠিক। আমাদের এখানে লেখক রয়্যালিটি দেওয়া নিয়ে আমার মনে হয় কিছুটা অস্বচ্ছতা আছে। আমার বিবেচনায় এখানে দুই ধরনের প্রকাশক আছে। এক ধরণের প্রকাশক আছে গভমেন্টের টেন্ডার নিয়ে অন্যান্য পাঠ্যপুস্তকের বই প্রকাশ করে আর ফাঁকে ফাঁকে একটা দুটা সৃজনশীল বই করে। এক ধরণের প্রকাশক আছে ফিশিং করে। একটি লেখককে টার্গেট করে টাকা নিয়ে বই করে।

প্রতি বছর হয়ত বাংলা একাডেমীকে গালি দিতে পারি, কিন্তু আমার কথা হচ্ছে আমাদের এখানে এখনো প্রকাশনার সঠিক কালচারই তৈরি হয়নি। লেখক-প্রকাশকের কালচারইতো ডেভেলপ করে নাই।

 

[চলবে]

বাংলাদেশ সময় ১৯২৪, জানুয়ারি ২৬, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।