ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

একুশে বইমেলা বিষয়ে কয়েকটি প্রস্তাব

সাঈদ বারী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১২
একুশে বইমেলা বিষয়ে কয়েকটি প্রস্তাব

একুশে বইমেলা এখন আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্যের অঙ্গ। সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় উৎসব।

কিন্তু একে ঘিরে বেশ কিছু সংকট তৈরি হয়েছে। যা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। বইমেলায় জায়গা সংকট--- এটি এখনকার একটি বাস্তব ও প্রধানতম সমস্যা। এই সমস্যার অতি জরুরি সমাধান প্রয়োজন। এ ব্যাপারে আমাদের বইমেলার পরিসরের প্রায় ৫০গুণ বড় পরিসরে আয়োজিত কলকাতা বইমেলা আমাদের চোখের সামনেই উদাহরণ হিসেবে রয়েছে। বর্তমানে বইমেলার আনুষঙ্গিক যা কিছু সমস্যা, তার অধিকাংশই স্থান-সংকট থেকে উদ্ভুত। এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষের ভূমিকা অনেকটাই সীমাবদ্ধ। অনানুষ্ঠানিকভাবে বাংলা একাডেমীতে যে জায়গায় অমর একুশে বইমেলা শুরু হয়েছিল, প্রায় ত্রিশ বছরের অধিককাল সময়ের পর আজও সেই সীমাবদ্ধ জায়গাতেই তাদের বইমেলা আয়োজন করতে হচ্ছে। অথচ ইতিমধ্যে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা, ঢাকা শহরের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে কয়েক গুণ। সেদিক থেকে দেখলে তারা অনেকটা অসহায়ও।
 
পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে বইমেলার নিরাপত্তা ব্যবস্থা সব সময়ই আমার কাছে মনে হয়েছে নাজুক! বিশেষ করে একুশে ফেব্রুয়ারিসহ যেসব ছুটির দিনে পাঠক-ক্রেতা-দর্শকদের প্রচণ্ড ভিড় হয় (পত্র-পত্রিকার ভাষায়, মেলা জমে ওঠে!), সেদিন সত্যিকার অর্থেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। বইমেলা কর্তৃপক্ষেরও নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। বইমেলায় প্রবেশ ও নির্গমনের বর্তমান ব্যবস্থা অপ্রতুল। ফলে নারী, শিশু-কিশোর ও বয়স্ক পাঠক-ক্রেতাদের খুবই ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয়।

অমি অনেক বইমনস্ক পরিবারকে জানি, গত কয়েক বছর ধরে তারা বইমেলায় আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ বইমেলায় এসে তারা ভাল পরিবেশ পান না। বঙ্গবাজার আর গুলিস্তানের হকার্স মার্কেটের মতো সারি সারি বুক স্টল (নাকি ঘুপচি ঘর!) দিয়ে বাংলা একাডেমী বইমেলাকে যেভাবে গলি-ঘুপচির মিলনমেলা করে রেখেছে, তাতে বাণিজ্য মেলার মতো মনের আনন্দে এক স্টল থেকে আর এক স্টলে কিংবা এক প্যাভিলিয়ন থেকে আর এক প্যাভিলিয়নে ঘুরে ঘুরে বই দেখার সুযোগ কোথায়?

এ প্রসঙ্গে আমাদের এই সময়ের অগ্রজ প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমদের একটি জাতীয় দৈনিকে লেখা কলাম থেকে উদ্ধৃতি দেই- ‘বইমেলায় বাংলা একাডেমীর প্রতি ইঞ্চি জমি ব্যবহার করা হয়। মাঠ জুড়ে সারি সারি বইয়ের দোকান। যেভাবে দোকানের সারিগুলো রচিত হয় তার মধ্যকার ফাঁক অতি সামান্য। অত্যন্ত ধুলোবালি। মেলায় যে কয়দিন প্রচণ্ড ভিড় হয়, সে কয়দিন বাংলা একাডেমীর মেলা আমাদের মতে, পুরোপুরি নিরাপত্তাহীন অবস্থায় থাকে। যদিও এ পর্যন্ত বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু মেলা মোটেও দুর্ঘটনার আশংকামুক্ত নয়। যে কোনও সময় অগ্নিকা- ও জীবনহানির মতো ঘটনা ঘটে যেতে পারে। ভিড়ের দিনগুলোতে জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনও ব্যবস্থা নেই আর অগ্নিকাণ্ড ঘটলে বাংলা একাডেমীর মঞ্চের পেছনে ফায়ার ব্রিগেডের যে গাড়ি আছে সেটা সারি সারি দোকানের জন্য মধ্যবর্তী সংকীর্ণ পরিসরে হয়তো নড়াচড়াই করতে পারবে না। ’’
 
আমাদের গ্রন্থ প্রকাশনা শিল্প বর্তমানে যেভাবে ও যে পর্যায়ে বিকাশ লাভ করেছে, তাতে এখনই অমর একুশে বইমেলার জন্যে বাংলা একাডেমীর নির্ধারিত জায়গার চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বড় জায়গার প্রয়োজন। বইমেলাকে তার প্রাপ্য বিশালত্ব আর সৌন্দর্য দিতে হলে এটার বিকল্প নেই।
 
বইমেলায় আগত প্রতিটি পাঠক-ক্রেতা-দর্শককে প্রাণভরে শ্বাস নিতে দিতে হবে। বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্যাভিলিয়ন করার সুযোগ দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বই মাত্রই বইমেলার পণ্য হতে পারে। সে হোক না পাঠ্যবই, কারিগরি বই বা ধর্মীয় বই। জায়গার স্বল্পতার অজুহাতে সৃজনশীল বই বিক্রেতা, পাঠ্যপুস্তকের প্রকাশক, বিদেশি বই, নবীন প্রকাশক, অপেশাদার প্রকাশক কাউকেই বইমেলায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখা উচিত নয় বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। আর এসব তখনই সম্ভব হবে যখন বইমেলাকে ‘বাণিজ্যমেলা’র মতো বড়ো-সড়ো পরিসরে নিয়ে যাওয়া যাবে। আজ না হয়, ১০ বছর পর হলেও এটা করতে হবে। আর ১০ বছর পরে যেটা করতে হবে, সেটা এখন করলে ক্ষতি কী? আসুন, ১০ বছর এগিয়ে গিয়ে আমরা ভাবতে শিখি না কেন? বাংলা একাডেমীতে বরং বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে ৭ দিনের একটি বইমেলা করা যেতে পারে।

আর একটি বিষয়, বইমেলার আয়োজনের দায়িত্ব থেকে বাংলা একাডেমীকে অব্যাহতি দেয়ার সময় এসেছে। এটা বাংলা একাডেমীর কাজও নয়। বাংলা একাডেমীর কাজ হল বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা, বই প্রকাশ ইত্যাদি। বইমেলা সরকারি দয়া-দাক্ষিণ্যেও হওয়া উচিত নয়। বইমেলার আয়োজক হতে পারে প্রকাশকরা নিজেই। [গত কয়েক বছর ধরে বেসরকারি পর্যায়ে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজিত হচ্ছে ঢাকাতেই!] যেমনটি করে থাকে কলকাতা পাবলিশার্স গিল্ড। এজন্য প্রকাশকদের অবশ্যই সাংগঠনিকভাবে দক্ষ ও পেশাদার মনোভাবের হতে হবে। অর্জন করতে হবে রাজনৈতিক দলাদলির ঊর্ধ্বে উঠে একসঙ্গে কাজ করার মানসিকতা। ছোট- বড়, নবীন-প্রবীণ প্রকাশকের ভেদাভেদও ভুলে যেতে হবে। তবেই বেসরকারি পর্যায়ে বিশাল আয়তনে, বিশাল কলেবরে অমর একুশে বইমেলার আয়োজন সম্ভব।
 
অমর একুশে বইমেলার জন্য সুপরিসর স্থান যেখানেই বরাদ্দ হোক না কেন, তা অবশ্যই স্থায়ী হতে হবে-অন্তত আগামী ২৫ বছরের জন্য হলেও। বইমেলা নিয়ে আমাদের আরও সুষ্ঠু ও পেশাদারভিত্তিক চিন্তা-ভাবনা করার সময় এসেছে। ভাবা যেতে পারে কিছু মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে।
যেমন-
০১.    বইমেলার জন্যে খুব বড় পরিসর নির্ধারণ।
০২.    দু’সপ্তাহের বেশি বইমেলার মেয়াদ না রাখা।
০৩.    প্রবেশপথে টিকিট প্রথা চালু।
০৪.    ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে পাঠক-ক্রেতাকে বইমেলায় আসতে উৎসাহিত করা।
০৫.    বইমেলার কোনও একটি দিনে শিশুগ্রন্থ দিবস, বিজ্ঞানগ্রন্থ দিবস বা ভ্রমণগ্রন্থ দিবস পালন।
০৬.    দল বেঁধে স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের (স্কুল কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে) বইমেলায় আসতে আকৃষ্ট করা।


http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012January/Sayed Bari 7720120125171139.jpg

 

সাঈদ বারী
প্রকাশক, সূচীপত্র

বাংলাদেশ সময় ১৭০৫, জানুয়ারি ২৫, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।